গৌতম সরকার
অন্যায়, অপদার্থতা, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা… কোনও শব্দই যেন যথেষ্ট নয়। অনাচার চরমে না পৌঁছোলে কি মার খেতে হয় সমাজ গড়ার কারিগরদের! দিনের আলো নেভার পর রাজপথে মহিলা শিক্ষকদের টানাহ্যাঁচড়া কোনও সুশাসনের ছবি নয় কিন্তু। সরকারি বাহিনী বীরত্ব ফলিয়েছে মেরে মহিলা শিক্ষকের পা ভেঙে দিয়ে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ওই শিক্ষকের পথে গড়াগড়ির ছবিটা মানবতার ওপর নির্মম আঘাতের সাক্ষী।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা বিকাশ ভবনের গেটের তালা ভাঙছেন দেখে প্রথমে রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষা দপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া তো শিক্ষকসুলভ আচরণ নয়। শিক্ষকদের ওপর সামান্য আঘাতে সমাজের ব্যাথিত, ক্রুদ্ধ হওয়া উচিত। তবে শিক্ষকের মধ্যে নৈরাজ্যের ছায়া সমানভাবে হতাশাজনক, মানসিক কষ্টের কারণ।
কিন্তু চলুন তো ভেবে দেখি, কার পাপে শিক্ষকদের রাস্তায় দিন কাটাতে হচ্ছে দিনের পর দিন? কোন পাপে তাঁরা সরকারের, শাসকদলের লাথি, লাঠি বা ‘ওঁদের সরাতে ৩০ সেকেন্ড লাগবে’ গোছের ক্ষমতার আস্ফালন সইছেন? হে সরকার বাহাদুর, হে রাজ্যের আমজনতা, একবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, মানসিক অবস্থা কোন পর্যায়ে গেলে একদল মানুষ, যাঁরা সরকারের বয়ানে ‘যোগ্য’ শিক্ষক, তাঁরা এমন মারমুখী হয়ে ওঠেন?
ভবিষ্যতের সমস্ত রাস্তাই যে বন্ধ এই প্রায় ১৬ হাজার যোগ্য শিক্ষকের সামনে। যাঁরা কাউকে ঘুষ খাইয়ে নিয়োগপত্র কেনেননি। যাঁরা কোনও দাদা বা দিদির অনুগামী হওয়ার সুবাদে চাকরি বাগাননি। যাঁরা নিজের মেধার জোরে শিক্ষকতার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তিনি এঁদের পাশে আছেন। তাঁর ওপর ভরসা রাখতে বলেছেন। বলতে পারেন, ভরসা থাকবে কীভাবে! বলবেন প্লিজ, কোন পথটা খোলা রেখেছে সরকার।
আদালতের ন্যায়দণ্ড যোগ্য শিক্ষকদের মেধা, যোগ্যতার প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। মুড়িমুড়কি একদরের মতো অযোগ্য, টাকার বিনিময়ে চাকরি ক্রেতাদের সঙ্গে তাঁদের নিয়োগ বাতিল করে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে এই সুবিচার না পাওয়ার পাপ তো শিক্ষা দপ্তরের, স্কুল সার্ভিস কমিশনের। সর্বোপরি রাজ্য সরকারের। আদালতের সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করতে তারা ব্যর্থ হওয়ায় খারিজ হয়ে গিয়েছে সকলের চাকরি।
এক লহমায় যাঁদের জীবনে নিঃসীম অন্ধকার নেমে এসেছিল, হতাশায় তাঁদের মরিয়া হয়ে ওঠা তো স্বাভাবিকই। আন্দোলনের হকও তাঁদের স্বাভাবিক। আর যে কোনও পথ নেই তাঁদের। তবে নিশ্চয়ই জেলা পরিদর্শকের অফিসে আগুন লাগানোর হুমকি কিংবা শিক্ষা দপ্তরের তালা ভাঙা, দপ্তরের সমস্ত কর্মীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা আন্দোলনের সুষ্ঠু পথ নয়। একদা জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের জেরে রাজ্য থেকে বেশ কিছু শিল্পের পাততাড়ি গোটানোর উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে।
কিন্তু কিছু বাড়াবাড়ি হয়েছে বলেই সমাজে সম্মাননীয় পেশায় যুক্তদের লাঠিপেটা, লাথি মারাকে যুক্তিযুক্ত বলা যাবে না। কী ভীষণ অনিশ্চয়তাজনিত উদ্বেগ ও হতাশা থেকে মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা মারমুখী হয়ে ওঠেন, সংবেদনশীলতার সঙ্গে তা না বুঝলে তাকে সুশাসন বলা যায় না। নাগরিকদের সহৃদয়তার প্রতিফলনও নেই তাতে। সরকার চাকরিচ্যুতদের পাশে আছে বলছে। কিন্তু বলুন তো এ পর্যন্ত কী করেছে সরকার?
সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়ে যোগ্য শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়াতে পেরেছে। ব্যস, এটুকুই! তারপর…? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটা মনে করিয়ে দেয়… তার আর পর নেই/ নেই কোন ঠিকানা/ যা কিছু গিয়েছে থেমে/ যাক থেমে যাক না…। আদালতের নির্দেশে সরকারের করণীয় কিন্তু সামান্যই। ৩১ মে’র মধ্যে নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ। এবং চলতি বছরের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা।
চাকরিচ্যুতদের শিক্ষকতায় ফিরতে হলে সেই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করা ছাড়া উপায় নেই। তারপর নিয়ম মেনে পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার। কিন্তু নিযুক্ত হওয়ার জন্য মনোনীত হবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। যাঁরা আর মনোনীত হবেন না, তাঁদের সমস্ত পথ রুদ্ধ। ৯ বছরের শিক্ষকতার পর নতুন কোনও পেশার অনুসন্ধান কতটা কঠিন, ভুক্তভোগীরা জানেন। এই ৯ বছরে কেউ বিয়ে-থা করে সংসার বাড়িয়েছেন, কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন, গাড়ি-বাইক কিনেছেন। চাকরি না থাকলে ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংকের তাগাদার দুশ্চিন্তা এখনই তাঁদের রাতের ঘুম উড়িয়েছে। মাস গেলে মাইনে না পেলে বাড়িতে স্ত্রী, ছেলেমেয়ের মুখে দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করার অনিশ্চয়তাজনিত উদ্বেগে এই শিক্ষকদের মানসিক অস্থিরতা চরমে ওঠা স্বাভাবিক। শিক্ষকরা তো সংবেদনশীল মানুষ। আত্মমর্যাদার অধিকারী মানুষ। যাঁদের পক্ষে বালি-পাথর পাচার, জমির দালালি, মাদকের অবৈধ কারবার, জালিয়াতি-প্রতারণা ইত্যাদি অনৈতিক পথে রোজগার কখনোই সম্ভব নয়।
সুস্থ মানুষ গড়ার কারিগররা তাই এখন নিজেরাই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। সেই টানাপোড়েনে তাঁদের অনেকে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের ভাষার মতো অবস্থা তো শিক্ষকদের… পাহাড় নিষেধগুলো পেরিয়ে দেখি/ কি আছে আমার পথে পরে…।’ তাঁরা নতুন করে চাকরির আবেদন করতে নারাজ। একবার যোগ্যতা প্রমাণ করে ৯ বছর চাকরি করার পর ফের পরীক্ষায় বসে সীতার মতো নিজেদের শুদ্ধতা প্রমাণে অগ্নিপরীক্ষা দিতে তাঁদের ঘোরতর আপত্তি।
তাঁদের আপত্তি নিয়ে জট কম নয়। কেননা, আদালত সরকারের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। যোগ্য শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে চাকরি ফেরানোর কোনও পথ আদালত নির্দিষ্ট করে দেয়নি। আদালতের সম্মতি ছাড়া কোনও পথে গেলে আবার আইনি জটিলতার পাঁকে জড়িয়ে পড়ার বিপদ আছে সরকারের সামনে। কিন্তু শিক্ষা দপ্তর, স্কুল সার্ভিস কমিশন, শাসকদলের একাংশের পাপের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সরকারকে বিকল্প পথ তো খুঁজতেই হবে। নাহলে ভূপেন হাজারিকার ভাষায় বুঝতে হবে… দানব কখনও হয় না মানুষ।