শীতের লেপ, লেপের শীত এবং এক খণ্ড যুদ্ধ

শীতের লেপ, লেপের শীত এবং এক খণ্ড যুদ্ধ

শিক্ষা
Spread the love


সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

বিনয় বিয়ে করে তিনটে বাঁশ পেয়েছে। একটা জ্যান্ত। সেটি হল তার বৌ। অন্য দুটি হল ঘড়ি আর লেপ। আমার কথা নয়। স্বয়ং বিনয়ের স্বীকারোক্তি। বিয়ের প্রথম কয়েক বছর বিনয় চুপচাপ ছিল। না খুশি, না অখুশি, একটা তুরীয় অবস্থা। যত দিন যাচ্ছে বিনয় নীরব থেকে সরব হয়ে কিছুদিন হল রবরবা। কথায় কথায় সংসারের কথা আসবেই। শুরু হবে বৌকে দিয়ে। বৌ থেকে সেই ভদ্রমহিলার জন্মদাতায়। সেখান থেকে ঘড়ি। ঘড়ি থেকে লেপ। ঘড়িটাকে বিদায় করেছে। কবজির কাছে ব্যান্ডের সাদামতো গোল দাগ এখনও রং ধরে মিলিয়ে আসেনি। মেলাবার মুখে। বৌ চিরকালের জিনিস। ঘাড় থেকে নামাবার উপায় নেই, জিয়ার্ডিয়া অ্যামিবায়োসিসের মতো ক্রনিক কেস। সারাজীবন ভোগাবে। আর লেপ শীতে নামাতেই হবে। নামালেই দুজনে গায়ে দেবে এবং পরের দিন সকালে আমাদের সেই লেপকেচ্ছা শুনতেই হবে।

বিবাহ মানেই একটি বৌ এবং মনোরম একটি বিছানা। বিছানা ছাড়া ফুলশয্যা হবে কী করে! বিনয় শীতকালে বিয়ে করেছিল বলে একটি লেপও পেয়েছিল। ডাবল মাপ। দুটি প্রাণীর শীতের আশ্রয়। লাল শালুর খোলে শিমুল তুলো। এর মধ্যে সমস্যার কী আছে সরল বুদ্ধিতে বুঝে ওঠা শক্ত। কিন্তু সমস্যা অনেক।

প্রেম যখন ঘনীভূত ছিল তখন সমস্যা ছিল না। আলো নিভিয়ে লেপের তলায় ঢুকে দুজনে জড়াজড়ি করে ‘আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই’ গোছের ব্যাপার। এখন এতদিন পরে অপ্রেমে সেই ‘কমন’ লেপকে গালাগাল দিলে আমরা শুনব কেন? তবু শুনতে হয়। ভায়ে ভায়ে ঝগড়া হলে সম্পত্তি ভাগাভাগি হতে পারে, কিন্তু কথায় কথায় একটা আস্ত লেপকে তো দু’টুকরো করা যায় না। কাপড়ও নয় যে জোড়া কেটে দুটো করবে। বৌ আর লেপ অবিচ্ছেদ্য। দাম্পত্য প্রেম আবার অবিচ্ছেদ্য নয়। সেখানে জোয়ারভাটা খেলে। এই গলায় গলায়, এই চুলোচুলি। তেঁতুল যত পুরোনো হয় ততই টক বাড়ে। লেপের ঝগড়া, ঝগড়ার লেপ। লেপের দুই মূর্তি। বৌয়ের মতোই। এই মনোরম, পরমুহূর্তেই বিস্ময়। সামলানো দায়।

প্রেমে মানুষ ত্যাগী হয়। বিনয় যখন প্রেমিক ছিল, ওই বছরখানেক মাত্র, তখন শীতে বৌকে লেপের তিনের চার অংশ ছেড়ে দিয়ে নিজের একের চার অংশে হিহি করত। ছেড়ে দিত বললে ভুল হবে। বৌ কেড়ে নিত। প্রথম রাতে লেপের তলায় দুটি মানুষ হলেও প্রেমে তালগোল পাকিয়ে একাকার। তখন আর সমস্যা কী? সমস্যা মাঝরাতে। বিনয়ের আদরে আদুরি বৌ উমুমু করে পাশ ফিরলেন, লেপের তিনের চার অংশ তার সঙ্গে চলে গেল। বিনয়ের শরীরের আধখানা খোলা, উদোম পড়ে রইল মাঘের শীতে শীতল সাদা চাদরে। পা দুটোকে জড়ো করে স্ত্রীর জোড়া ঠ্যাঙে গুঁজে গরম করতে গেলেই ঘুমের ঘোরে খ্যাঁক করে ওঠে, হচ্ছে কী? এবার ঘুমোও। লেপের বাইরে হায়নার মতো মাঝরাতের গাছ-গাছালির শিশিরমাখা শীত হামা দিচ্ছে। বিনয় কুকুরকুণ্ডলী হয়ে পশ্চাদ্দেশটিকে লেপের অংশে ঠেলে দিয়ে ভাবতে থাকে- ঘুমাও, হ্যাঁ এখন ঘুমাও কবি, রাতের কবিতা শেষ। জীবনটা যেন রংমহলের অভিনয়। প্রেমের নাটকে যবনিকা পড়ে গেছে। নায়িকা পাশ ফিরে লেপের আরামে শুেয় শুয়ে নায়ককে বলছে, দৃশ্য শেষ, মনের েমকআপ তুলে ফেলেছি। তখন তোমাকে সহ্য করেছি, কারণ করতেই হবে। তোমাকে বিশেষ অঙ্কের বিশেষ দৃশ্যে সহ্য করাই আমার জীবিকা। আমার জীবনের দুটো দিক, একটা অভিনয়ের দিক আর একটা নিজস্ব দিক। শীতের নির্জনতায় মানুষের মনে স্যাঁতসেঁতে চিন্তাই আসে। মনমরা চিন্তা সব হিলহিল করে ওঠে। পায়ের পাতা দুটোই বেশি ঠান্ডা হয়ে যায়। ওই জন্যেই বলে শীত করে। করে মানে, হাতে। শীত পায়। পায় মানে পায়ে, পদে। পা দুটো আশ্রয় খুঁজেছিল। পদাঘাতে ফিরিয়ে দিলে। একটা হাত বুকের উষ্ণতায় গরম হতে চেয়েছিল, খুব বিরক্ত হয়ে বললে, মাঝরাতে কি ইয়ার্কি হচ্ছে! ঘুমোলে মানুষের মনের বাঁধন আলগা হয়ে যায়। বৌ বলে আমিই এক বুরবাক, হেদিয়ে মরি। আসলে তুমি শ্বশুরমশাইয়ের কন্যা। পাকা বাঁশ কি সহজে নোয় রে বাবা!

সামান্য লেপ থেকে বিনয়ের অভিমান বাড়তে বাড়তে এমন একটা জায়গায় উঠল, যেখানে বিনয় যৌবনে যোগিনী। কার বৌ? কীসের সংসার? বৌও শ্বশুরমশাইয়ের, েলপটাও তাঁর। যাও, তোমার লেপ তুমিই নিয়ে শুয়ে থাকো। বিনয়কে শুধরে দেবার কেউ নেই। শ্বশুরমশাইয়ের বৌ কি রে? ওই হল আর কী!

ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরলে লেপ সরে যেতেই পারে, তা নিয়ে অত মান-অভিমানের কি আছে বাপ! তুমিও টেনে নাও না। এ তো পাক-ভারত লড়াই নয় যে বাউন্ডারি কমিশন বসিয়ে সীমানা ঠিক করে দিতে হবে। বিনয় বললে, বৌকে নিজের মনে করতে পারলে সে অধিকার অবশ্যই খাটাতুম।

এ আবার কী কথা! বৌ নিজের নয় তো কি পরের?

বিনয়ের উত্তর শুনে ঠান্ডা মেরে যেতে হয়।

বিনয় তখনকার মতো চুপ করলেও আবার সরব হয়ে ওঠে। লেপের যে এত মহিমা কে জানত! বিনয় ক্রমশ দার্শনিক হয়ে উঠছে। বিনয়ের মতে, বৌ পরের ঘর থেকে আসুক, তার সঙ্গে খাট, বিছানা, বালিশ আর সার্টিনে মোড়া একটি লেপ যেন না আসে। খাল কেটে কুমির এনেছ এই যথেষ্ট, সেই সামলাতেই তোমার হাড়ে দুব্বো গজাবে, সঙ্গে আর কয়েকটা ফালতু লেজুড়ে এনে ন্যাজে গোবরে হওয়াটা ডাবল মুখ্যুমি। পরের সোনা দিও না কানে, কান যাবে তোমার হ্যাঁচকা টানে। হীনম্মন্যতায় ভুগবে। একই কক্ষপথে দুটো গ্রহ যদি বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকে, তাহলে প্রথমেই যা হবে তা হল দমাস করে একটি সংঘর্ষ। তারপর দুটো গায়ে পা লাগিয়ে ঠেলাঠেলি। তারপর যার শক্তি বেশি সেই ঘোরাতে থাকবে নাকে দড়ি দিয়ে চোখবাঁধা কলুর বলদের মতো। সংসারে স্ত্রী জাতিই প্রবলা। প্রবলা হবার কারণ পুরুষ জাতির দুর্বলতা। ট্যাঁক নবজাতক, ঘাড়ে সিংহজাতক।

সিংহজাতক মানে? শ্বশুরমশাইয়ের নাম নরেন সিংহ। এটা ট্যাঁ করে তো ওটা গর্জন করে। দুজনেরই সমান সমান বায়না। বায়না মিটলেই এর ক্রন্দন, ওর আস্ফালন, অসহযোগ, সত্যাগ্রহ, আমার ধোপা-নাপিত বন্ধ। পিরিতের তাসের ঘর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। প্রেম যে কত ঠুনকো তা বিয়ে না করলে বোঝে কার বাপের সাধ্য।

উপদেশ দেওয়া সহজ। পড়তে আমার মতো অবস্থায়, ঠ্যালার নাম বাবাজীবন শুনবে কি জিনিস! তখনও গা থেকে গায়ে-হলুদের রং ওঠেনি, পাওনা শাড়ির মাড় ওঠেনি, লেপের তলা থেকে উনি বলে উঠলেন, বাবা একটা লেপ দিয়েছে বটে। পালকের মতো হালকা, উনুনের মতো গরম। নজর দেখেছ?

ও তোমার যৌবনের উত্তাপ। তায় আবার পান খেয়েছ কাঁচা সুপুরি দিয়ে! লেপের আবার ভালো-মন্দ কী! সে এক শালু কি সার্টিন, ভেতরে তুলো। সব লেপেই যা থাকে, এর মধ্যেও সেই একই মাল।

রাখো! বরের লেপে শ্মশানের তুলো ভরে দেয়, বুঝলে চাঁদু?

শ্মশানের তুলো? সে আবার কী!

কী জানো তুমি! শ্মশানের যত মড়া আসে তাদের বিছানা ছিঁড়ে তুলো বের করে তুলোপট্টিতে জলের দরে বিক্রি হয়। সেই তুলো দিয়ে তৈরি হয় ফুলশয্যার লেপ। এ জিনিস সে জিনিস নয়। এ হল এক নম্বর মাল। আগুন ছুটছে।

শ্বশুরবাড়ির জিনিস সম্পর্কে সব মেয়েরই ওই রকমের এক ধরনের দুর্বলতা থাকে। বৌ বস্তুটিকে ব্যবহার করার কায়দা আছে ভাই। মোলায়েম মোলায়েম হাতে ময়দা ডলার মতো ময়াম দিয়ে মাখতে হয়, তবেই না খাসা মুচমুচে লুচি।

তাহলে শোনো। সেই লেপপর্ব কোথাকার জলকে কোথায় নিয়ে গেছে। লেপের তলায় ঢুকে একদিন পা দুটোকে বেশ একটু খেলাচ্ছে বিনয়। সিংহকন্যা বললে, হঠাৎ আবার দেয়লা শুরু করলে কেন? সাতজন্মে পা ঘষো না। তোমার ওই চাষাড়ে পায়ের ঘষা লেগে লেপের ছাল উঠে যাবে।

কথাটা কিছু অসত্য বলনি হে। তোমার পায়ের যা মাপ আর তার যা চেহারা। অনেকটা স্নোম্যানের মতো।

পুরুষের পা এই রকমই হয়। পদাঘাতের পা। আঘাতের লোক তো আর পেলুম না, পদাঘাত খেয়েই গেলুম। আমার বরাতে নিউমোনিয়ায় মৃত্যুই লেখা আছে।

কেন?

কেন আবার! এই শীতে রোজ রাতে বিছানায় ওঠার আগে কনকনে ঠান্ডা জলে ঘষে ঘষে পা ধুয়ে লেডি ইনস্পেকটর জেনারেলকে দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে বিছানায় উঠতে হবে। তারপর শুনবে, আরও শুনবে বিনয়ের বিনীত কাহিনী।

বৌকে পারবে না, লেপটাকেই ডিভোর্স করো।

বৌ আর লেপ দুটোই আমার ছিল। আসলটা হাতছাড়া, ফাউ জড়িয়ে মাঝরাতে মটকা মেরে পড়ে থাকি। এ যেন সেই গ্যারাজে গাড়ি রেখে বাবুর বাসে ঝোলা। লেপটা দু’হাতে তুলে ঝপাং করে সিংহকন্যার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে এলুম। সারারাত লেপ নিয়ে পিংপং। বিনয় বললে, তোরা ভাই আজ আমাকে একটা লেপ কিনে দে।

বেডিং স্টোরে গিয়ে আমাদের লেপ দেখা শুরু হল। দেখি একটা হালকা সিঙ্গল লেপ। বিনয় বললে, সিঙ্গল নয়, ডাবল।

ডাবল কী করবি? সিঙ্গল মানুষ।

না, ডাবল কিনব। এতকাল শীতের রাতে বৌয়ের লেপের তলায় নেড়িকুকুরের মতো আশ্রয় খুঁজেছি। এইবার নিজের লেপে বুক চিতিয়ে পাশে একটু জায়গা রেখে শুয়ে থাকব। দেখি, তুমি আস কিনা তোমার অহংকারের দরজা খুলে!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *