মূলাজোড় বা শ্যামনগরের দেবী ব্রহ্মময়ী – Uttarbanga Sambad

 মূলাজোড় বা শ্যামনগরের দেবী ব্রহ্মময়ী – Uttarbanga Sambad

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • পূর্বা সেনগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ নৃত্যনাট্যে  আমরা দেখি দেবী কালীর স্থলে দেবী সরস্বতীর আরাধনায় মেতেছেন ডাকাত সর্দার। বাংলার নবজাগরণের অংশ রূপে রবীন্দ্রনাথের পরিবারকে আমরা উল্লেখযোগ্য স্থান গ্রহণ করতে দেখি। সংগীতে, নৃত্যে, ব্রাহ্ম নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে, আধুনিক নারীর উত্থানে এই পরিবারের অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। জোড়াসাঁকোতে ঠাকুর পরিবারের উত্থান আমাদের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান গ্রহণ করেছে।

রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে যে ব্রাহ্মসমাজের সূচনা হয়েছিল তার উত্তরাধিকারী ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। রাজা রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাবনায়। এই পরিবর্তিত ধারণারই অনুসরণকারী ছিলেন এই ঠাকুর পরিবার। ব্রাহ্ম পরিবারের ঐতিহ্য অনুসারে দেবদেবী ভাবনার খুব বেশি অনুসারী ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশেষত, তাঁকে দেবী কালী প্রসঙ্গে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়নি। কিন্তু এই পরিবারের মধ্যেই সূচনা হয়েছিল কালী আরাধনার একটি ধারা। যে ধারা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল শ্যামনগরের মূলাজোড় ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ির। আজ আমরা  এই মন্দিরের কাহিনী, তার সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসকে পাশাপাশি রেখে আলোচনা করব।

মূলাজোড়ে যে কালী বিরাজিতা তিনি গোপীমোহন ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত। আমরা গোপীমোহন ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বিষয়ে একটু চোখ বুলিয়ে নেব। এই ঠাকুর পরিবার আদতে ছিলেন কুশারী উপাধিধারী। কুশারীরা হলেন মূলত উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে আগত ভট্টনারায়ণের পুত্র দীনু কুশারীর বংশজাত। অর্থাৎ এঁদের উৎপত্তি বাংলার বাইরে। পরবর্তীকালে এঁরা চারিদিকে ছড়িয়ে েগলেও খুলনার পিঠাভোগের কুশারী বংশোদ্ভূত ঠাকুররাই কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন।

শোনা যায়  খুলনার পিঠাভোগে কুশারী পরিবারের মহেশ্বর ও তাঁর ছেলে পঞ্চানন কুশারী জ্ঞাতি কলহের কারণে খুলনা ত্যাগ করে ত‌‌ত্কালের গোবিন্দপুর গ্রামে চলে আসেন। গোবিন্দপুর পরবর্তীতে কলকাতা হয়ে উঠলেও তখন ছিল একটি গ্রাম মাত্র। প্রথমত, তাঁরা গোবিন্দপুরে বসতি স্থাপন করে জাহাজের ব্যবসায় জড়িত হন। ব্রাহ্মণ বংশ বলে সকলে তাঁদের ‘ঠাকুরমশাই’ নামে ডাকতে শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসন কায়েম হলে এই পরিবার নিজেদের ‘ঠাকুর’ পদবিতে চিহ্নিত করতে থাকেন। এই হল ঠাকুর পরিবারের উৎপত্তির মূল ইতিহাস।

 পঞ্চানন কুশারীর দুই ছেলে ছিল, জয়রাম আর রামসন্তোষ। কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর ইংরেজদের অধীনে আসার পর ১৭০৭ সালে প্রথম জমি জরিপের কাজ শুরু হয়। জরিপের কাজে দুইজন আমিনের বা তদারকির জন্য বিশেষ পদ প্রয়োজন হলে পঞ্চানন কুশারীর অনুরোধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কালেক্টর শেল্ডন সাহেব তাঁর দুই পুত্রকে সেই কাজে নিযুক্ত করেন। জয়রাম ও রামসন্তোষ সেই কাজে অত্যন্ত যোগ্যতা প্রদর্শন করেন। ১৭১৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার দক্ষিণে ৩৮টি গ্রাম কেনে। সেই গ্রামগুলির জরিপের কাজও লাভ করেন এই দুই ভাই। জমি জরিপের আমিনের পদেই এই বংশ ধীরে ধীরে বিত্তশালী হয়ে ওঠেন।

 আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলেন পঞ্চাননের পুত্র জয়রাম। তাঁর চার পুত্র আনন্দীরাম,  নীলমণি, দর্পনারায়ণ, গোবিন্দরাম। একটি কন্যা ছিলেন, নাম ছিল সিদ্ধেশ্বরী। আবার এই চারজনের মধ্যে তৃতীয় পুত্র দর্পনারায়ণের ছেলের নাম গোপীমোহন। ১৮০৯ সালে মতান্তরে ১৮১২ সালের বৈশাখী পূর্ণিমার দিন বা ৩১ বৈশাখ, মূলাজোড়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন গোপীমোহন ঠাকুর। গোপীমোহনের ছয় ছেলে এক মেয়ে। এই ছয় ছেলে হলেন সূর্যকুমার ঠাকুর, চন্দ্রকুমার ঠাকুর, নন্দকুমার ঠাকুর, কালীকুমার ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও হরকুমার ঠাকুর এবং একমাত্র কন্যা ব্রহ্মময়ী। এই ব্রহ্মময়ীর নামেই কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর পিছনে জড়িয়ে আছে এক করুণ ইতিহাসের অধ্যায়।

পাথুরিয়াঘাটার জমিদার ছিলেন গোপীমোহন ঠাকুর। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন কৌলীন্যপ্রথার জন্য নয় বছরের মধ্যে মেয়েদের বিবাহ দিতে হত। এই প্রথাকে বলা হত গৌরীদান। ঠাকুর পরিবার এর ব্যতিক্রম ছিল না। শোনা যায় গোপীমোহন ঠাকুরের একমাত্র মেয়ে ব্রহ্মময়ীর বিয়ে স্থির হয়েছিল আট বছর বয়সে। বিবাহের দিন জোড়াসাঁকোর নতুনবাজার গঙ্গার ঘাটে কিংবা পাথুরিয়াঘাটার ঘাটে গোপীমোহনের কন্যা ব্রহ্মময়ীকে পালকি করে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

তখন, পর্দানশিন সমাজ, গঙ্গার ঘাটে পালকি করে নিয়ে গিয়ে পালকি থেকে নেমে গঙ্গায় স্নান করতে যেত না মেয়েরা। তাঁদের স্নান করানোর জন্য পালকি  শুদ্ধ গঙ্গায় ডুবিয়ে দেওয়া হত। পালকির মধ্য থেকেই স্নান করতেন মেয়েরা। ব্রহ্মময়ীকেও সেই রকমভাবে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে পালকি শুদ্ধ ডুবিয়ে দিলেন পালকিবাহকেরা। পালকি সহ ডুব দিলেন ব্রহ্মময়ী। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার পালকিবাহকেরা পালকিকে উঠিয়ে আর ব্রহ্মময়ীকে দেখতে পেলেন না।  নদীর জলে অনেক খুঁজেও মেয়েকে খুঁজে পেলেন না গোপীমোহন। তিনি কন্যাকে হারিয়ে একেবারে অসুস্থ ও উন্মাদপ্রায় হয়ে গেলেন।

এইভাবে দশ–পনেরো দিন অতিক্রান্ত হল। একদিন গোপীমোহন স্বপ্ন দেখলেন কন্যা ব্রহ্মময়ী তাঁকে বলছেন, ‘আমাকে মাতৃরূপে মূলাজোড় গ্রামে পাবে। সেই মাতৃরূপেই প্রতিষ্ঠা করো, কন্যারূপে আমাকে আর পাবে না।’ দ্বিতীয় মতে, স্বপ্নে ব্রহ্মময়ী বলেছিলেন, ‘বাবা, আমি মূলাজোড়ে আছি। আমাকে তুমি মূর্তি রূপে পাবে।’

এই স্বপ্ন দেখে দেবীর আদেশ পেয়েছেন মনে করে গোপীমোহন ঠাকুর গঙ্গার পথে ঘুরতে ঘুরতে  মূলাজোড়ে উপস্থিত হলেন।  তখন সেই অঞ্চলে ছিল গভীর জঙ্গল। গোপীমোহন দেখলেন সেই মূলাজোড়ের গঙ্গার তীরে একটি দেবীমূর্তি বিরাজিত হয়ে রয়েছেন আর তার পায়ের তলায় শায়িত শিব। কেবল তাই নয়, সেখানেই তিনি ব্রহ্মময়ীর দেহ খুঁজে পান। আবার দ্বিতীয় মতে, বলা হয়েছে  সেখানে গিয়ে গোপীমোহন দেখেছিলেন একটি কালো পাথর নদীর জলে অর্ধপ্রোথিত হয়ে রয়েছে। গোপীমোহন সেই পাথর দিয়ে দেবী মূর্তি গঠন করিয়েছিলেন।

এই ধারণার কোনটি সঠিক তা আমরা জানি না। তবে আমাদের মনে হয় গোপীমোহন একটি মূর্তিকেই গঙ্গার ঘাটে অতি সাধারণভাবে পূজিত হতে দেখেছিলেন। কারণ  আমরা  এই মন্দিরের বিষয়ে আলোচনা করলে দেখব এই ধারণা সত্য হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। শোনা যায় মূর্তি দেখে গোপীমোহন মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এই দেবী পূর্বে দক্ষিণমুখী ছিলেন।

একবার শাক্তসাধক রামপ্রসাদ গঙ্গা দিয়ে হালিশহরে তাঁর বাড়িতে ফিরছিলেন। এই সময় তাঁর কণ্ঠজাত সুখস্রাবী সুরে মুগ্ধ হয়ে দেবী পশ্চিমমুখী হয়ে উঠেছিলেন। যদিও গোপীমোহনের কন্যার সঙ্গে এই কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠার কাহিনী জড়িয়ে গিয়েছে তবু বলা হয় মন্দিরের চারিদিক ও মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় মূর্তির কোনও পরিবর্তন করেননি গোপীমোহন। মন্দিরের কাঠামোয় নাকি পরিবর্তন আনেননি। কেবল মন্দিরের দ্বারদেশে দুটি শ্বেতপাথর নির্মিত সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু লোককথা অনুযায়ী একটা মতে গোপীমোহন মূলাজোড়ে এসে দেবীকে দেখতে পেয়ে সেই স্থানে এসে নতুনভাবে বিরাট মন্দির স্থাপন করলেন। এই নবনির্মিত মন্দির হল নবরত্ন মন্দির। মূল দেবীর নাম গোপীমোহন নিজের মেয়ের নাম ব্রহ্মময়ীর নামে রেখেছিলেন। তাই দেবী তখন থেকে দেবী ব্রহ্মময়ী নামে পরিচিতা হতে লাগলেন। দেবীপূজার জন্য আরামবাগ থেকে পণ্ডিত আনা হয়েছিল। এর সঙ্গে প্রায় একশো বছরের প্রাচীন গোপালজিউ-এর মূর্তি পাথুরিয়াঘাটায় গৃহদেবতা রূপে পূজিত হতেন। তিনিও এই মন্দির চত্বরে পৃথক মন্দিরে স্থানলাভ করলেন।

 আমরা দেখি দেবী মন্দির স্থাপনার জন্য চারপাশের বহু জমি কিনে নিয়েছিলেন গোপীমোহন। তখন তাঁরা বিশাল জমিদার। অর্থের কোনও অভাব নেই। গোপীমোহন অনেক পরিমাণ জমি কিনে সেই জমিতে তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমস্ত বিষয় সম্পত্তিকে তিনি দেবী ব্রহ্মময়ী দেবোত্তর সম্পত্তির অধীন করে গিয়েছিলেন। সেই জমিতে এখন বিরাট বাজার, আর সেই বাজার থেকে যে ভাড়া আসে সেই ভাড়ার অর্থ থেকে দেবীর খরচ নির্বাহ করা হয়। সেটাই হল দেবী মন্দির চালনার প্রধান উপায়।

দেবীর সেবায়েত প্রথম হয়েছিলেন চন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। মন্দিরের বাম ও ডান দিকে ছয়টি করে শিব মন্দির তৈরির কাজ শুরু করেন গোপীমোহন। কিন্তু এই কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি পরলোকগমন করেন। তখন ১৮১৮ সাল, এর পর মন্দিরের দায়িত্ব এসে পড়ে প্রসন্নকুমার ও হরকুমারের ওপর। হরকুমার মূলাজোড়ে দ্বাদশ শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন এবং বাইরের দিকে আরও তিনটি অতিরিক্ত শিবলিঙ্গ স্থাপিত হয়। এগুলি নাকি তৎকালীন বিধবাদের ভরণপোষণের জন্য। এই তিন শিবলিঙ্গের নাম আনন্দশংকর, গোপীশংকর এবং হরশংকর। আর দ্বাদশ শিবলিঙ্গের নাম হরকুমার দিয়েছিলেন, মহাকালেশ্বর, কেদারনাথ, সোমনাথ, ওঁকারেশ্বর, মল্লিকার্জুন, ভীমশংকর, কাশী বিশ্বনাথ, ত্র্যম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর এবং ঘৃষ্ণেশ্বর-দ্বাদশ জ্যোর্তিলিঙ্গের নাম অনুসারে। শিব মন্দিরগুলির মধ্যে দশটি আটচালা, দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির। এখানে একটি শ্বেত শিবলিঙ্গ বা বাণলিঙ্গের মন্দিরও বর্তমান। প্রসন্নকুমার ঠাকুরের আমলে মূলাজোড় কালীবাড়ির চরম বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। কালী মন্দিরের সামনে নাটমন্দির তিনিই স্থাপন করেন।

এই সময় তাঁরা মন্দিরের পাশে মূলাজোড় দাতব্য চিকিৎসালয় করেছিলেন। তার পাশেই ছিল মূলাজোড় সংস্কৃত কলেজ। লোকমতে শ্রীরামকৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় নাকি এই কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু এ তথ্য সঠিক নয়। কারণ মন্দির প্রতিষ্ঠা ও রামকুমারের জীবনকালের সঙ্গে এটি মেলে না। আমরা আগেই বলেছি দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অনুরূপ বেশ কিছু কালী মন্দিরের দেখা আমরা পাই। যারা কোনও না কোনওভাবে এই মন্দিরের সঙ্গে নিজেদের সাদৃশ্যকে প্রচার করতে আগ্রহী। গোপীমোহনের প্রতিষ্ঠিত মূলাজোড়ের মন্দির তাদেরই মধ্যে একটি। শোনা যায় রানি রাসমণি  নাকি এই মূলাজোড় দেবী মন্দির খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি প্রায়ই এখানে আসতেন শান্তির খোঁজে। এই মন্দিরের প্রভাব তাঁর ওপর এতটাই গভীর ছিল যে পরবর্তীতে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির গঠনের সময় তিনি দেবী মন্দিরটি মূলাজোড় নবরত্ন দেবী মন্দিরের আদলে গড়ে তুলেছিলেন।

দেবী ভবতারিণীর সঙ্গে দেবী ব্রহ্মময়ীর সাদৃশ্যও সকলকে অভিভূত করে। এই মন্দিরে দেবী মন্দিরের দুইপাশে ছয়টি ছয়টি করে মোট বারোটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেই কারণে দক্ষিণেশ্বরেও আমরা দ্বাদশ শিব মন্দিরের দেখা পাই। এই শিব মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গগুলির প্রত্যেকটির এক একটি নাম খোদাই করা ছিল। মন্দিরের গায়ে চিহ্নিত নামগুলি এখন ফ্যাকাসে হয়ে যেতে যেতে একেবারেই মুছে গিয়েছে। সঙ্গে আছে একটি রাধামাধব গোপাল মন্দিরও।  আশ্চর্যের ব্যাপার এই মন্দির প্রাঙ্গণের মধ্যেই একটি বহু প্রাচীন কালো রঙের বিষ্ণু মূর্তির দেখা পাওয়া যায়। এই মূর্তি কোথা থেকে এল তা কেউ জানেন না। বলা হয় মূর্তি প্রথম থেকেই মন্দিরে ছিল, গোপীমোহন তা প্রতিষ্ঠা করেন মাত্র। তা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে মন্দির নিশ্চয়ই পাল যুগের সমসাময়িক হবে। কারণ মূর্তির গঠন এমনই বলে মনে হয়। যদিও কালী মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার আগেই রাধামাধবের মন্দির চোখে পড়বে। তবে তা খুব বেশি প্রাচীন নয়। মন্দিরের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে আরেকটি বিষয় খুব প্রণিধানযোগ্য তা হল মন্দিরের দেবী বৈশাখ মাসে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর প্রধান উৎসব হয় ১ পৌষ থেকে ১ মাঘ পর্যন্ত। এই এক মাস এই মন্দির চত্বরে বিরাট মেলা বসে। এই মেলার সময় দেবীকে যাঁরা পুজো দিতে আসেন তাঁরা  পুজোর ডালায় জোড়া মুলো রাখেন। দেবী জোড়া মুলো দিয়ে পূজিত হন বলে মূলাজোড়ের কালী নামে তিনি প্রতিষ্ঠিতা। আমরা সাধারণভাবে পৌষকালীকে মুলো দিয়ে পুজো করি।

এর সঙ্গে গোপীমোহন-এর প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মময়ী কালীর কী সম্বন্ধ তা ঠিক নির্ণয় করা গেল না। এই দেবী আগেই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন আমরা জানি, মনে হয় তিনি হয়তো বা পৌষকালীরূপে বিরাজিত ছিলেন। গোপীমোহন সেই দেবীকেই স্বপ্নাদেশ লাভের পর ব্রহ্মময়ী কালীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু একথা মানতেই হবে নতুন মন্দির ঠাকুর পরবারেরই প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের গায়ে বিশ্বকবির পূর্বপুরুষ গোপীমোহন ঠাকুর দেবীকে নিয়ে একটি গান রচনা করে গিয়েছেন। গান রচনায় তিনি কালীদাস চট্টোপাধ্যায়ের সাহায্য নিয়েছিলেন। যে গানের কথা তাঁর কালীভক্তির উদাহরণ রূপে চিহ্নিত করা যায়। মন্দিরের গায়ে কালো পাথরের ফলকে এই গানটি মুদ্রিত রয়েছে। আমরা সেই গানটিকে তুলে ধরলাম।

(রাগিনী গৌড়,সব্যঙ্গ।)

“ শিবে শবাসনা লোল রসনা,

ভীষণা দিগ্বসনা বিকট দর্শনা।

লজ্জারূপা নাহি লজ্জা,

মেয়ে হয়ে রণসজ্জা।

রুধির মগনা।

সভয়া অভয়া বরে

সতী নিজ পতি পরে

একি বিবেচনা!

কহিছে গোপীমোহনে

ঐরূপ জাগে মনে

কালী ত্রিনয়না।।

মন্দিরগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রসন্নকুমার প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে বরাদ্দ করেন।

জ্যোতিন্দ্রমোহন ঠাকুরের আমলে সাধক বামাখ্যাপা মূলাজোড় কালী মন্দিরে আসেন এবং এখানে কিছুদিন সাধনা করেছিলেন বলে কথিত আছে। তখন মূলাজোড়ের প্রধান পুরোহিত ছিলেন চন্দ্রনাথের পুত্র রামনাথ মুখোপাধ্যায়। রামনাথ ব্যামাখ্যাপার সংস্পর্শে এসে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। ব্যামাখ্যাপা দীনদরিদ্র মানুষের সেবা করার জন্য জ্যোতিন্দ্রমোহন ঠাকুরকে আদেশ দেন। সেই সময় থেকে মূলাজোড়ে এলাহি ভোগের ব্যবস্থা করা হতে থাকে। যার ফলে দুঃখী দরিদ্র মানুষ মন্দিরে গেলেই অন্ন পেতেন।

এখন আর সেদিন নেই। এই মূলাজোড় গ্রাম কিন্তু খুবই ঐতিহ্যবাহী। রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র এই মূলাজোড়ে বসেই অন্নদামঙ্গল কাব্য রচনা করেন। লর্ড ডালহৌসির আমলে রেলপথ প্রতিষ্ঠার সময় মূলাজোড় স্টেশনের নাম রাখেন শ্যামনগর। কিন্তু এখনও প্রাচীন সাহিত্যে এবং এই দেবালয়ের ইতিহাসে মূলাজোড় নামটি সংযুক্ত হয়ে রয়েছে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *