- মনোনীতা চক্রবর্তী
আরও একটা জন্মদিনের দিকে এগোচ্ছে স্বচ্ছতোয়া। আরও একটা ঝমঝম উদযাপন। যদিও শ্রাবণ নয়, চৈত্রের চড়কমেলার মতো একটা ভিড়ের হইহই আছে। রোদ্দুর আছে। ঝলমল ত্বক, হাসি সব আছে। আর যা আছে, তা হল পিঠে বড়শি বেঁধানো ব্যথার মতো একটা টনটন করা অপেক্ষা।
খুব ভোরেই ঘুম ভেঙেছে আজ তার। ওয়ার্ডরোবের দিকে সন্ধানী চোখ। কিছুতেই স্বস্তি নেই। নীলপাখি আঁকা ব্রহ্মপুত্রের পাঠানো শাড়িটা, নাকি পুজোয় কেনা সমুদ্ররঙের সালোয়ার! খুব কনফিউজড! কিছুতেই যেন প্রপার মেন্টাল মেকআপ হচ্ছিল না! এদিকে স্কুল; ছুটি নেওয়ার কোনও উপায়ই নেই!
একবার “শাপলা”-য় গিয়ে ক্যানভাসটা ঠিকঠাক দেখে নিচ্ছে, আবার ভালো করে ঢেকে দিচ্ছে। অদ্ভুত একটা শিশু যেন ওর সমগ্রজুড়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে! ‘শাপলা’ ওর ছবিঘর। ওর নিজের এক দুনিয়া। ওর সমস্ত সলিলোকি সেখানে জমা থাকে। থাকে শ্বাসের চলাচল। রঙের সানাই আনমনে ফুসফুসকে উজাড় করে হাওয়া নিংড়ে দেয় সেখানে, আর স্বচ্ছতোয়া অবিকল নাচ হয়ে ওঠে! সরস্বতীরঙের শাড়িতে ও সাক্ষাৎ ‘দেবী’ হয়ে ওঠে! ওখানে ডায়েরি ডানা পায় কেবল! ভাঁজ-ভাঁজ চুল যখন ওর নরম মুখটাকে আরও নরম করে তোলে, তখন ওর খুব মনে পড়ে প্রথম সূর্যের কথা। মায়ের কথা। বারবার মনে পড়ে সেসব। নীচে মামমাম বারবার খেতে ডাকছে। কোনওরকমে নাকেমুখে দিয়ে বেরিয়ে গেল স্বচ্ছতোয়া।
সমুদ্রনীলে স্বচ্ছতোয়া আজ সত্যিই ভারী উজ্জ্বল! অপেক্ষার ত্বকে শীতলাগার আগেই যে তাকে যেতে হবে স্টেশনে!
কথায়-কথায় ভুলেই যায় ডায়েরির কথা। তখনকারটা তখনই ডায়েরিতে লিখে রাখা স্বচ্ছতোয়ার বরাবরের অভ্যেস। রাত যখন কালোর গায়ে আরও কালি ঢালছে; ঠিক তখন, সময়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই ম্যাম ডায়েরি খুলে লিখে রাখেন যাবতীয় স্নানগান, রূপকথা, ফ্যান্টাসি আর হিলহিলে সাপের মতো বাস্তব, শৃঙ্গারের শ্লোক, ঘিনঘিনে পোকা কিলবিল করা ডাস্টবিন থেকে অপ্রকৃতিস্থ চিহ্নহীন মানুষের হামলে পড়ে খাবার খোঁজ; চোখ ঝুঁকে যাওয়া দৃশ্য…সব-সব-সব!
ওই ডায়েরিতেই লুকোনো ছিল লাবণ্যর অস্ফুট সদ্য কৈশোর। ছিল বিছানাবদলের সূক্ষ্ম-সুবিধাবাদ। কোথাও কারও কোনও আপত্তি নেই। শুধু পলক না-পড়া লাবণ্যর যুবতি চোখের বিস্ময়! চামড়ার যুদ্ধে আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে বাঁচাতে চায় তাদের জন্মঅহংকার!
সাবালক হয় ডায়েরির পাতা। স্বচ্ছতোয়া বয়ে চলে খেয়ালে। এমনই ও। হঠাৎ নজর কাড়ে স্রোতস্বিনীদির ফ্যাকাশে মুখ। আসলে, টিফিন-ব্রেকে ওরা ইউটিউবে একটা মুভি দেখছিল। সেখানে একা থাকা বাবার একটা সিন আসতেই কেমন একটা চুপ হয়ে গেল স্রোতস্বিনীদি!
এবারে দেবীদি। তখন থার্ড ইয়ার। কলেজ যায়নি। বাড়ির চারপাশে ঘিরে আছে প্রচুর গাছ। মাঝে উঠোন। পাশেই কুয়োপাড়। উত্তরের জানলা। তাকালেই দেবীদি নস্টালজিক হয়ে পড়ে। সহজপাঠ। অপলকে দেখত পাশের প্রাইমারি স্কুল। জানলা তো নয়, যেন মিনিদরজা! শুনসান বাড়ি। একা দেবীদি। জানলা থেকে ভেসে আসে সোহাগ মাস্টারমশাইয়ের বাক্যরচনার লাইন। শব্দটা ছিল ‘মহাজন’। আর উচ্চারিত বাক্যটি হল – “মহাজন চড়া সুদে টাকা ধার দেন।’’ এরপর থেকে আর কখনও সোহাগ মাস্টারমশাইয়ের আওয়াজ কেউ কখনও শোনেনি। সবে কুয়োয় বালতি নামছে, পরপর বিকট আওয়াজ! সর্বস্ব দিয়ে একদৌড়ে দেবীদি ছুটে যায় জানলার দিকে। অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছিল দুজন লোককে। এই যে পরিণতি, ভাবতেই পারেনি! থরথর করে কাঁপছিল দু’পা! ওর মধ্যেই কে যেন এসে বালিশ চাইতেই, আগুপিছু না ভেবে দেবীদি বের করে দেয় বালিশ। ঘিলু বেরোনো সোহাগ মাস্টারমশাইয়ের জবজবে রক্তেভেজা মাথা! ঠ্যালাগাড়িতে সোহাগ মাস্টারমশাই আর তাঁর নীরবপাঠ! চোখের সামনে রাজনৈতিক উত্তালের শিকার হতে দেখল নিজের ছোটবেলার প্রিয় শিক্ষককে! ভয়ংকর এই ঘটনার আকস্মিকতা না নিতে পেরে মাস্টারমশাইয়ের বড় মেয়ে চিরকালের মতো বাকশক্তি হারায়। তার ঠিক এক মাস পরেই ছোট মেয়েও পরপারে! অদৃষ্টের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! সোহাগ মাস্টারমশাইকে প্রথম গুলি ছুঁতে পারেনি, বিপদের সংকেত পেয়ে মুরগিরা যেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে, ঠিক সেভাবেই ক্লাস টু ত্রাহি চিৎকার করে সমস্বরে! সোহাগ মাস্টারমশাইয়ের আগেই গুলিতে জখম ক্লাস টু-এর রোশনি! রোশনি নিভে গেল। এমন রসিকতা ঈশ্বর করেন কেন!
এই জেনারেশনের হয়েও স্বচ্ছতোয়া আজও কোনও সোশ্যাল সাইটে নিজেকে রাখেনি। শুধু ছবি-পড়া-লেখা আর দ্যাখাটুকু নিয়েই ওর আস্তজীবন। শুধুমাত্র এসএমএস বা ফোন। এই দিয়েই স্বচ্ছতোয়া দূরকে দূরে রাখে, নিজেকেও..
আজ, ব্রহ্মপুত্র আসবে। স্বচ্ছতোয়ার জন্মদিনে স্বচ্ছতোয়ার সেরা উপহার নিয়ে!
কথায়-কথায় স্রোতস্বিনীদিকে জিজ্ঞেস করল-
—আচ্ছা, আমার বন্ধু আসবে । প্রথম দেখা হবে। এই আউটফিটটা চলবে গো?
—- প্রথম?
—- কিছু না গো…
ওদের দুজনের কথায় ফোড়ন কেটে রিয়া বলে…
—-একজনের সঙ্গে রং নাম্বারে ওর রাইট কানেকশন হয়ে যায়। সেই বন্ধুবর আজ আসছেন। আর মাননীয়া যাবেন তাঁকে রিসিভ করতে, বুঝলে?
কথা শেষ হতে-না-হতেই ব্রহ্মপুত্রের ফোন। এর মধ্যেই স্রোতস্বিনী ওই শাড়িটার কথা কখনও শুনেছিল ওরই মুখে। এবারে দুইয়ে দুইয়ে মেলাতে অসুবিধে হল না।
বলল,
— শোন-না, তুই একটু আগে বলছিলি যে কী পরবি, আমার মনে হয়, তুই ওর দেওয়া সেই নীলপাখিটার শাড়িটাই পরিস। তোর বন্ধুর এক্কেবারে দিলখুশ হয়ে যাবে!
এরমধ্যেই রিয়া খুব খুশি-খুশি বলে ওঠে—
—- আচ্ছা স্বচ্ছতোয়া, কী করে তোরা একে-অপরকে চিনবি? চিনতে পারবি তো?
স্বচ্ছতোয়া বলে, আমি দেখতে চাই যে, সত্যিই সবকিছুর সাহায্য ছাড়াই আমরা একে-অপরকে চিনে নিতে পারি কি না। শুধু একটাই ক্লু, আমি নীল পরব। আর ব্রহ্মপুত্র খুঁজে নেবে আমায়। ব্যাস…
চিলতে হাসিতে বাঁকা ভ্রূ যেন কৌশল খুলে রেখে আইভরি-ভরসা বিছিয়ে দিয়েছে স্বচ্ছতোয়ার কপালে।
সাগরিকাদির সদ্য শেখা সেলফির বাড়িয়ে দেওয়া হাত; লেন্স জানে কাঁপা হাতেদের কথা…
মিড-ডে মিলের চারুলতাদির দিকে আগের মতো আর তাকাতে পারে না স্বচ্ছতোয়া। কিশোরদা চলে যাবার পর সব যেন কেমন! দেখলে মনে হত, এই-ই তো প্রেম! সব সম্পর্কের কি শিরোনাম দিতেই হয়! ভাসুক না চারুলতাদির যত্ন কাগজের নৌকোয়, যে জলে একদিন সে হারিয়েছিল তার শিশুকন্যা, সে জলে! কিশোরদা নেই প্রায় বছর তিন। চারুলতাদি সিঁদুর পরে। উজ্জ্বল লাল। ওঁর স্বামী ফিরে এসেছেন। আজও কিশোরদার পরিবার আগলে চারুলতা। বিশ্বাসের রং লাল, কমলা না নীল জানা নেই। তবে, শপথের রং প্রেমের রং সমর্পণের রং লাল; সন্ন্যাসিনী আর জলদস্যুর আদরের পর নদী যে লালে ভেসে যায়, তেমনই …
সবক’টা অক্ষর পা দুলিয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে। কেউ কেউ প্ল্যানচেটে, কেউ কেউ দীর্ঘ ইনসমনিয়ার পর উচ্ছন্ন শরীরে, অলৌকিক নদীর ডুবজলে; ওয়াক্সড পায়ে ব্র্যান্ডেড হাইহিলে…
সব তোলা আছে। আজও কেন ওর ক্যামেরা শুধু লাশেদের ছবি ছাড়া আর কারও ছবি তোলে না, সেসব আছে।
বাবিনকে ফোন করে স্বচ্ছতোয়া। হাতে আর ঘণ্টা দুয়েক সময়মাত্র। খুব ঘামছে। অবশেষে বাড়ি। বাবিন একগাদা ফুল আর বেলুনে সাজিয়েছে বাড়ি। মেয়ে তো দেখেই খুশিতে পাগল!
এরপর, লাঞ্চ টেবিল দেখে মেয়ের চক্ষু চড়কগাছ! কী নেই! পঞ্চব্যঞ্জন ছাড়িয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম, দশম ব্লা-ব্লা-ব্লা!
মেয়ের পক্ষ নিয়ে বাবা মেয়ের খাবারের দারুণ এডিটিং করেন!
বাঁকা সুরে বাগেশ্রী বলে ওঠে—
—— সবেতেই জোট না বাঁধলে দেখছি বাবুর শান্তি নেই!
বেশ হেসে-হেসে অন্ত্যমিল বলেন—
—–জোট তো আছেই। অস্বীকার করে কী লাভ। তবে আমরা অপোজিশনকে বেশ সম্মান-টম্মান দিই বুঝলে, গিন্নি!
ততক্ষণে স্বচ্ছতোয়া ফোনে জেনে নেয় ব্রহ্মপুত্র ঠিক কোন জায়গায় এখন। স্টেশনে ঢুকতে আরও প্রায় ঘণ্টা দেড়েক তো হবেই। ততক্ষণে আবার ডায়েরিতে মন দেয়। ওর বেগুনি কালি লিখে চলেছে পাশের বাড়ির বিন্দিয়ার হাসি-কান্নার যুগলবন্দি…এক্কাদোক্কা, ইচিং-বিচিং , স্কুল ব্যাগ, বার্বিডলের পিংক পেন্সিলবক্স… হ্যানা-মন-টায়নার মনোযোগ সব… সব!
হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই টনক নড়ে ম্যামের। এখনও কত কী বাকি! রাসুদিই ওকে পরিয়ে দেবে ওই নীল অ্যাপ্লিক করা পাখির শাড়িটা। ডানা দুটোয় কী চমৎকার মধুবনী কারুকাজ! কতবার যে ও শাড়িটাকে বুকে নিয়ে জড়িয়ে চুমু খেল! ভালোবাসার একটা আলাদা গন্ধ থাকে। রাসুদি, পলিদি সবাই এসে গেছে। জলিদি হেয়ারসেট করবে। চোখটা নিজেই সাজাবে স্বচ্ছতোয়া। শুধু স্রোতস্বিনীদির দেওয়া নীল বড় টিপ।
আরতিদি, অর্চনাদি, জলিদি, মিলি আর নূপুরও এসেছে। এপাড়ায় প্রতিবেশীদের মধ্যে এক অসম্ভব সুন্দর সম্পর্ক! ছবিঘরটাও পাল্লা দিয়ে সেজে ওঠে। নূপুর এলেই ‘শাপলা’-র প্রিয় রঙমহলে একবার ঢুকবেই! ভেসে আসছেন নির্মলা মিশ্র… ‘‘কে জানে কোথায় কবে কোন ভূমিকায়… জীবনের সাজঘর কাকে কে সাজায়…”
হঠাৎ ওর চোখ যায় ডায়েরিটার দিকে। খোলা পাতা। খুব পরিচিত কয়েকটি বাক্য নজরে আসে। ওর চেনাও একজন যেন শুয়ে আছে রিকেট রোগীর মতো, পেটটা ফুলে ঢোল; পাশের বাড়ির উঠোনে সুপুরি কুড়োতে কুড়োতে যেদিন জেসমিন খালেদচাচার ছোড়া বোমে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল, সেদিনের কিশোরী জেসমিনের মতোই অক্ষরগুলো ছিন্নভিন্ন ছিল…চুপ না থাকাই ছিল তার অপরাধ। যদিও রাজরং ঢেলে সাজানো হয়েছিল। নকশাল মুভমেন্টের কথা বাবার কাছে অনেকবার শুনেছে নূপুর। প্রতিবারই অন্য এক মশাল দেখেছে বাবার চোখে! এসব অক্ষর এখানে কেন! কেন স্বচ্ছতোয়া এমন সব অনাহারী বর্ণমালাকে জড়িয়ে রেখেছে! পরের পাতায় একটাই শাপলা, মহারানির মতো হাত-পা ছড়িয়ে… কিছু ব্লিডিং-হার্ট, গোলাপ-পাপড়ি কাগজের ভাঁজে-ভাঁজে…
সমস্ত নীরবতা ঝনঝন করে ভেঙে দিল বাগেশ্রী।
নীলপাখি জড়ানো শাড়িতে স্বচ্ছতোয়াকে অসামান্য লাগছে! পালসটা কিন্তু বেশ হাই মনে হচ্ছে ওর! বেরিয়ে পড়ে স্বচ্ছতোয়া। কত কী-ই যে ভাবছে ‘কী জানি কী হয়’!
আনমনেই হেসে ফেলে! গাড়ি থামে আলুয়াবাড়ি স্টেশনে। নিজেকে যেন অবিরত কম্পোজ করতে থাকে স্বচ্ছতোয়া! সারা প্ল্যাটফর্মজুড়ে অসংখ্য নীলপাখি ওর পাড়-কুচি-ইয়ক-আঁচল থেকে উড়তে থাকে; স্টেশন চত্বর ঘিরে ফেলে নীলপাখির ঝাঁক! দার্জিলিং মেল রাজগতিতে এগিয়ে যায় এনজেপি-র দিকে। কোনওরকমে প্ল্যাটফর্মের একটা পিলারে হেলান দিয়ে ওই সাড়ে চার ফুটের পোলিও আক্রান্ত মেয়েটি অপেক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকে। বড়জোর জনা দশ-বারো প্যাসেঞ্জার নেমেছিল। কারও চোখে কি ওই এক ঝাঁক নীলপাখি চোখে পড়ল না একটিবারও? নাকি, ওই পাখিগুলোই ব্রহ্মপুত্রকে এই পোলিও আক্রান্ত অসাড় পায়ের বিকলাঙ্গ মেয়েটির থেকে বাঁচিয়ে দিল?
ব্যাগ থেকে ওয়ান-স্টেপ-ওয়ান গালে লাগিয়ে, চোখে নীল কাজল বুলিয়ে নিল স্বচ্ছতোয়া। ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি… নিজেকেই নিজেকে এসএমএস করে। ড্রাফটে জমা হয় সেসব।
ড্রাইভার দাদা বললে—
—- দিদিমণি, এই ট্রেনেই কি আসার কথা ছিল দাদাবাবুর?
নিজেকে সামলে হাসিমুখে বলল—
—– না গো, রাজীবদা, আমারই ভুল। এই ট্রেনে নয়, অন্য ট্রেনে আসছিল কিন্তু হঠাৎ অফিস থেকে জরুরি তলব। অগত্যা, মালদা স্টেশন থেকে দাদাবাবুকে ফিরে যেতে হচ্ছে! মস্ত পদে কাজ করেন তো! ইসস! আমারই ভুল, একে তো ভুল ট্রেন শুনেছি, তার ওপর কত আগেই চলে এসেছি! এই দ্যাখো না, কতবার আমাকে ফোন-মেসেজ করেছে! ফোনটা সাইলেন্ট মোডে কীভাবে যে হয়ে গিয়েছিল!
রাজীবদার গলার ভেতরটা শুকিয়ে যায়। একটি কথাও বেরোয় না। শুধু চোখ লেগে থাকে মাটির দিকে। এরপর, অনেকগুলো ট্রেন এল-গেল… ফোনের চার্জও শেষ… পার্পল লিপিস্টিকটা ঠোঁটে বুলিয়ে রাজীবদাকে বলল—
—- আমার হাতটা একটু ধরো না গো! পা-টা কী ভারী হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি চলো রাজীবদা; মামমাম-বাবিন খুব চিন্তা করছে! দ্যাখো, ডায়েরিটা আনতেও ভুলে গেছি! এতক্ষণ আমার আরও কমপক্ষে ছ’শো থেকে সাতশো শব্দ লেখা হয়ে যেত। আমার উপন্যাসের শেষের আটচল্লিশ পাতা থেকে ইউটার্ন-এ এসে আরও-একটিবার স্বচ্ছতোয়ার সঙ্গে মহাশূন্যে দু’হাত ছড়িয়ে সকলে মিলে বলত, ‘হেমলক কণ্ঠে থাক, অশ্রুতে নয়…’
কে যেন ডায়েরির পাতায় খুব দ্রুত লিখেই চলেছে — “একটিবারও নিজের কিনে দেওয়া নীলপাখির শাড়ি, নীলটিপ দেখেও আমায় চেনেনি, এও কি সম্ভব!”
ক্যালিগ্রাফি ফুঁড়ে অক্ষর থেকে বেরিয়ে আসছে রক্তাক্ত ভ্রূণ। দূষিত রক্তের গন্ধে তীব্র গুলিয়ে যাচ্ছে গা! মাস্টারমশাই, যিনি কিনা জেঠুর বন্ধু, তিনি ভালোবেসে বছর চোদ্দোর মেয়েটিকে এই উপহার দিয়েছেন! গর্ভহত্যা করাতে গিয়ে মেয়েটি সারাজীবনের মতো বাকশক্তি হারিয়েছে। কাউকে সেভাবে চিনতেও পারে না আর। আর স্কুলে যায় না সে।
এখনও তেমন কেউ আসেনি বাড়িতে। ঢুকতে-ঢুকতেই বাগেশ্রী বলে——- ব্রহ্মপুত্র কোথায়?
স্বচ্ছতোয়া চুপ। রঙিন বেলুনের সুতো ঝুলছে শুধু।
মামমামের চোখে চোখ রাখতে পারছে না স্বচ্ছতোয়া। শাওয়ারে ভিজছে এভাবেই সাতাশটা জন্মদিন…
রাক্ষসের মতো যা পেয়েছে, সব খেয়েছে স্বচ্ছতোয়া! রাজীবদা একটা দানাও খায়নি।
কার্ভস্ক্রিন ‘ল্যাবরেটরি’-র স্বপ্নমদির নেশায় মাখা। সোসাইটির বিবর্তন। কত ধাপ! কেউ কারও দিকে তাকাতে পারছে না ওরা। বাবিন শোয়ার পর স্বচ্ছতোয়া মায়ের পেটের ভিতর গুটিশুটি হয়ে শুয়ে, নেভা আলোয় মায়ের দু’হাত দিয়ে নিজের চোখ আর ওর হাত দিয়ে মায়ের চোখ মোছাতে থাকে…
রাত দুটো প্রায়। এখনও তিনশো শব্দের জন্য সাড়ে তিনশো গুণ সাড়ে তিনহাত মাটি খুঁজতে হবে। পৌনে চারশো কোটি জন্মান্তরকে পিরের দরগায় লাল-কালো সুতোতে বেঁধে আসতে হবে। লালনসাঁই, শাহ আবদুল করিম সাহেবের পাণ্ডুলিপি খুঁজে আনবে একঝাঁক নীলপাখি। গলা ছেড়ে গাইবে ক্যালিগ্রাফি…
ছবিঘর জুড়ে শাপলাবন! অসংখ্য পাপড়ির সমবেত ঘুমমুদ্রা, সঙ্গে মা-মেয়ের দুটো ঘুমন্ত মুখ; ক্রমশ হয়ে উঠছে গোলাপিনক্ষত্র, আর তা থেকে কী নিবিড়ে উপচে পড়ছে প্রিয়তম উচ্চারণ…
—‘‘যে দুঃখ পায়নি, সে বড়ো দুখি…’’