গৌতম সরকার
মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা!
যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই- স্লোগানটাই মিথ্যা।
মুখে শুধু শান্তির বাগাড়ম্বর। আসলে পৃথিবী এখন শান্তি চায় না। যুদ্ধই চায়। আহমেদাবাদে বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় ২৫০ জনের মৃত্যুর পরদিন ভোরের আলো ফুটে উঠতে না উঠতে আঁতকে উঠলাম যুদ্ধের খবরে। কবি সুকান্তর কবিতার পংক্তির মতো অবশ্য বলা যাচ্ছে না, ‘এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্য…।’ এ যুদ্ধ ক্ষমতার জন্য, এ যুদ্ধে আছে বিশ্ব রাজনীতি।
গাজাকে ইতিমধ্যে ছারখার করে দিয়েছে ইজরায়েল। এবার নজরে ইরান। ইজরায়েলি হামলা ইরানের ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানীকে খতম করে দিয়েছে। এই যুদ্ধ তাই শুধু মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে নয়। এই যুদ্ধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। পারমাণবিক শক্তি ইরানের আছে। নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে পরমাণু গবেষণাও করছে। কিন্তু তার বিচারের অধিকার ইজরায়েলকে কেউ দেয়নি। কিন্তু বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধোন্মাদনা তৈরি করছেন দেশে নিজের ক্ষমতা নিশ্চিত রাখতে।
হামাস যে জঙ্গিগোষ্ঠী, ইসলামিক মৌলবাদী জেহাদের অংশ- তাতে সন্দেহ নেই। ইজরায়েলের নিরীহ জনতার ওপর হামাসের হামলা, যাকে-তাকে অপহরণ সমর্থনযোগ্য ছিল না। কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় বা সংবাদপত্রের পাতায় প্যালেস্তিনীয় শিশুদের ক্ষুধার্ত মুখ কিংবা সাদা কাপড়ে মোড়া সন্তানের দেহ আঁকড়ে বাবা-মা’র ছবি ভেসে উঠলে বিপর্যস্ত হৃদয়ে উপলব্ধি হয়, এ বিশ্ব আসলে যুদ্ধই চায়, শান্তি নয়। সেই যুদ্ধোন্মত্ততার খেসারত দিচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা।
‘লড়কে লেঙ্গে’ মানসিকতা আমাদের রাজ্যে মোথাবাড়ি, সামরশেরগঞ্জ-সুতি বা মহেশতলায় আরেক যুদ্ধের জন্ম দিচ্ছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ যেখানে প্রতিবেশীর ওপর চড়াও হতে, কুপিয়ে খুন করতে প্ররোচনা জোগাচ্ছে। পরিকল্পনা মাফিক এই সংঘাতে যাঁরা জড়িয়ে পড়ছেন, তাঁরা প্রতিবেশী তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে এক ভাষায় কথা বলেন। এক সুরে গান করেন। ধর্মীয় বিভেদ উসকে এ আরেক যুদ্ধ। যার অবসান ঘটানোর লক্ষ্য থাকে না কোনও পক্ষের।
যত যুদ্ধ, তত লাভ যে। শান্তি থাকলে বরং স্বার্থসিদ্ধি হবে না। সবসময় ‘হা রে রে রে ডাকাত এল যে রে’ ভাব বজায় রাখার চেষ্টা। যুদ্ধং দেহি মনোভাব এখন ক্ষমতালিপ্সার প্রধান অস্ত্র। শুভেন্দু অধিকারীর তুলসী গাছ মাথায় মিছিল কিংবা সুকান্ত মজুমদারের পুলিশের দিকে নীল-সাদা চটি ছোড়া আসলে রণডঙ্কা বাজানোর নামান্তর। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করায় চারদিকে কত আক্ষেপ! বাগে পেয়েও পাকিস্তানকে রেহাই দেওয়ায় অখুশি অনেকে।
দু’দিন আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত বিধানসভায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ভারত সরকার সুযোগ পেয়েও পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করল না বলে। যুদ্ধের এই রাজনীতির খেসারত দিতে সীমান্তে মানুষের জীবন দুর্বিষহ। এবার যেমন হল কাশ্মীরের পুঞ্চ সহ বিভিন্ন পাকিস্তান সীমান্তে। কত পরিবারকে যে ঘর ছাড়তে হয়েছে, বাংকারে আশ্রয় নিতে হয়েছে, তার হিসেব কেউ রাখে না।
বাইরের শত্রু নয়, মণিপুরে মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠী পরস্পরের হামলা থেকে জীবন বাঁচাতে চাষ বাদ দিয়ে জমিতে বাংকার খুঁড়ছে। আসলে শান্তির কবর খুঁড়ছে দুই পক্ষ! সুকান্ত ভট্টাচার্যের উচ্চারণ ‘যুদ্ধ চাই না আর’ প্রহসন মনে হয় ঢাকঢোল পিটিয়ে কখনও আমেরিকা, কখনও তুরস্কের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যে রাশিয়ার ৪০ বিমানঘাঁটিতে ইউক্রেনের হামলা দেখে।
আরেক যুদ্ধোন্মাদ ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বোমা, মিসাইল হামলায় ইউক্রেনের শত শত প্রাণের বলি ‘শান্তি চাই’ স্লোগানকেই ব্যঙ্গ করে। প্রতিবেশী মায়ানমার আরেক যুদ্ধক্ষেত্র। বিদ্রোহী গোষ্ঠী অগুনতি। সরকার ও সেইসব গোষ্ঠীর যুদ্ধে অশান্তির আগুনে পুড়ছে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারপ্রাপক আং সান সু কি’র দেশ। আরেক শান্তির নোবেল প্রাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বাংলাদেশে এমন একটা দিন যাচ্ছে না, যেদিন কোথাও না কোথাও উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
রাজনৈতিক-ধর্মীয় প্রতিপক্ষকে মারধর, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ছিনতাই, এমনকি খুন আজকের বাংলাদেশে রোজকার ঘটনা। শান্তির নোবেল পেলেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ বাংলাদেশ। শান্তির নোবেল প্রাপকের রাজত্বে দেশটায় অশান্তির শেষ নেই। যে অশান্তির আঁচ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে। পশ্চিমবঙ্গ ও অসম সীমানায় দুই দেশের বাসিন্দারা হয়ে উঠেছেন পরস্পরের ঘোর শত্রু। সংঘাতে তাঁরা সাহসী হয়ে উঠছেন বিএসএফ ও বিজিবি’র প্রশ্রয়ে।
দু’দেশের সরকার, রাজনৈতিক দলের ‘লড়কে লেঙ্গে’ মনোভাব সেই সংঘাতে ঘি ঢালছে। দুই দেশেরই কিছু লোককে জোর করে সীমান্ত পার করে দেওয়ার চেষ্টা প্ররোচনা জোগাচ্ছে। যুযুধান দলগুলির অভিধানে ‘রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা’ নামে পরিচিত শব্দবন্ধনীটিতে আর এখন বিশ্বাস নেই কারও। ক্ষমতার লোভ, দুর্নীতি ইত্যাদির কারণে নিজেদের মতাদর্শ, রাজনৈতিক দর্শনকে ভোঁতা করে দিয়েছে দলগুলিই। মোকাবিলা এখন গায়ের জোরে, পেশিশক্তির আস্ফালনে।
যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই- স্লোগানের জন্য পরিচিত বামপন্থীরা। অথচ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের মুখে মাঝে মাঝে ‘ওরা যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষায়’ বদলার ডাক শুনি। যুদ্ধের আবহে চারদিকের এত কান্না, আর্তনাদ, হাহাকার কাউকে স্পর্শ করে না। রাজনীতির সংকীর্ণতার ছোঁয়ায় মানুষের সুকোমল অনুভূতি হারিয়ে হৃদয় পাথর হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই- স্লোগান যাঁরা দেন, তাঁরাও হয়তো কথাটায় বিশ্বাস করেন না।
যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে রাখতে যে মরিয়া ক্ষমতার কারবারিরা। পাঁচ পাবলিক সেই ফাঁদে পা দিয়ে সেই যুদ্ধের একেকজন সৈনিক হয়ে যাচ্ছে। পাড়ায় বাগে পেলে বিরুদ্ধ দলের নেতা-কর্মীকে পিটিয়ে যুদ্ধ জয়ের আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে সাধারণ লোকও। শান্তির ললিতবাণী তাই শোনাইছে ব্যর্থ পরিহাস।