শীতের খাবারে লাগল নাচন

শীতের খাবারে লাগল নাচন

শিক্ষা
Spread the love


  • সুমন ভট্টাচার্য

শীত মানেই ‘সরসো কা শাগ, অউর মাকাই কি রোটি’ কিংবা ‘কড়াইশুঁটির কচুরি, আর নলেন গুড়ের পায়েস’। শীতের সঙ্গে যেমন পিকনিক, মেলা বা কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ক্রিকেট খেলার একটা রোমান্টিক ‘লিভ-ইন’ আছে, তেমনই এই ঋতুর কিছু নিজস্ব খাবারদাবারও আছে। উত্তর ভারতের ‘পঞ্চনদীর দেশ’ পাঞ্জাব যেমন তার মধ্যে ‘আইকনিক’, ‘আইকনিক’ কারণ বলিউড প্রায় এই দুটি ডিশকে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি দিয়েছে বলে, সেই ‘সরসো কা শাগ, অউর মাকাই কি রোটি’ দিয়ে উত্তর ভারতের ‘ট্রেন্ড সেটার’ হয়, তাহলে বাঙালির আছে কড়াইশুঁটি থেকে ফুলকপির পরোটা আর গুড়ের হরেক রকমের পদ! উত্তরবঙ্গও শীতে পাহাড়ি আমেজের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আচার বা কোচ রাজবংশীদের ফেভারিট সব পদ নিয়ে হাজির থাকে।

রাজবংশী ‘ডেলিকেসি’ হিসেবে শিদল হচ্ছে সব পদের সঙ্গে চলনসই একটি উপাদান। কচু দিয়ে রান্না করুন, কিংবা পাট পাতায় রোদে শুকিয়ে তৈরি করা শিদলের পদ বিশেষ উপাদেয়। আবার উত্তরবঙ্গের শীতে জনপ্রিয় খাবার ভাপা পিঠে না খেলে পৌষ বা মাঘ মাসের ছুটির দিনগুলো বৃথা যায়। আজকাল যেহেতু শীতে দার্জিলিং বা ডুয়ার্স বেড়ানোটাও একটা ‘ট্রেন্ড’, তাই সেই সময় উত্তরবঙ্গের কিছু পদ না চাখাটা প্রায় মহাপাপের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। তার মধ্যে যেমন ‘দোগপ্পা’ অর্থাৎ বাঁশের চোঙের ভিতরে তৈরি আঠালো ভাত আর মুরগির মাংস রয়েছে, তেমনই বাঁশের আচারও চেখে দেখাটা অবশ্য কর্তব্য। আমার অবশ্য যেহেতু নিজস্ব পছন্দ মাছ, তাই ‘নাপ্পি’ আর ‘চুঙ্গা শুঁটকি’র কথা বলতেই হবে। ‘নাপ্পি’ হচ্ছে চিংড়ি বা অন্য ছোট মাছ লবণ মাখিয়ে, রোদে শুকিয়ে তারপর গুঁড়ো করে জলে মিশিয়ে ছোট ছোট মণ্ড পাকিয়ে পাতে পরিবেশন করা হয়।

আসলে শীত মানেই একটা পেলব রোমান্টিকতা আর কিছু আদুরে নস্টালজিয়ার স্বাদকে ফিরিয়ে আনা। এই এআই, ‘এক্স’ কিংবা টুইটারের যুগেও যে স্বাদগুলো ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’। এখন হয়তো সারা বছরই ক্রিকেট খেলা হয়, তাই শীতের দুপুরে কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ইডেন গার্ডেন্সে বসে ক্রিকেট দেখাটা আর ততটা ‘ফ্যাশন’ নয়, কিন্তু এখনও শীতের মরশুমে পিকনিক মানে কমলালেবু আর জয়নগরের মোয়া মেনু তালিকায় থাকতেই হবে। সাবেককালে উত্তর কলকাতা কিংবা ভবানীপুরে বাড়ির দরজার পাশে নামফলকে লেখা ডিগ্রি বা আরও কিছু দেখে আভিজাত্য বিচার করতে হত, এখন হয়তো তা সোশ্যাল মিডিয়ার ‘স্ট্যাটাস’ দেখে বুঝতে হয়। ঠিক তেমনই শীতে নলেন গুড় তো শুধু পিঠে, পুলি কিংবা পায়েসের সঙ্গে আসে না, আসে আইসক্রিম কিংবা ফালুদার মধ্যে দিয়েও!

শীতের এই যে উদযাপন, তা তো কোনও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বা আমাদের ভারতবর্ষের কোনও নির্দিষ্ট প্রদেশেও আবদ্ধ নেই। পাঞ্জাবের যেমন জনপ্রিয় পদ আছে, তেমনই দক্ষিণ ভারতেরও ‘রসম’, আবার গুজরাটের ‘উন্ধিউ’ও আছে। কেউ ভাবতে পারেন ‘রসম’ তো সারা বছরই খাওয়া যায়! ঠিকই, কিন্তু শীতে গলা এবং শরীরের জন্য ‘রসম’-এর কোনও বিকল্প নেই। আর টমেটো, কারি পাতা এইসব কিছু দিয়ে শীতের ‘রসম’-এর স্বাদই আলাদা। তেমনই গুজরাটি পদ ‘উন্ধিউ’ তৈরি করার জন্য যত ধরনের সবজি লাগে, তা একমাত্র শীতকালেই হওয়া সম্ভব। যদি কেউ অমিতাভ ঘোষের বিখ্যাত বই ‘দ্য নাটমেগ’স কার্স’ না-ও পড়ে থাকেন, তাহলেও বুঝে নিতে অসুবিধা নেই, দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ, রাজনীতিকে কীভাবে তার মশলা প্রভাবিত করেছিল। মশলার বাণিজ্যের অধিকার নিয়ে যুদ্ধই উপনিবেশবাদ এবং উপনিবেশের জন্য তৈরি হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানচিত্রের অন্যতম নির্ণায়ক ছিল।

তাহলে সেই মশলা শীতের কোনও পদকে কতটা সুস্বাদু করে তুলতে পারে? দুটি মোগলাই পদের উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘রোগান জোশ’ কিংবা ‘পায়া কারি’। শীতের মরশুমে দই আর মশলা দিয়ে যে রোগান জোশ তৈরি হয়, তা আমিষ পদগুলির মধ্যে সেরা। মধ্য এশিয়ায় বেশ কয়েকটি দেশ উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, শীতের মোকাবিলায় আমিষ এইসব পদ জনপ্রিয় হয়েছিল, কারণ দই এবং মশলার অসাধারণ মিশ্রণের কারণে। মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলির ধারণা ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডায় কিংবা দমকা হাওয়ার মোকাবিলায় রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক রাখতে ‘রোগান জোশ’-এর কোনও বিকল্প নেই!

এই বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই, যে শীত মানেই বাজারে হরেক রকম শাকসবজির সমাহার। পালং শাক থাকলে যেমন ‘পালং পনির’ হবে, তেমনই সান্ধ্য আড্ডায় ‘পালং পকোড়া’ও থাকবে। টমেটো দিয়ে তো শুধু দক্ষিণ ভারতীয়রা ‘রসম’কে অন্য মাত্রা দেবেন এমনটা নয়, বাঙালি পাচকও ‘টমেটোর চাটনি’র মতো গুগলি তৈরি করবেন। এই যে পালং থেকে টমেটো, ফুলকপি থেকে কড়াইশুঁটি, এইসব কিছু দিয়ে তৈরি পদ ঘনাদা থেকে টেনিদার, বা আজকের সব ‘দাদা’, ‘দিদি’দেরও ফেভারিট। বিয়েবাড়ির ভোজ হোক, কিংবা গ্লোবাল সামিটের ‘বেঙ্গলি ডেলিকেসি’, তাতে কড়াইশুঁটির কচুরি আর নলেন গুড়ের রসগোল্লা না থাকলে তো বাঙালিত্বই ফিকে। আসলে শীতের সঙ্গে আমাদের যে ভাব-ভালোবাসা কিংবা খুনশুটি, তা অনেকটাই রান্নার মধ্যে দিয়ে যায়। আগে যেমন শীত এলেই সার্কাসের তাঁবু পড়ত, তেমনই পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠে, পুলি কিংবা পায়েস না হলে কেমন যেন মন আনচান আনচান করে। আর কে না জানে বাঙালিরা তো বটেই, ভারতীয়রা রান্নাবান্না নিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করতে সদা আগ্রহী। সেই কারণেই তো উত্তরবঙ্গের সিকিমের ‘মোমো’ কলকাতায় পৌঁছে অন্য আরও হরেক ধরনের পাশাপাশি ‘গন্ধরাজ মোমো’ হিসেবেও বিক্রি হয়। বিদ্রোহে অথবা প্রেমে ভালো খাবার কিন্তু যথার্থ সংগত করতে পারে! রবি শঙ্কর আর জাকির হুসেনের মতো যুগলবন্দি উপহার দিতে পারে!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *