মন চলো আনন্দভৈরবী

মন চলো আনন্দভৈরবী

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


  • পূর্বা সেনগুপ্ত   

 

আমরা দেখেছি বাংলার বেশ কয়েকটি মন্দির দাবি করে, রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মায়ের মন্দির নির্মিত হয়েছিল তাদের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের গঠনশৈলীর অনুপ্রেরণায়।

এই প্রসঙ্গে আমরা দু-তিনটে মন্দিরের কথা আলোচনা করেছি।

আজ আমরা আরেকটি দেবস্থানের কথা আলোচনা করব, যে দেবালয় দাবি করে স্বপ্নাদিষ্ট রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যাওয়ার সময় এই স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং মন্দির দর্শন করে সেই মন্দিরের অনুপ্রেরণায় দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। চুঁচুড়া শহরের ষণ্ডেশ্বর শিব আলোচনায় দেখেছিলাম একই চত্বরে অনেকগুলি মন্দির। নানা সময়ে এই মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছে। ঠিক এইরকম আরেকটি মন্দিরময় প্রাঙ্গণে আজ আমরা পা রাখব।

বাংলা মন্দিরময়, আর অধিকাংশ মন্দির গড়ে উঠেছে কোনও না কোনও রাজপরিবারের অনুগ্রহে। পরিবারের ইতিহাস শুধু কোনও নির্দিষ্ট পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই ইতিহাস সমাজের ইতিবৃত্তের সঙ্গে যুক্ত থাকে নিবিড়ভাবে। আমরা আজ হুগলি জেলার সোমড়াবাজার এলাকার সুখারিয়া গ্রামে যাব। এই গ্রামে উল্লা বীরনগর থেকে আগত মিত্র মুস্তাফি পরিবার গড়ে তুলেছিলেন বিরাট প্রাসাদ। তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের মূল আরাধ্যা দেবী হলেন কালিকা। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন শিব ও গণেশ।

সোমড়াবাজার থেকে সুখারিয়া প্রবেশ করলে প্রথমে বিশাল রাজবাড়ির দেখা পাওয়া যাবে। তবে রাজবাড়ি ভগ্ন হয়ে বিলুপ্ত হওয়ার মুখে। বিরাট তোরণ যুক্ত প্রবেশদ্বারের কাঠামোটি জেগে আছে মাত্র। সেই ভগ্নস্তূপ যেন লজ্জায় মলিন হয়ে তাকিয়ে থাকে দর্শকের দিকে। আজ তার দুরবস্থা দেখে মানুষ তাকে অনায়াসে ঘুঁটের প্রলেপ দিয়ে সাজিয়েছে। জীবন অনিত্য, কিন্তু দেবতা জেগে আছে সেই মহিমা নিয়েই। শত শরিকে বিভক্ত বাড়ি ভেঙে পড়লেও মন্দিরগুলো বেশ যত্নে রক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান মন্দির আনন্দভৈরবী মায়ের। লোকমুখে যা আনন্দময়ী বা আনন্দ ভবতারিণী মা নামেও বন্দিত। আর এই মন্দির বাংলার বিরল পঁচিশ রত্নের তিনটি মন্দিরের একটি। আমরা এবার ইতিহাসের দিকে যাব।

বাংলার ১৬৫৭ সাল। বাংলার অক্সফোর্ড নবদ্বীপের পাশেই শান্তিপুর  গ্রাম শিক্ষার জন্য বিখ্যাত। সেখানে মোহন মিত্র নামে খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত বাস করতেন। এঁরা প্রকৃতপক্ষে বাংলার অধিবাসী ছিলেন না। কনৌজ থেকে এঁদের আগমন হয়েছিল বঙ্গদেশে। মোহনের এক পুত্র রামেশ্বর অত্যন্ত শিক্ষিত ছিলেন। তাঁর পিতার মতো কেবল পণ্ডিত রূপে শিক্ষাজীবী থাকতে ভালো লাগল না।

তখন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ, তাঁর প্রধান সাহায্যকারী ছিলেন মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খাঁ। এই সময় রামেশ্বর মিত্র পিতার পণ্ডিতি পেশা ছেড়ে দিয়ে শায়েস্তা খাঁ ও মুর্শিদকুলি খাঁয়ের অধীনে হিসাবরক্ষকের কাজ ও কোষাধ্যক্ষের কাজ করতে শুরু করলেন।  এই কাজে রামেশ্বরের সুনাম ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে লাগল। আনুমানিক ১৭০৪ সালে রামেশ্বরের কর্মকুশলতার সংবাদ শায়েস্তা খাঁয়ের কাছ থেকে শুনে তাঁকে স্বয়ং ঔরঙ্গজেব ডেকে পাঠালেন দিল্লিতে। রামেশ্বর নিজের প্রতিভা ও কাজের মাধ্যমে তাঁকেও তুষ্ট করলেন অনায়াসে।

তুষ্ট মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব রামেশ্বর মিত্রকে তখন ‘মুস্তাফি’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। আর তার সঙ্গে সম্রাটের হাতের ছাপ বিশিষ্ট একটি সোনার পাঞ্জা প্রদান করেন। এই মুস্তাফি উপাধি তখন থেকে এই বংশে ব্যবহৃত হতে থাকে। মিত্র থেকে রামেশ্বর হন মিত্র-মুস্তাফি। আর স্মারকচিহ্ন রূপে প্রদত্ত সোনার পাঞ্জাটি একটি মূল্যবান বস্তু রূপে এই বংশের বংশধরেরা ব্যবহার করতেন। কোনও নববিবাহিত বধূ গৃহে এলে সেই সোনার পাঞ্জা দিয়ে তাঁকে সিঁদুরদান করা হত।

এই রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফি কিন্তু শান্তিপুরে বাস করতেন না। তাঁর আবাস ছিল বীরনগরের উল্লা বা উলা গ্রামে। রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফির চতুর্থ পুত্র অনন্তরাম মিত্র মুস্তাফি ১৭১২ সালে সোমড়াবাজারের সুখারিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। অনন্তরামও পিতার মতো শিক্ষিত ছিলেন। তিনিও হিসাবরক্ষকের কাজে পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন। আর এর ফলে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন এবং সেই অর্থ জমিদারিতে খাটিয়ে বিরাট ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। অনন্তরামের পুত্র রাধাজীবন মিত্র মুস্তাফি সুখারিয়া গ্রামে বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এই প্রাসাদের নাম তাই ‘রাধাকুঞ্জ’। অনন্তরামের এক নাতি, পুত্র শম্ভুরামের পুত্র বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফিই সেই অসাধারণ মন্দিরের স্থাপনা করেন। সেই মন্দিরই হল মা আনন্দভৈরবীর মন্দির। সাল ১৮১৩, বাংলা সন, ১১৭০।

আনন্দভৈরবী মাতার মন্দিরের বিস্তারিত বর্ণনার আগে আমরা এই পরিবারের প্রাচীন গৃহদেবতার বিষয়টি স্পষ্ট করে নিতে চাই। আনন্দভৈরবী মাতার মন্দির মিত্র মুস্তাফিদের গৃহ প্রাঙ্গণে নয়, তা রাজবাড়ির পাশে বিরাট এলাকাজুড়ে আমবাগান ও ধানখেতবেষ্টিত ক্ষেত্রে নির্মিত হয়েছে। এই পরিবার ঠিক একই শৈলীর আরও দুটি মন্দির স্থাপন করার কৃতিত্ব অর্জন করেছে। একটি দেবী হরসুন্দরী ও তৃতীয়টি হল দেবী নিস্তারিণী। এছাড়াও সুখারিয়া গ্রামের ঠিক পাশ দিয়ে বহমান বেহুলা নদীর ধারে  সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির। শোনা যায়, এক সাধক সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি আনলে মিত্র মুস্তাফি পরিবার মূর্তিটি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের জমি দান করে এবং তাদের আনুকূল্যেই মন্দিরটি গড়ে ওঠে।

আনন্দময়ী, হরসুন্দরী, নিস্তারিণী ও সিদ্ধেশ্বরী- এই চার দেবীর সঙ্গে মিত্র মুস্তাফি পরিবারের ইতিহাস নিবিড়ভাবে জড়িত। কিন্তু এই পণ্ডিত বংশের প্রাচীন কোনও গৃহদেবতা ছিল কি? আমরা রাধাকুঞ্জ প্রাসাদের ভিতরে নাটমন্দির সহ দেবালয়ের দেখা পাই। এই দেবালয়ে অধিষ্ঠিত আছেন অষ্টধাতু নির্মিত মা দুর্গা, শিবমোহিনী। ঠিক তাঁর সঙ্গে এক রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ রূপে পূজিত। কিন্তু রাধাকৃষ্ণের পাশে রক্ষিত যে মূর্তিটি গৃহদেবতারূপে পূজিত হন তাঁর গৃহদেবতা রূপে অবস্থান খুব বিরল। তিনি হলেন অনন্তদেব নারায়ণ।

আমার ব্যক্তিগত মত, শিবমোহিনী মূর্তিকেই তাঁরা কনৌজ থেকে এনেছিলেন। পরে বাংলার নবদ্বীপের রঙে রঞ্জিত হয়ে রাধাকৃষ্ণ ও নারায়ণ মূর্তির সংযোজন হয়। এই দেবমন্দির যে নাটমন্দিরের পাশে সেই নাটমন্দিরে আজও প্রতি বছর দুর্গাপুজো হয়। আগে এই পুজো অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে পালিত হত।

 শোনা যায়, এই পুজো উপলক্ষ্যে মোষও বলি হত। কিন্তু এখন ছাগবলিও হয় না। ছাঁচিকুমড়ো, কাঁঠালি কলা আর আখ বলি হয়। এই নাটমন্দিরের সম্মুখের উঠোনটি একটু অদ্ভুত। একটা অংশ পৃথক করে বাঁধানো। তার চারপাশে অর্ধচন্দ্রাকারে মোটা লোহার তার লাগানো। এই অংশে নাকি যাত্রা, নাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হত। আর লোহার কাঠামোগুলিতে জাপানি আলো টাঙানো থাকত। জমজমাট রাজবাড়ির আজ ভগ্নদশা।

সুখারিয়া গ্রাম বিখ্যাত মিত্র মুস্তাফি পরিবারের আনন্দভৈরবী কালীবাড়ির জন্য। পোড়া লাল রঙের বিরাট মন্দির পঁচিশ রত্নের। তিনতলা মন্দিরের প্রথম তলায় চার কোনায় তিনটি করে মোট বারোটা, দ্বিতীয় তলার চার কোণে দুটি করে মোট আটটি, তৃতীয় তলার চার কোণে একটি করে চারটি চূড়া। আর এঁদের মধ্যে মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করছে মূল বা প্রধান চূড়া। মোট পঁচিশটি চূড়া নিয়ে মন্দিরটি বাংলার গুটিকয়েক পঁচিশ চূড়া মন্দিরের একটি।

এই পঁচিশ চূড়ার মন্দির বর্ধমানের কালনায় এবং বাঁকুড়ার সোনামুখীতে রয়েছে। বীরেশ্বর মিত্র মুস্তাফির প্রতিষ্ঠিত আনন্দময়ীর মন্দির তৃতীয় স্থান অধিকার করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি এই মন্দিরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আছে। এই মন্দিরের দুই পাশে ছয়টি করে বারোটি মন্দির। মূল মন্দিরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য মন্দিরের ঠিক পাশে যে মন্দির সেটি পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট রত্ন মন্দির। বাদবাকি পাঁচটি মন্দির বাংলার আটচালা ভঙ্গিমায় গড়ে ওঠা। এই রত্ন মন্দিরগুলির একটিতে গণেশের মূর্তি বিরাজিত এবং পূজিত আর অন্যগুলিতে শিব।

মূল মন্দিরে ঢুকতেই দেবী মন্দিরের সঙ্গেই দুটি শিবলিঙ্গ পূজিত। এটিও খুব ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। দ্বাদশটি শিবের মধ্যে দুটি হল শ্বেতলিঙ্গ। অপরগুলি কৃষ্ণবর্ণের। দেবীমূর্তি একটু অন্যরকম। সর্বাঙ্গে শাড়ি জড়ানো বলে সঠিক বোঝা যায় না। কিন্তু দেখে মনে হয়, দেবী এক পায়ের ওপর আরেক পা রেখে বসে রয়েছেন। তিনি চতুর্ভুজা। এই বসা বিগ্রহ দেখে মনে হয় এই পরিবার, যে পরিবারের আরাধ্য গৃহদেবী শিবমোহিনী থেকে শুরু করে আরও চারটি দেবীমূর্তি আরাধিত- সেই পরিবার কোনও না কোনওভাবে তন্ত্রসাধনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বিশেষ করে দেবীর নামের সঙ্গে ভৈরবী শব্দটির যোগ আমাদের এই প্রবণতাকে আরও নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে।

আনন্দভৈরবী দেবীর মন্দির নিঃসন্দেহে বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ কালী মন্দির। মন্দির ঘিরে টেরাকোটার কাজের অনেক অংশ ধ্বংস হয়ে গেলেও যেটুকু রয়েছে তাও মন্দির বিশেষজ্ঞদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

মিত্র মুস্তাফি পরিবার সহ সুখারিয়াবাসী সকলেই দাবি করেন যে, এক সময়  গ্রামের পাশেই বহমান হুগলি নদী দিয়ে রানি রাসমণি যাচ্ছিলেন। তিনি নদীর তীরে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে এক মন্দির দেখতে পেয়ে নৌকা থেকে সেই মন্দির দর্শনের জন্য নেমে আসেন। এই মন্দির হল সুখারিয়ার সবথেকে প্রাচীন মন্দির  দেবী সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির। এই মন্দিরে এসে রানি লোকমুখে আনন্দভৈরবী মায়ের মন্দিরের কথা জানতে পারেন এবং সেই মন্দির দর্শনও করেন। মন্দিরটি দর্শন করে তাঁর এত ভালো লাগে যে তিনি যখন দেবীর আদেশে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির স্থাপন করেন তখন এই মন্দিরের আদলেই তা গড়ে তোলেন।

এই তথ্য কতটা প্রামাণিক তা গবেষণার বিষয়। তবে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরি হওয়ার বিয়াল্লিশ বছর আগে সুখারিয়াতে মিত্র মুস্তাফি পরিবার এই মন্দির গড়ে তোলেন। অর্থাৎ এই মন্দির দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত একথাটি সত্য। কিন্তু কখন রানি রাসমণি এসেছিলেন সেই বক্তব্য নিয়ে দ্বিমত আছে। একমতে দেবী মন্দির তৈরির আদেশ পাওয়ার পর কাশীযাত্রা স্থগিত করে ফিরে আসার পথে। কিন্তু কাশীর উদ্দেশে রওনা হয়ে অতদূর পর্যন্ত রানিমা গিয়েছিলেন এমন তথ্য রানি রাসমণির জীবনী সমর্থন করে না। দ্বিতীয় মতে কোনও এক সময় গিয়েছিলেন, কোন সময় সেই মতে স্পষ্ট নয়।

রানি রাসমণির আগমনকে কেন্দ্র করে যে প্রাচীন মন্দিরটি বিরাজমান তা যে সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির তা আমরা আগেই বলেছি। এই মন্দিরের ইতিহাস বর্ণনা শুধু রানি রাসমণি অবধি থেমে থাকেনি। লোকমতের দাবি, এই মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণও উপস্থিত হয়েছিলেন। দেবী মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে মূর্তির দুইপাশে সগৌরবে শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদাদেবীর ফোটো বিরাজ করছে। কিন্তু তাঁদের জীবনীতে সুখারিয়া আসার কোনও সম্ভাবনা বা উল্লেখ নেই।

এই মন্দিরের ইতিহাস সম্বন্ধে বলা হয়, যখন হুগলি নদী এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যেত, তখন এক সাধক নদীর তীরে এক বট গাছের তলায় সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। এই সাধক কোনও এক স্থান থেকে পাথরের তৈরি কালীমূর্তি সংগ্রহ করে আনলে মিত্র মুস্তাফি পরিবার সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মন্দির তৈরির জায়গা দান করে এবং মন্দিরটি প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ও বহন করে।

এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় আনুমানিক ১৭৮৫ সালে। সিদ্ধেশ্বরী মায়ের বৈশিষ্ট্য হল, শিবের ওপর তাঁর দুটি পা সমান্তরাল বিন্যাসে অবস্থিত থাকবে। এখানেও আমরা তা-ই দেখি। আর একটি বিশেষ জিনিস হল, যে বট গাছের তলায় সাধক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন সেই বট গাছই এখন নানা শাখায় স্থানটিকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। যদিও হুগলি নদী এখন গতিপথ পালটে সুখারিয়া গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা সরে গিয়ে বেহুলা নদীর সঙ্গে মোহনার সৃষ্টি করেছে। ফলে গড়ে উঠেছে নতুন এক দ্বীপ যা সবুজ দ্বীপ নামে বিখ্যাত।

মিত্র মুস্তাফিদের নির্মিত আরেকটি মন্দির হল হরসুন্দরী দেবীর মন্দির। শোনা যায়, ১৮১৪ সালে অনন্তরাম মিত্র মুস্তাফির আরেক পৌত্র, পুত্র তিলকরামের পুত্র রামনিধি মিত্র মুস্তাফি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরের গঠন অনেকটাই আনন্দভৈরবী মায়ের মন্দিরের অনুরূপ। তবে এই মন্দির পঁচিশ রত্ন মন্দির নয়। এই মন্দির হল নবরত্ন মন্দির। তবে মন্দিরের দুই পাশে দ্বাদশ শিব মন্দির বিদ্যমান। এর মধ্যে চারটি পঞ্চরত্ন আটটি আটচালার আকৃতিতে গঠিত। এটির আকৃতি অনেক পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক স্পর্শ পেয়েছে বলে মনে হয়। বর্তমানে এই মন্দির একপ্রকার সাধারণের জন্য খোলাই হয় না। তবে মন্দিরটি ভালোভাবে সংরক্ষিত।

এই হরসুন্দরী দেবীর মন্দিরের থেকে একটু এগিয়ে গেলে দেখা যাবে নিস্তারিণী দেবীর মন্দির। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অনন্তরাম মিত্র মুস্তাফির আরেক পৌত্র, রামনিধির ভ্রাতা কাশীগতি মিত্র মুস্তাফি। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। এই বংশের ইতিহাস বলে কাশীগতি অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান হলেও তত্কালের দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষ্মাতে আক্রান্ত হন। রোগযন্ত্রণার তীব্র কষ্টের মধ্যে কাশীগতি মায়ের কাছে মানসিক করেন, যদি তিনি সুস্থ হয়ে যান তবে তাঁর জন্য একটি মন্দির তৈরি করে দেবেন।

ভিন্ন মতে, দেবী বলেন, সুস্থ হলে মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। যাই হোক স্বপ্নাদেশ বা এই মানসিক করার কিছুদিনের মধ্যে কাশীগতির রোগমুক্তি সম্ভব হয়। তিনি রোগ থেকে নিস্তার লাভ করেছেন যে দেবীর কৃপায়, সেই দেবীকে নিস্তারিণী নামে প্রতিষ্ঠা করেন। এই দেব মন্দির কিছুটা হরসুন্দরী দেবীর মন্দিরের মতো দেখতে কিন্তু দেবী মন্দিরের পাশে দ্বাদশ শিব মন্দিরের অস্তিত্ব নেই। যদিও বলা হয়, এই দেবী মন্দির সংযুক্ত নাটমন্দির ছিল, তার সঙ্গে ছিল অতিথিশালা, মন্দিরের ভেতরে আসল রুপোর চাঁদোয়া টাঙানো থাকত। কিন্তু এখন সেসবের কিছুই নেই।

সুখারিয়া বাংলার মন্দিরময় গ্রামগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রাম। আমরা সেই গ্রামের ইতিহাস ও মন্দির সম্বন্ধে খুব কম অবহিত। আর আমরা জানি না, সেই পরিবারের কথা যে পরিবারের আত্মাভিমান হয়ে মিশে আছে বাংলার নবাব, মোগল সম্রাটের অধীনে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার ইতিহাস। ধর্মপ্রাণ এই পরিবারের নির্মিত মন্দির আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে থেকে পরিবারের গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *