- তাপস সিংহ
এই ‘ইন্ডিয়া’কে চিনি না, এই ‘ভারত’কেও চিনতে চাই না!
এই ‘ইন্ডিয়া’ দৌড়ায় ‘বন্দে ভারত’কে নিয়ে, পিছনে পড়ে থাকে জেনারেল ক্লাসে লাইন দেওয়া আমআদমি। তাঁরা ভারতে থাকেন। তাঁরা ঠিক জানেন না, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ কাকে বলে। ‘ইন্ডিয়া’ যখন স্বপ্ন দেখে বুলেট ট্রেনের, ‘ভারত’-এর অনেকেই তখন দুঃস্বপ্ন দেখে, আজকের রাতটা কাটলে কাল সকালে হাঁড়িতে দেওয়ার মতো চাল থাকবে কি না।
এই ভারত লুকিয়ে থাকে গ্রামে-গ্রামান্তরে, এই ভারতের অস্তিত্ব প্রান্তিক মানুষ- আদিবাসী, বনবাসী, মূলবাসীদের মধ্যে। আর তার বাইরেও পড়ে রয়েছে, আক্ষরিক অর্থেই এই আধুনিক সমাজে যাঁদের কার্যত কোনও অস্তিত্ব নেই, সেই অগণন প্রান্তবাসী। ডিজিটাল ইন্ডিয়া এসেছে ঠিকই, কিন্তু এসেছে সমাজের সেই আলোকিত অংশের মধ্যে, যারা ‘ওটিপি জেনারেট’ করিয়ে তাদের জীবনযাত্রা মখমল-মসৃণ করতে সমর্থ।
এখানেই অনেকে রে-রে করে এসে বলবেন, কে বলল? এই যে কোটি কোটি মানুষ দিন-রাত এক করে মোবাইলে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে? যে কোনও পেশার মানুষই তো ফোন কলের থেকেও মোবাইল ডেটা কিনতে বেশি আগ্রহী। আর্থিকভাবে অনেক পিছিয়ে থাকা মানুষজনও তো সংসার খরচের মধ্যে ইন্টারনেট ডেটা কেনাকেও জুড়ে নিয়েছেন! তাহলে?
এখানেই লুকিয়ে রয়েছে আসল প্রশ্নটা। মোবাইল থেকে যাঁরা দিনভর মুখ তুলতে পারেন না, তাঁদের অধিকাংশই কি দৈনন্দিন জরুরি প্রয়োজনে তার ব্যবহার করেন? নাকি বিনোদনের নিজস্ব ‘স্পেস’ খুঁজতে গিয়ে তাঁরা আসলে ডুবে যাচ্ছেন আরও একাকিত্বে? আর যারা কৈশোর ও যৌবনের মধ্যবর্তী সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই তাদের অনেকে কি নিষিদ্ধ আনন্দের অজানা কন্দরে হারিয়ে যাচ্ছে না? তারা কি প্রকৃত অর্থে সমাজের আলোকিত অংশের শরিক?
আমরা বুঝতেও পারি না, বিপণনের নিত্যনতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে চলেছে। এ ভবজগতের সব কিছুই আসলে পণ্য। বিকিকিনির বাজার নিয়ত খুঁজে নিচ্ছে সম্ভাব্য ক্রেতা। সর্বগ্রাসী এই বাজার জানে, কীভাবে ভোগবাদী বিশ্ব তৈরি করতে হয়। এই একটি ব্যাপারেই ‘ইন্ডিয়া’ আর ‘ভারত’-এর মিল।
মাত্র কয়েকদিন আগেই আলাপ হয়েছিল রাজা নামে এক তরুণের সঙ্গে। সে আদপে জয়ন্তীর ছেলে। তবে জয়ন্তী নয়, তার সঙ্গে আলাপ ডুয়ার্সের অন্য প্রান্তে। রুটির টানে ঘর ছেড়ে তাকে চলে যেতে হয়েছে অন্যত্র। শুধু রাজাই নয়, তার মতো আরও অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে জয়ন্তী ছেড়ে যেতে হয়েছে অন্যত্র। রাজা এখন ডুয়ার্সের একটি রিসর্টে কাজ নিয়েছে। সময়-সুযোগ পেলে বাড়িতে ঘুরে আসে। এই রাজারা আদপে ‘ভারত’-এর বাসিন্দা। ‘ইন্ডিয়া’র লোকেরা তাদের রিসর্টে বেড়াতে এলে সে ও তারই মতো অন্য তরুণরা তাঁদের ফাইফরমাশ খাটায় ব্যস্ত থাকে।
এ বারেও ডুয়ার্সের আনাচকানাচ ঘোরার সময় কয়েক বছর আগের এক স্মৃতি ঝলসে উঠল। সেসময়ে ডুয়ার্সের বিভিন্ন বন্ধ চা বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাগানের শ্রমিকরা কেমন আছেন, কীভাবে কালাতিপাত করছেন, সেটা দেখাই মূল উদ্দেশ্য। বড় একটি প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠকের কাছে তা পৌঁছে দেওয়াই দায়িত্ব।
সাতসকালে একটি বন্ধ কারখানার শ্রমিক লাইনে পা দেওয়া মাত্রই লাইনের একটি ঘর থেকে বালিকা কণ্ঠের কান্নামেশা চিৎকার ভেসে এল…পরমুহূর্তেই সেই চিৎকারকে ছাপিয়ে গেল রাগার্ত মহিলা কণ্ঠ : ‘‘আর করবি কোনও দিন? আর চুরি করবি? চুরি করা জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেব!’’ সঙ্গে মারের আওয়াজ আর বালিকার ওই আর্তচিৎকার। এক ছুটে সে বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, ছেঁড়া ইজের পরা সে মেয়ে বাড়ির দাওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘‘আর কখনও খাব না। খুব খিদে পাচ্ছিল যে! আর মেরো না, খাব না।’’
তাকে এ ভাবে মারের কারণ জিজ্ঞেস করায় অত্যন্ত বিরক্ত স্বরে ওই মহিলা বলতে থাকেন, ‘‘মারব না তো কি আদর করব? ভোরের বেলা ওকে মুড়ি-জল খাইয়ে বাইরে কাজের ধান্দায় গিয়েছিলাম। পাইনি। এসে দেখি, ও সন্ধ্যায় রুটি চিবোচ্ছে। আমার আরও বাচ্চারা আছে। ও খেয়ে নিলে ওদের কী দেব?’’
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। শুধু হাতজোড় করে ওই মহিলাকে বলেছিলাম, ‘‘অতটুকু শিশু। ওকে এ ভাবে মারবেন না।’’ দেখলাম, ভয়ংকর ক্রোধ সহসা অশ্রুজলে পরিণত হল মায়ের! অস্ফুটে সেই মা শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘‘মারতে চাই না, জানেন। আসলে মারি নিজেকে। তিনটে বাচ্চার পেটে দু’বেলা খাবার দিতে পারি না। মরতে পারি না ওদের কথা ভেবেই।’’
একেই কি বলে ভারত-দর্শন? জানা নেই। দুপুরবেলায় মিনি ট্রাকে করে বাগানের কয়েকটি মেয়েকে বাইরে যেতে দেখে সঙ্গী তরুণের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ওরা কোথায় যাচ্ছে? সেই সঙ্গী বলেছিল, ভুটানের জয়গাঁ বর্ডারে, কাজে। রাতে আবার ফিরে আসবে। তার কথায় ইঙ্গিত ছিল, বন্ধ চা বাগানেও জীবন থেমে থাকতে পারে না। তাকে প্রবহমান থাকতেই হবে যে!
এ-ও তো আমার ভারতবর্ষ। আমার ভারত। প্রাবন্ধিক তথা চিন্তক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘পৌরাণিক ও গ্রাম্য দেবদেবীরা যে টিকে আছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু টিকে থাকাই কি শ্রেষ্ঠতার প্রমাণ? ধর্মের পাশাপাশি টিকে আছে অসীম দারিদ্র্য, হাঁচি-টিকটিকি নিয়ে অদ্ভুত সব কুসংস্কার, সামাজিক অনাচার। বৈজ্ঞানিক জ্যোতির্বিদ্যার জায়গা দখল করেছে জ্যোতিষশাস্ত্র, চরক-শুশ্রুত-এর আয়ুর্বেদ-এর বদলে গুরুর পা-ধোয়া জল।’’
‘ইন্ডিয়া’ নিজেও কি এ ব্যাপারে ‘ভারত’-এর থেকে আলাদা?