কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য
জঙ্গলের কোন গাছে, কোন বৃক্ষকোটরে মধুচক্র আছে, বনের কোন এলাকায় মধু-উপনিবেশ, সেটা পাখি জানে! পাখিদের কাছ থেকে এই খবর পায় আরণ্যক শিকারিমানবরা! এবার সহজেই মৌচাক-বৃক্ষে পৌঁছে যায় শিকারিমানব। এভাবে পাখিদের সাহায্যে মানুষ মধু সংগ্রহ করে। অন্য আরও শিকারের সঙ্গে সেই মধু খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। শুনতে গল্প মনে হলেও এটি সত্য। এই পাখির নাম আফ্রিকান ‘হানিবার্ড’ বা মধুপাখি। এদের ‘হানিগাইড পাখি’-ও বলা হয়। আর এই আদিম শিকারিমানব গোষ্ঠীর নাম, ‘হাডজা’। এই হাডজারা পূর্ব আফ্রিকার উত্তর তানজানিয়ার বিস্তৃত বাবলাবন ও ঝোপঝাড়সমৃদ্ধ জল-জঙ্গল-পাহাড় ঘেরা ইয়াইদা উপত্যকার একটি ‘চরম বিপন্ন’ ও লুপ্তপ্রায় শিকারি জনজাতি। এরা আদিম ও প্রাক-সভ্য জীবন-মনন-চিন্তনের ছায়া-উপচ্ছায়ায় দাঁড়িয়েও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার নজিরবিহীন দিশা দেখিয়ে ২০১৯-এ রাষ্ট্রসংঘের মর্যাদাবাহী ইকোয়েটর পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিল। এই ইয়াইদা উপত্যকার একদিকে যেমন কিলিমাঞ্জারো পাহাড় ও ভারত মহাসাগর, তেমনি অন্যদিকে এলাকাটিকে ঘিরে আছে উগান্ডা, কেনিয়া, মোজাম্বিক ও জাম্বিয়ার মতো পৃথিবীর আদিম জনজাতি সমৃদ্ধ দেশ।
হাডজা সম্প্রদায় যেমন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, এই হানিবার্ড পাখিও প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি! কবুতরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বহুযুগ আগে থেকে উত্তর তানজানিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলের এই বন্য হানিবার্ড পাখিরা হাডজা শিকারিমানবদের বন্ধু হয়ে মানুষ ও অমানুষী প্রাণীর আদিম সম্পর্কের সাক্ষ্য হয়ে আছে। বলা হয়, আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ, হোমো-ইরেক্টাসরা যখন পাথরের অস্ত্র নির্মাণ শুরু করেছিল, সেই প্রায় ১৯-২০ লক্ষ বছর আগে, তখন থেকেই এরা হাডজা তথা মানুষের ‘বার্ডফ্রেন্ড’। ‘ইন্ডিকেটরডে’ পরিবারের ‘প্রোডোটিস্কাস’ পক্ষীবংশীয় ধূসর-সবুজ-সাদা বর্ণের ঘোলাটে এই পাখি অরণ্যাচারী মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে হাডজাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার জন্য বিশ্বের পাখিপ্রেমী ও পক্ষীবিশেষজ্ঞদের কাছে সুপরিচিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একমাত্র মালয়েশিয়ান হানিগাইড ও ইয়েলো-রাম্পড হানিগাইড পাখির সঙ্গে এদের আত্মীয়তার কথা জানা যায়। আর এই হলুদ লেজের মধুপাখি নাকি ভারত, নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারের হিমালয়ান পার্বত্য পরিবেশেও দেখা যায়। ভারত বা বাংলার পিসিফর্মিস গোত্রের কাঠঠোকরা ও বসন্তবৌরির সঙ্গেও নাকি হাডজা-সখা, হানিবার্ড পাখির দূরসম্পর্ক আছে। কিঞ্চিৎ মজা করে বলা যায়, তাহলে তো বাঙালি কাঠঠোকরা আর বসন্তবৌরির সঙ্গেও আফ্রিকান হাডজা জনজাতির বন্ধুত্বের দূরসম্পর্ক আছে!
এখন প্রশ্ন হল, এই হানিবার্ড বা মধুপাখিরা, হাডজা শিকারিদের কীভাবে জঙ্গলের গাছে থাকা মধুচক্রের কাছে নিয়ে যায়? কীভাবে তাদের মানববন্ধুদের গাইড করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখেছি, এখনও টিকে থাকা পৃথিবীর প্রাচীনতম শিকারি, হাডজা গোষ্ঠীর মানুষ সকাল হলে যথেষ্ট পরিমাণে গাঁজা সেবন করে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তিরধনুক আর একটা ছোরা নিয়ে শিকারের জন্য জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে। ইয়াইদা উপত্যকার মাটি শুখা এবং অনুর্বর হওয়ায় সেখানে কৃষিকাজ হয় না। তার ওপর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আফ্রিকার এই অরণ্যে তেৎসে মাছি বা তিকতিক মাছি নামের একধরনের সাংঘাতিক রক্তচোষা মাছি আছে। যে মাছিরা ‘স্লিপিং সিকনেস’ রোগের জীবাণু বহন করে। এরা হাডজা অরণ্যের যৎসামান্য ঘাসে ঘাসে, গুল্ম, ঝোপঝাড়ে উদ্ভিদের পাতায় পাতায়, ডালে ডালে থাকে। এদের বিষাক্ত কামড় একপ্রকার দংশনই বটে। এই রক্তচোষা মাছির ভয়ে এই বন্য উপত্যকায় তৃণভোজী পশুপালনও করা যায় না। ফলে জঙ্গলের পশুপাখি, যেমন বাঁদর, বুনোশুয়োর, বনমুরগি, বেজি, কৃষ্ণসার-হরিণ শিকার করে এবং বিভিন্ন ফলমূল, কন্দ এবং মধু সংগ্রহ করে সেগুলো খেয়ে হাডজাদের জীবনযাপন করতে হয়। মধু সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে তারা সাংকেতিক শিস দিয়ে হানিবার্ডদের ডাকে। মধুপাখির দল নীচু আকাশপথে হাডজা শিকারিমানবদের দলটিকে পথ দেখিয়ে মধুচক্র আছে এমন গাছের দিকে রীতিমতো গাইড করে নিয়ে যায়। হাডজারা গাছে উঠে চাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। পাখিবন্ধুদের সহায়তায় হাডজাদের এই মধুসংগ্রহের লোকচর্যা হাজার হাজার বছর ধরে চলছে। আফ্রিকার তানজানিয়ার হাডজাদের জঙ্গলে এটা আজও অব্যাহত। কিন্তু হানিবার্ড বা মধুপাখিরা এটা করে কেন? কারণ, বেচারা পাখিরা মানুষের ছেড়ে আসা মৌমাছির লার্ভা ও মোম খেয়ে বেঁচে থাকে। মৌচাকে মানুষের হানাদারি না ঘটলে পাখিরা তাদের খাবার পাবে কী করে? ফলে মধুপাখিরাও বারবার হাডজাদের ওইসব মধুচক্রে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু হাডজারা কি পাখিদের এই অকৃত্রিম বন্ধুত্বের প্রতিদান দেয়? অপ্রিয় হলেও সত্য হল–, ‘না, দেয় না। মানুষেরা (হাডজারা) এক্ষেত্রে পাখিদের ঠকায়! তারা মৌচাক থেকে মধুসংগ্রহের পর সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত মৌচাক-কাঠামোগুলোকে পাখিদের নজরের বাইরে রাখার জন্য সেগুলোকে কখনও পুড়িয়ে দেয়, কখনও মাটির নীচে পুঁতে রাখে। এতে মানুষের লাভ? হ্যাঁ, লাভ আছে। মৌচাকের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান না পেয়ে পাখিরা পুনরায় মানুষের শিস বা হুইসলের প্রতীক্ষা করে। ক্ষুধার্ত পাখিরা আবার মৌচাক ধ্বংসের প্রত্যাশায় থাকে। এতে হাডজারা আবার নতুন মৌচাকের সন্ধান পায়, নতুন করে মধু সংগ্রহ করতে পারে। এই ট্র্যাডিশন চলতেই থাকে। প্রাণী হিসেবে তার শ্রেষ্ঠত্বের বলে বলীয়ান মানুষ তার হীনতর অমানুষী প্রাণীবন্ধুদের ঠকায়।
কিন্তু পাখি-মানুষ সখ্যের এই প্রাকৃতিক যুগ আর কতদিন? পাখিকে ঠকাতে পারলেও মানবসভ্যতার বৈপ্লবিক অগ্রগমনকে তো বেশিদিন ঠেকানো সম্ভব নয়! ফলে হাডজারা এখন নিজেরাই সংকটের মুখে। আবার হাডজাদের সংকট মানে এই মধুপাখিদেরও সংকট।
মোটামুটি ১২০০-১৫০০ জনসংখ্যার এই শিকারিমানবদের মধ্যে বড়জোর ৩০০-৪০০ জন এখন শিকারি-সংগ্রাহকের লোকজীবন যাপন করেন। লক্ষাধিক জনসংখ্যাবিশিষ্ট নীলনদ অববাহিকার দক্ষিণ সুদান থেকে আসা ‘নিলোটিক দাতোগা’-র মতো পশুপালক ও কামার শ্রেণির প্রতিবেশী জনজাতিগোষ্ঠীর প্রভাবে তাঁদের স্বকীয়তা ও জীবনযাপনের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হচ্ছে। হাডজাদের নিজেদের অনন্য হাডজা ভাষা ও আরণ্যক লোকজীবন এখন সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে। তানজানিয়ার জাতীয় ভাষা, সোয়াহিলিকে তারা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করছে। সাম্প্রতিককালে হাডজাল্যান্ডে আন্দামানের জারোয়াদের মতোই পর্যটনের প্রসার ঘটেছে। পর্যটকরা হাডজাল্যান্ডে শিকার সাফারিতে যায়। তারা হাডজাদের মদ ও গাঁজা দেয়। হাডজারাও গায়ে আফ্রিকান বাঁদরের চামড়া জড়িয়ে জঙ্গল সাফারিতে আসা পর্যটকদের সামনে লাইভ শিকারের দৃশ্য প্রদর্শন করে। তানজানিয়ার ম্যাঙ্গোলায় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এখানকার হাডজাদের মধ্যে মদ্যপানে আসক্তি বেশি, তাদের অসুস্থতা বেশি, এমনকি তাদের গড় আয়ুও কমেছে। এদিকে, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নামে এখন হাডজাদের বংশপরম্পরাগত জমি অধিগ্রহণ চলছে। সবমিলিয়ে আধুনিক সভ্যতার তথাকথিত বিষাক্ত প্রভাব পড়ছে হাডজাদের জীবন, জীবিকা ও লোকচর্যায়। হাডজাদের নিজেদের মতেই এখন তারা ‘হামাইশোনবি যুগ’-এ এসে পড়েছে। এটা তাদের মৌখিক লোকপুরাণ অনুযায়ী চতুর্থ এবং অন্তিম যুগ। তাদের ঐতিহ্য বলে, কালের শুরুতে পৃথিবী আকাকানিবি বা জেরানিবি নামে পরিচিত লোমশ দৈত্য দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। তখন তাদের হাতিয়ার ছিল না, আগুন ছিল না। তখন তারা তাড়িয়ে তাড়িয়ে বন্যপ্রাণী শিকার করত। দ্বিতীয় যুগে, শাক্সহানিবিদের লোম ছিল না। এরা আগুনের ব্যবহার জানত, কুকুরের সাহায্যে শিকার করত। তৃতীয় যুগ ছিল হামাকোয়ানেবিদের যুগ। এই যুগেই তারা তিরধনুক আবিষ্কার করেছিল, কুঁড়েঘর নির্মাণ শিখেছিল এবং লোহার বিনিময়ে খাদ্য সংগ্রহকারী নয় এমন মানবগোষ্ঠীর কাছ থেকে ছুরি ও তিরের ফলা নির্মাণ শিখেছিল। এখন দিনকাল পালটেছে। হতে পারে, হাডজাদের এটাই তথাকথিত কলিযুগ! পাখির ওপর কর্তৃত্ব করেছিল যারা, সেই আদিম মানব, হাডজাদের ওপর এখন কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে আধুনিক ও অধিকতর উন্নততর মানুষ!
(লেখক লোকগবেষক ও সাহিত্যিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)