এই নামে যাঁকে ডাকা হত, রাজোরি এবং পুঞ্জের বহু আতঙ্কবাদীর এনকাউন্টার করেছেন তিনি– ‘টাইগ্রেস অফ জম্মু-কাশ্মীর’। চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের জোরে নয়ের দশকে ভারতীয় পুলিশে এনেছিলেন নতুন ধারণা ও ধারা। সেই অফিসারের নাম– শাহিদা পারভিন গাঙ্গুলি। মৃত্যুভয় তাঁকে কখনও গ্রাস করতে পারেনি। লিখছেন অনুভা নাথ।
‘খুব লড়ি মরদানি ও তো ঝঁাসিওয়ালি রানি থি’– কবি সুভদ্রা কুমারী চৌহান ১৮৫৭ সালে এই কবিতা ‘ঝঁাসির রানি’ লক্ষ্মীবাইয়ের শৌর্য ও সাহসিকতার জন্য লিখেছিলেন। আমাদের দেশ বীরাঙ্গনাদের দেশ। সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডর ব্যোমিকা সিং ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং পুরো দেশের সামনে ওই অপারেশনের ব্রিফিং করেছেন।
এই মুহূর্তে দেশ এই দু’জন মহিলা অফিসারকে নিয়ে গর্বিত, আলোচনায় ব্যস্ত। সেই সূত্রে বলব এমনই আর-একজন বীরাঙ্গনা পুলিশ অফিসারের কথা, যিনি শুধুমাত্র নিজের চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের জোরে নয়ের দশকে ভারতীয় পুলিশে ‘লেডি এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’-এর তকমা পেয়েছিলেন– শাহিদা পারভিন গাঙ্গুলি। ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মানসচক্ষে পেশিবহুল পুরুষের মুখ ভেসে ওঠে। শাহিদা ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের প্রথম মহিলা আইপিএস অফিসার তথা ‘স্পেশাল অপারেশনস গ্রুপ’-এর (S.O.G.) প্রথম মহিলা কমান্ডো। তঁার জীবনের শুরুটা কিন্তু ছিল কঁাটায় ভরা। উনি পাকিস্তান বর্ডারের জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্জের ছোট্ট একটি গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। মাত্র চার বছর বয়সে বাবাকে হারান। শৈশবে তঁার পাঠ্যপুস্তক কেনার মতো পয়সাও থাকত না। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কাশ্মীরি মেয়েটি তঁার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন স্কুলের শিক্ষকতা দিয়ে। কিন্তু বিধাতা এই মেয়ের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন ছকভাঙা জীবন।
পরবর্তীতে জম্মু-কাশ্মীরের সাব-ইনস্পেক্টরের চাকরিতে যোগ দেন শাহিদা। তারপর অদমনীয় জেদ আর সাহসের সঙ্গে পার করেছেন স্কুলটিচার থেকে আইপিএস অফিসার হওয়ার সুদূর যাত্রাপথ। পঁাচ বছর ধরে রাজোরি ও পুঞ্জের বহু আতঙ্কবাদীর এনকাউন্টার করেছেন। তঁাকে বলা হয় ‘টাইগ্রেস অফ জম্মু-কাশ্মীর’। একটি ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন, এনকাউন্টারে যোগ দেওয়ার প্রথম দিকে তঁার সহকর্মী পুরুষরা তঁাকে অভয় দিয়ে বলতেন, ‘তুমি শুধু খবর সংগ্রহ করে আনো, তোমার কোনও ভয় নেই, তোমাকে অপারেশন ফিল্ডে যেতে হবে না।’ কিন্তু শাহিদা বঁাচতে চেয়েছিলেন নিজের শর্তে। উনি ইনফরমেশন জোগাড় করেছিলেন এবং ঠিক করেছিলেন যে, এটা উনি সিনিয়রদের দেবেন না। নিজেই এনকাউন্টারে যাবেন।
উনি বলেছিলেন, “যে-ইনফরমেশনের জন্য আমি দু’-তিন মাস কাজ করেছিলাম, সেই ইনফরমেশন অন্য একজনকে কেন দেব? আমি নিজেই এনকাউন্টারে যাব।” কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তঁার প্রথম এনকাউন্টার অসফল হয়। তঁার ডিপার্টমেন্টে ওঠে চূড়ান্ত সমালোচনার ঝড়। একজন সিনিয়র অফিসার তঁাকে বলেন, এনকাউন্টারের কাজ মহিলাদের জন্য নয়। মহিলাদের আসল কাজ হল, বাড়ির কাজ করা, আর বাসন মাজা। শাহিদা বলছেন তখন তিনি নিজের কাছে নিজে কথা দিয়েছিলেন যে, উনি শুধুমাত্র এই সিনিয়র পুরুষ অফিসারটিকে নয়, এই রাজ্যকে নয়, সারা পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবেন– এই বাসন মাজা হাত দুটো কী করতে পারে!
কাজ করতে গিয়ে কখনও মৃত্যুভয় তঁাকে গ্রাস করতে পারেনি। এনকাউন্টারের সময় তিনি তঁার এ. কে. ফর্টি সেভেনের সঙ্গে একটি পিস্তল রাখতেন। যদি কখনও মনে হত, তিনি ধরা পড়ে যাবেন-বা একা, তাহলে সেই পিস্তলটি দিয়ে তিনি নিজেই নিজের জীবন হনন করবেন। প্রত্যেকবার জিপে করে এনকাউন্টারে যাওয়ার সময় তিনি তঁার ড্রাইভারকে বলতেন ‘গানা চালাও… ক্যা পতা ওয়াপস আ পাউ কি নহি!’
ব্রিগেডিয়ার গৌতম গাঙ্গুলির স্ত্রী ও দুই সন্তানের জননী শাহিদাকে ইউনিফর্ম ছাড়া দেখলে বাস্তবিকভাবেই যে কারওর ওঁকে ফুল দিতে ইচ্ছা করবে! ভাবলে অবাক হতে হয়, এই সুন্দরী, নম্র নারীর হাত শুধুমাত্র দক্ষ অস্ত্রচালনায় পটু নয়, তঁার জীবনদর্শন অভিভূত করেছে দেশবাসীকে। এই বীরাঙ্গনাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তঁার সমগ্র চাকরি জীবনে তিনি ক’টি এনকাউন্টার করেছেন?
তিনি মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন ‘সংখ্যাটা আমি গুনিনি। পঁাচ বছর এনকাউন্টারের কাজ করেছিলাম এবং প্রতিদিনই অন্তত একটি এনকাউন্টার হতই, এবার আপনারা সংখ্যাটা আন্দাজ করুন।’ আরবিতে শাহিদা নামের অর্থ হল ‘বাদশাহ’। তিনি বাস্তববিকই শৌর্য ও সাহসিকতার জীবন্ত প্রতিমূর্তি এবং তঁার বীরত্ব একমাত্র একজন যোদ্ধা বাদশাহর সঙ্গেই তুলনীয়।
(মতামত নিজস্ব)