শুকিয়েছে পাহাড়ি নদী, এবার তৃষ্ণা মেটাতে জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকবে হাতি-চিতাবাঘ!

শুকিয়েছে পাহাড়ি নদী, এবার তৃষ্ণা মেটাতে জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকবে হাতি-চিতাবাঘ!

জীবনযাপন/LIFE STYLE
Spread the love


বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: হাঁটু জল পাহাড়ি বড় নদীতে। ঝোরাগুলো শুকিয়ে ধুলো উড়ছে। এদিকে বেহিসেবি ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার, লাগামছাড়া অপচয়ের জেরে দ্রুত নামছে জলস্তর। জলকষ্ট তীব্র হতে শুরু করেছে তরাই-ডুয়ার্সে। শুধু লোকালয়ে নয়। জঙ্গলে থাকা খালবিল নদীও প্রায় শুকিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এবার তৃষ্ণা মেটাতে কি গভীর জঙ্গল ছেড়ে জলের খোঁজে লোকালয়ে পাড়ি দিতে শুরু করবে হাতি-চিতাবাঘ! বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা, ভূগর্ভস্থ জলের বেহিসেবি ব্যবহার ও অপচয় বন্ধ না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

ভারত-নেপাল সীমান্তের মেচি নদী থেকে অসম সংলগ্ন সংকোশ পর্যন্ত তরাই-ডুয়ার্স জুড়ে পানীয় জলকষ্ট তীব্র হতে শুরু করেছে। এখানেই রয়েছে উত্তরবঙ্গের ‘এলিফ্যান্ট রেঞ্জ’। ওই রেঞ্জের উত্তরে ভুটান, পশ্চিমে নেপাল এবং দক্ষিণে বাংলাদেশ। এখানে রয়েছে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প, জলদাপাড়া, গরুমারা, চাপরামারি, নেওরাভ্যালি ও মহানন্দা জঙ্গলের ১ হাজার ২৮৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। এটাই উত্তরের বুনো হাতিদের বিচরণ ক্ষেত্র। এখন সেখানে সাত শতাধিক হাতির বসবাস। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাতি প্রতিদিন প্রায় ১০০ লিটার অর্থাৎ ২৬ গ্যালন জল পান করে। ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হলে ওই পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। জঙ্গলে শুধু হাতি থাকে না। রয়েছে গন্ডার, বাইসন, হরিণ, বাদর, চিতাবাঘ সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। বেঁচে থাকতে প্রত্যেকের জল প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠেছে, সেই পরিমাণ জল ভাণ্ডার কি জঙ্গল এলাকায় এখন রয়েছে?

 

ডুয়ার্সের নদী শুকিয়ে ধূলো উড়ছে। নিজস্ব চিত্র

 

গরুমারা জঙ্গল লাগোয়া লাটাগুড়ির পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ‘গ্রিন লেবেল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’-র কর্ণধার অনির্বাণ মজুমদার বলেন, “জঙ্গলের খালবিল, ঝোরা, নদীনালা সবই শুকিয়েছে। পরিস্থিতি এমন উদ্বেগজনক যে এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে শুধু আগুন জলছে। আগুন নেভানোর জলটুকু মিলছে না। বন্যপ্রাণ জলের খোঁজে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে। লোকালয়ে ঢুকছে।” গরুমারার জঙ্গলের পেট চিরে বয়ে চলা মূর্তি নদীর জল বন্যাপ্রাণের জলের চাহিদা মেটায়। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, মূর্তি নদী শুকিয়ে তিরতির করে বইছে। একই পরিস্থিতি ডায়না, জলঢাকা, তোরসা, হলং, রায়ডাক, জয়ন্তী, সংকোশ নদীর। হাটু জলও নেই অনেক নদীতে। ছোট নদী ও ঝোরাগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। শুকিয়েছে লোকালয়ের বেশিরভাগ কুয়ো। বিকল হতে শুরু করেছে নলকূপ।

শহর এলাকার ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বাড়ির পাম্পে দশ-পনেরো মিনিটের বেশি জল উঠছে না। এই মুহূর্তে প্রত্যেকের ভরসা হয়েছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের টাইম কলের জল অথবা কেনা জল। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিভিন্ন এলাকায় টাইম কলে সুতোর মতো জল বের হওয়ায় ঝামেলা বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিলিগুড়ি, ময়নাগুড়ি, মেটেলি, চালসা, ওদলাবাড়ি, জয়গা সহ গ্রাম-শহরের বিভিন্ন এলাকায় ট্যাঙ্কে জল সরবরাহ শুরু হয়েছে। যেখানে পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা এখনও হয়নি সেখানে জলবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। জলের জন্য ডুয়ার্সে ঝগড়া বিবাদ রোজনামচায় পরিণত হয়েছে।

কেন জলকষ্ট এতোটা তীব্র?
আবহাওয়া দপ্তরের বিশেষজ্ঞ এবং ভূগোলের গবেষকরা জানিয়েছেন, ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ নির্ভর করে বৃষ্টির উপরে। বৃষ্টির জল ভূগর্ভে পৌঁছে সঞ্চিত হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ঠিক থাকলে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করলেও সমস্যা হয় না। কারণ, সেখানে বৃষ্টির জল পৌঁছে ঘাটতি পূরণ করে। ময়নাগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রধান তথা আবহাওয়া গবেষক মধুসূদন কর্মকার বলেন, “উত্তরবঙ্গে শীতকালীন বৃষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গত বছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে এবার মার্চের শেষ পর্যন্ত মাঝারি বৃষ্টি হয়নি। কোথাও ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হলেও কাজে লাগেনি। গ্রীষ্মে কালবৈশাখী কমেছে। ওই কারণে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমশ নামছে।” ভূগোলের গবেষকরা জানিয়েছেন একে বৃষ্টি নেই। তার উপরে জলের চাহিদা মেটাতে ডুয়ার্স এবং তরাইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকার  স্যালো এবং গভীর নলকূপের ব্যবহার বেড়েছে। যথেচ্ছভাবে গভীর নলকূপের মাধ্যমে জল উত্তোলন চলছে চা বাগান ও কৃষি জমিতে। শহরাঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ জল তুলে ড্রামে বন্দি করে চলছে পানীয় জলের কারবার। নজরদারির অভাবে ভূগর্ভস্থ জল দিয়েই বেড়ে চলেছে ‘কার ওয়াশ’-এর ব্যবসা। পরিণতিতে ভূ-গর্ভস্থ জল ভান্ডারে টান ধরেছে। তার উপর ক্রমশ পাইপের গভীরতা বাড়িয়ে যথেচ্ছভাবে জল উত্তোলনের পরিণতিতে দ্রুত জলস্তর নামতে শুরু করায় জলকষ্ট তীব্র হয়েছে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *