- মৌমিতা আলম
ফ্যাকাশে চোখ, হলদেটে হাতের তালু আর ছয় মাস বা তারও বেশি সময় ধরে না পরা জামার মধ্যে ছোট ছোট ছোপ ছোপ কালো দাগ।
এতদিন কই ছিলি!
দিদিমণি হামি আবার এই ক্লাসে ভর্তি হইছি।
আরে সেটা বুঝলাম কিন্তু এতদিন কই ছিলি!
‘হামি ভাটায় গেছিলাম, আব্বুর নগদ!’
বুঝতে বাকি রইল না। নভেম্বরের দিকে শুরু হয় ইটভাটাগুলোর কাজ। আর জুলাই মাসে বৃষ্টি শুরু হলে কাজ বন্ধ থাকে। আবার শুরু শীতকালে।
পাশে দাঁড়িয়ে আমিনা।
‘হামিও গেছিলাম দিদিমণি। হামি আর যামু না। আম্মুর প্যাট বাড়ছে।’
‘কয় ভাই বোন তোরা?’-
‘দুইজন আছে আরও হইব!’
তোরা দুজন একসাথে গিয়েছিলি?
‘হা দিদিমণি, মাস্টার (ইট ভাটায় শ্রমিক নিয়ে যায় যে ঠিকাদার) গাড়ি পাঠাইছিল, বড্ড বাস।’
কী বলব এঁদের পরিযায়ী শ্রমিক নাকি পরিযায়ী ছাত্র। নাকি দুটোই? শব্দের বাইরের অন্ধকারে কিছু মানুষ বাস করে যাঁদের পোশাকি নাম নিয়ে মাথাব্যথা নেই। ব্যথা আছে পেট নিয়ে।
‘ভুগ নাগিলে প্যাট বিষায় দিদিমণি।’
আর এই প্যাটের বিষের জন্য শুধুই ছুটে চলা। কখনও কেরালা, কখনও বিহারের ইট ভাটা, কখনও দিল্লি, কখনও মায়ানগরী মুম্বই। গৌহাটি-ত্রিবান্দ্রাম কিংবা গৌহাটি-হায়দরাবাদ কিংবা ব্রহ্মপুত্র মেল- এই ট্রেনগুলোর জেনারেল ডাব্বাগুলোর গন্ধ এক- মা ছেড়ে আসা, নিজের গ্রাম ফেলে আসা, বিষাদ বিষাদ গন্ধ। আর সেই গন্ধের সঙ্গে জুড়ে থাকে সরকারের উদাসীনতার গন্ধ। কোনওরকম সুবিধেটুকু না পাওয়ার গন্ধ। দিদিমণির ক্লাসের অনেকদিন পর ফিরে আসা মেয়ে দুটোর নাক, মুখ, ছুঁয়েও যেন আছে সেরকম এক ভাপধরা খিদের গন্ধ। ফিরে আসা লিখলাম, কিন্তু এটা কি সত্যিই ফিরে আসা নাকি আবার ফিরে যাওয়ার আগে একটু দাঁড়ানো। সে দাঁড়ানো মিড-ডে মিল নামক ভাতের খোঁজে কিংবা কন্যাশ্রী নামক আশার এক ঝলক। যে ঝলকে অন্ধকার কাটে না বরং কতখানি গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত তা এই ক্ষণিক আলো যেন ভেংচি কেটে তা বলে যায়। দিদিমণি জিজ্ঞেস করলেন কীরে এবিসি কিছু মনে আছে! একজন চুপ করে শূন্য গুনতে লাগল দেওয়ালে আর আরেকজন বলল, ‘এইকটু এইকটু আছে।’
তা ভাটায় গিয়ে তোরা কী করছিলি!
‘ইট ওলটাচ্ছিলাম দিদিমণি! আর ছুটো বহিনটাকে দেইখছিলাম!’
দিদিমণির আর সাহস হয় না মেয়েটির হাতের দিকে তাকাতে! কী বলবে দিদিমণি, বলবে ভাটায় যাস না আর! বলবে বাড়িতে থাক। খিদের প্রশ্নে শ্রেণির উপরের দিকে থাকা মানুষদের প্রশ্ন বড্ড কানে বাজে, বড্ড উদাসীন সে প্রশ্ন। খিদের সমীকরণ স্পষ্ট। শিক্ষা যেখানে বেশ পেছনের সারির বিষয়বস্তু। ভাটায় না কাজ করলে খাবে কি! আর বাচ্চাদের সঙ্গে না নিয়ে গেলে বাবা-মা বাচ্চাদের রাখবে কোথায়!
মুর্শিদাবাদ থেকে কোচবিহার এই ছবি সর্বত্র। বেশিরভাগ অভিভাবক-শিক্ষকদের মিটিংয়ে আসে নানি, দাদি, দাদু। বাপ-মা কাজ করতে গেছে, রেখে গেছে দাদু, কিংবা নানা-নানির কাছে। প্রত্যন্ত গ্রামের মাদ্রাসা ও স্কুলগুলোতে একই ছবি।
ফুলমতি হঠাৎ দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে! গত বছর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল ফুলমতি! সোজা তিনটে ক্লাস জাম্প মেরে সে এখন পঞ্চমে! কী ব্যাপার ফুলমতি, তোর তো দারুণ উন্নতি! ফুলমতি জানাল তাঁর এই উন্নতি না দুর্গতি তার কাহানি! সে নানির কাছে ছিল, তার নানি তাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে। কিন্তু এখন ভর্তির পোর্টাল-এর মাধ্যমে ভর্তি। আর ছাত্রদের বয়স অনুপাতে ক্লাস নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। তার বয়স অনুপাতে এবার দিল্লি থেকে ফেরার পর তাকে সোজা পঞ্চম শ্রেণিতে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফুলমতি ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। দিদিমণির পড়ানো আর তাঁর জীবন কাটাকুটি খেলে তাঁর ছোট দুই চোখে। সে চোখের শূন্যতা মাপার সাধ্য দিদিমণির নেই। তাঁর বইয়ের তিন নম্বর অধ্যায়ের ফুলমণির ভারত, পড়াতে গেলে ফুলমতি মন দিয়ে শোনে। নামটা তাঁর চেনা চেনা লাগে।
‘আবার তো দিল্লি যামু দিদিমণি। আপন মনে বলে ওঠে ফুলমতি।’
তুই থেকে যাস ফুলমতি।
‘নানি যে আর হামায় রাখুম না!’
দিদিমণি আর কি বলে?
ফুলমতি, আমিনা, আবদুল্লাহ, কিংবা যে মেয়েটি ভর্তি হতে চেয়েও ভর্তি হতে পারল না যার বয়স এখন ১৬। স্কুলে পড়েছিল নাকি দিল্লিতে কিন্তু কোনও কাগজ নেই। বাংলা অক্ষর অল্প অল্প পারে! এঁরা প্রথাগত ড্রপ আউট নয়। এঁরা অদ্ভুত এক আছে অথচ নাই-এর ধাঁধা যে ধাঁধা গোটা ভারতজুড়ে বিল্ডিং বানায় বাবুদের জন্য। ধাঁধার মইয়ে পিছলে পড়েও যায় কুড়ি তলা থেকে। যাঁরা ইতিমধ্যেই শব্দের নাম থেকে ভ্যানিশ তাঁদের খোঁজে কে? কোমরে দড়ি বাঁশের সঙ্গে বেঁধে উঁচু বিল্ডিং রংও করে। মসৃণ, রামধনু রং। দিনশেষে ফিরে আসে ঘরে, যে ঘরে জানালা নেই, শুধু দরজা আছে অর্থাৎ ঢুকতে বা বেরোনোর নিশ্চয়তা। সেই বেরোনো-জীবন অথবা মৃত্যু যা কিছু হতে পারে। কী যায় আসে তাতে?
আমিনা, আবদুল্লাহ, ফুলমতির ও কিছু যায় আসে না, তবুও স্কুল বেলের আওয়াজে ‘মন খারাপ নাগে!’ মন খারাপের হিসেব কে রাখে এই দেশে! আমিনা, আবদুল্লাহ, ফুলমতি জুড়বে অনেকের সঙ্গে এক ভিড়ের মুখ হয়ে। বই খাতা, পড়াশোনা সব ফেলে। এবিসি আর ক, খ, গ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে ভিনদেশে পাড়ি দেবে, ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কাজ খুঁজবে…কাম মিলেগা সাহেব কাম। তারপর হয়তো ক্ষণিকের জন্য ফিরে আসবে বা আসবে না। যেমন সেই শ্রমিকগুলো অমানবিক লকডাউনের সময় ট্রেনে কাটা পড়ে নাই হয়ে ফিরতে পারেনি আজও। তবুও কবির টুকরো শব্দে ভেসে ওঠে এদের জীবন। তাই এক কবি লিখেছেন করোনাকালে, পরিযায়ী শ্রমিক ধর্মবীর-এর মৃত্যুতে। যে ধর্মবীর দু’মুঠো ভাতের স্বপ্নে শহরে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেননি। অথচ করোনার সময় কোভিড হাসপাতালে পুষ্পবৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কবি লিখছেন:
হঠাৎ বারোশো কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার পর
তার সাদা ভাত খাওয়ার স্বপ্ন কেমন যেন ধূসর হয়ে আসে।
সে আকাশের দিকে তাকায়
ঈশ্বরের আশীর্বাদের জন্য নয়
মাথার ওপর ধেয়ে আসা হেলিকপ্টার-এর শব্দের জন্য।
তার ক্ষুধার্ত চোখে সে দেখে
আকাশ থেকে সাদা ভাত পড়ছে যেন
সে এক মুঠো সাদা ভাতের জন্য হাঁ করে।
কিন্তু একটি ফুলের পাপড়ি
তাঁর ঠোঁট ছুঁয়ে যায়।
সাদা ভাতের স্বপ্ন ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে।
সে শেষবারের মতন সাইকেল থেকে পড়ে যায়।
হায় রে এই দুর্ভাগা দেশ
ফুলের পাপড়ির থেকেও ভাত মহার্ঘ এ দেশে!
(কবিতাটি The Musings of the Darkish কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। কবিতাটি অনুবাদ করেছেন প্রাবন্ধিক নিজেই)