বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্য খুব একটা প্রসন্ন নয়। বাংলাদেশের জন্ম সংগ্রামের পূর্ব সময়েই তৎকালীন ‘পূর্ব বাংলায়’ রবীন্দ্রনাথকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ছুড়ে ফেলার আয়োজন করা হয়। বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করে সরকার।
স্বাধীন বাংলাদেশে সেই আবহ পরবর্তীতে না থাকলেও, সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট মানুষ রবীন্দ্রনাথকে আপন করেনি। ফলে নানা সময়ে রবীন্দ্র-বিরোধী চর্চার পালে জোরেশোরে হাওয়া দিয়েছে বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু করে জনসাধারণ। জনসাধারণকে রবীন্দ্র-বিরোধী করে তুলতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে মৌলবাদী বক্তারা। বিভিন্ন তাফসির ও ওয়াজ মাহফিলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উদ্ভট বয়ান মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে রবীন্দ্র-বিরোধী তৎপরতা বেড়েছে। জামায়াতে সহ তাদের সমমনা মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তায় রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে তাদের প্রভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের হস্তক্ষেপের ফলে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি এখন অবরুদ্ধ। এর প্রথম শিকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরপরই রবীন্দ্রনাথ।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথের লেখা হওয়ায় একে হিন্দুয়ান গান আখ্যা দেওয়া হয়। এই গানের কথায় শিরকের অভিযোগে বাতিলের দাবি জানায় উগ্র ইসলামপন্থীরা। এনিয়ে সারাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রগতিশীল নাগরিকেরা এর প্রতিবাদে দেশের নানা প্রান্তরে জাতীয় সংগীত গাওয়ার আয়োজন করে। সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে মাঠে নামিয়ে পূর্বঘোষিত এই কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করে। জাতীয় সংগীত গাওয়ায় বাধাদানের সংবাদও পাওয়া যায়।
কঠোর সমালোচনার মুখে সরকার ও রবীন্দ্র-বিরোধী গোষ্ঠী জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের চেষ্টা থেকে সরে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র থেমে নেই। জাতীয় পাঠ্যপুস্তক থেকে তাঁর লেখাপত্র বাদ দেওয়ার ঘৃণ্য চেষ্টা শুরু হয়। এখানেও ব্যর্থ হলে পাঠ্যপুস্তক থেকে তারা রবীন্দ্র রচনা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে। এখানে রবীন্দ্র-বিরোধী শক্তি খানিকটা জয়ী। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতিকে মুসলমানিকরণে রবি ঠাকুরকে বিতর্কিত করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই সেই চিত্রের প্রমাণ মিলবে। রবীন্দ্র সংক্রান্ত সংবাদ কিংবা লেখাপত্রের মন্তব্যে বিরূপ মন্তব্যগুলো অত্যন্ত অরুচিকর। রবীন্দ্রনাথের কোনও রচনা পাঠ না করা ব্যক্তিও তাঁর প্রতি ঘৃণা উগরে দিতে পিছপা হয় না। এর সিংহভাগই মৌলবাদে প্রভাবিত কিশোর-তরুণ।
সাহিত্য-জ্ঞান চর্চা থেকে বিচ্যুত বাংলাদেশের জেন-জি প্রজন্ম সহ সকল স্তরের ব্যক্তিবর্গ রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র রচনাবলি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বা সঠিক ধারণা রাখেন না। রবীন্দ্র পাঠে তারা নিম্নস্তরে। উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও রবীন্দ্রচর্চা খুবই সীমিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত প্রাঙ্গণেও মৌলবাদ ছেয়ে থাকায় রবীন্দ্রনাথ শুধু জন্ম-মৃত্যু দিবসের আনুষ্ঠানিকতায় আবদ্ধ। কোথাও কোথাও সেটাও বর্তমানে বন্ধ।
বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাত ছায়ানট। তারা নিজেদের পরিসর খানিকটা কমিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে মনেপ্রাণে ধারণ ও লালন করা এই প্রতিষ্ঠানকে উগ্রপন্থীরা সবসময়ই আক্রমণ করে আসছে। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকার রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনা ছিল খুবই ভয়ংকর। তেমন আশঙ্কা এখন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। জঙ্গিবাদে প্রভাবিত প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কুৎসা রটনা করে আনন্দ পায়। এই নোংরা উদযাপনের দেখা মেলে রবীন্দ্র রচনার বিকৃতিকরণ ও নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করার ভেতরে।
এসব থেমে নেই বলেই কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বিশ্বকবির ম্যুরালে কালো রঙের কালি লাগানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। গীতাঞ্জলির স্মারক ফলকে কবির মুখমণ্ডলে কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। যে স্থানে বসে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি’র সিংহভাগ রচনা করেছিলেন, সেই অঞ্চলেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গ্রহণযোগ্য হতে পারে না— কবিগুরুর পদচারণে ধন্য ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠাবাড়ি জমিদারের কাছারিবাড়ির নামফলক থেকে রবীন্দ্রনাথের নাম মুছে ফেলার ঘটনাও।
জমিদার প্রমোদচন্দ্র রায়চৌধুরীর আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, আঠারবাড়ি গিয়েছিলেন কবি। কবির স্মৃতি বহন করা জমিদারবাড়িটি বর্তমানে আঠারবাড়ি কলেজ। সেখানেই রবীন্দ্রনাথের নাম মুছে মৌলবাদীরা লিখে দেয় কালেমা তৈয়্যবা। এটা পরবর্তীতে মুছে ফেললেও রবীন্দ্রনাথের নাম আর লেখা হয়নি। বাংলাদেশে বন্ধ হয়নি আপত্তিকর রবীন্দ্র বিতর্কও।