- দেবদূত ঘোষঠাকুর
ঠেকে শেখে মধ্যবিত্ত!
গত বছর লোকসভা ভোটের ঠিক আগে কী হয়েছিল তা জানা আছে নিশ্চয়ই। নারী দিবসে ঢাকঢোল পিটিয়ে রান্নার গ্যাসের দাম সিলিন্ডার প্রতি ১০০ টাকা কমিয়ে দিয়েছিল মোদি সরকার। ভোটবাক্সে যতটা ফায়দা তুলে নেওয়া যাবে বলে ভাবা গিয়েছিল, তা অবশ্য হয়নি। যদিও বিজেপির শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই বলছেন, ওই ১০০ টাকার ভরতুকি ২০২৪ সালের নির্বাচনি বৈতরণি টেনেটুনে পার হতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল তৎকালীন শাসকদলকে।
বিরোধী দলগুলি কিন্তু প্রথম থেকেই ওই ভরতুকিকে ‘ললিপপ’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিল। তাদের সেই আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, তা সরকারে আসার এক বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতেই রান্নার দাম সিলিন্ডার প্রতি ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেয় পেট্রোলিয়ামমন্ত্রক। ১০০ টাকা দাম কমিয়ে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ায় গৃহস্থের হাতে থাকল মাত্র ৫০ টাকা। ওই এক বছরে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বই কমেনি। আমেরিকার ৫০ শতাংশ শুল্কবোমায় জিনিসপত্রের দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে কি না তা নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা চলছে। রাশিয়া না আমেরিকা- কার থেকে তেল কিনবে ভারত তা নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যেই তেল সংস্থাগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ করে ৩০ হাজার কোটি টাকা ভরতুকি দেওয়ায় জোর ঝটকা লেগেছে ভারতীয় অর্থনীতিতে।
তবে যে বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকার পরিষ্কার করছে না, তা হল, এই ভরতুকিতে আমজনতার কোনও লাভ হবে িক না। এই বিপুল পরিমাণ ভরতুকি দেওয়ার সপক্ষে যে ব্যাখ্যা পেট্রোলিয়ামমন্ত্রক দিয়েছে তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার। ওই টাকাটা প্রাপ্তি ছিল রাষ্ট্রীয় তেল সংস্থাগুলির। ওরা এতদিন যে গ্যাস দিয়েছে তাতে এই পরিমাণ টাকা ওরা ভরতুকি দিয়েছিল। সেটাই সরকার এবার মিটিয়ে দিল। অর্থাৎ শোধবোধ। গ্রাহকদের ভাগ্যে এখনও পর্যন্ত প্রাপ্তি বড় একটি শূন্য।
একটু পরিষ্কার করে দেখা যাক, কেন এই বিপুল পরিমাণ টাকা এই অর্থনৈতিক ডামাডোলের সময় তেল কোম্পানিগুলিকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্রীয় সরকার। পেট্রোলিয়ামমন্ত্রকের দাবি, ১৫ মাস ধরে বাজারের থেকে কম দামে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করছে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন (আইওসি), ভারত পেট্রোলিয়াম (বিপিসিএল) এবং হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম (এইচপিসিএল)৷ এর ফলে তেল বিপণন কোম্পানিগুলির ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি যাতে আর না বাড়ে, তার জন্যই এই বিপুল ভরতুকির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র৷ সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, ১২ কিস্তিতে ওই ভরতুকির টাকা পাবে উপরোক্ত তিন তেল সংস্থা৷
সত্যিই কি তেল সংস্থাগুলি লোকসান হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার বেচে? একটি তেল সংস্থার এক মুখপাত্রের দাবি, গত আর্থিক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া ছিল এলপিজি গ্যাসের দাম৷ পাশাপাশি, বছরভর ওঠানামা করেছে দাম। কিন্তু গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে তাঁদের স্বস্তি দিতে এতদিন গৃহস্থের ব্যবহৃত এলিপিজির দাম বাড়ানো হয়নি৷ এদিকে, এর ফলে তিনটি তেল বিপণন কোম্পানির ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে৷ তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি গৃহস্থের ঘরে এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ চালিয়ে গিয়েছে। এবং তার দামও কিন্তু আয়ত্তের মধ্যে ছিল।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে ভারত এই মুহূর্তে বেশ চাপে রয়েছে। আমেরিকা তো আছেই, তার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানারকম বাণিজ্যিক শর্তে কিছুটা বেকায়দায় আমাদের দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপেও ভারত কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক চালিয়ে গিয়েছে। এতে আখেড়ে লাভ হয়েছে ভারতেরই। ঘুরপথে না গিয়ে সরাসরি রাশিয়ার থেকে তেল কিনেছে তারা। অপরিশোধিত তেল শোধন করে ব্যবসাও করেছে। কিন্তু এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যেই আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নরেন্দ্র মোদিকে একদিকে ভালো বন্ধু বলে জোরে জোরে হাত ঝাঁকিয়ে দিলেও, কাজের সময় অন্য খেলা শুরু করে দিয়েছেন। ট্রাম্প যে তাসটি খেলেছেন তার মোকাবিলায় ভারত কোন ছকে খেলবে, রাশিয়াকে বাদ দিয়ে আমেরিকার নির্দেশিত পথে িক না, তা এখনও সুস্পষ্ট নয়। তবে যে জিনিসটি লক্ষণীয় তা হল, ইতিমধ্যেই ভারত রাশিয়া আর চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে অনেক বেশি মতবিনিময় শুরু করেছে। ভারতের দুই প্রতিনিধি রাশিয়া থেকে ঘুরে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিনিয়ত কথা বলছেন পুতিনের সঙ্গে। আর এ মাসের শেষে মোদি স্বয়ং যাচ্ছেন চিনে।
আর এই টালমাটালের সময়টা ভারতীয় তেল কোম্পানিগুলি যেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে, অর্থাৎ আমার আপনার বাড়িতে যাতে গ্যাসের জোগান বন্ধ না হয়ে যায়, দামও নাগালের মধ্যে থাকে তার জন্য এই বিপুল পরিমাণ ভরতুকি। পেট্রোলিয়ামমন্ত্রক সূত্রে বলা হয়েছে, এই ভরতুকির ফলে তিনটি তেল কোম্পানি অপরিশোধিত তেল আর এলপিজি-র প্রয়োজন মেটাতে পারবে৷ এছাড়া ঋণ শোধ করা থেকে শুরু করে পুঁজির স্থায়িত্বও বজায় রাখতে পারবে। এমতাবস্থায় দেশজুড়ে গৃহস্থের ঘরে ঘরে এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহে কোনও বিঘ্ন ঘটবে না৷ ভরতুকির টাকায় এই বণ্টন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করবে পেট্রোলিয়ামমন্ত্রক৷ আন্তর্জাতিক বাজারে কোনও পরিবর্তন হলে সেই দায় যাতে গ্রাহকদের উপর না পড়ে, তার জন্যই নাকি এই ব্যবস্থা- বলছে পেট্রোলিয়ামমন্ত্রক।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এই আশ্বাসে চিঁড়ে ভিজবে কি? কারণ, যেসব দরিদ্র মানুষ প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনায় নাম লিখিয়েছেন তাঁদের উপরে ইতিমধ্যেই কিন্তু ওই ভরতুকির প্রতিঘাত এসে আছড়ে পড়েছে। ওই যোজনায় গত আর্থিক বছর পর্যন্ত দরিদ্র মানুষেরা বছরে ১২ বার সিলিন্ডার প্রতি ৩০০ টাকা করে ভরতুকি পেতেন। চলতি আর্থিক বর্ষে এই খাতে ১২ হাজার কোটি টাকার ভরতুকি মঞ্জুর করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু ‘প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা’ প্রকল্পের মানুষেরা এখন আর বছরে ১২ বার ৩০০ টাকা ভরতুকির সিলিন্ডার পাবেন না। তাঁরা মাত্র ৯ বার ৩০০ টাকা ভরতুকির গ্যাস নিতে পারবেন। বাকি তিনবারের জন্য ভরতুকির পরিমাণ হবে সাধারণ গ্রাহকদের মতো।
পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, এপ্রিল মাসে আমজনতার জন্য বণ্টন করা প্রতিটি সিলিন্ডারের দাম যখন ৫০ টাকা বেড়ে ৮৭৯ টাকা হল, তখন সিলিন্ডার পিছু ৫০ টাকা করে দাম বেড়েছিল উজ্জ্বলা প্রকল্পেও। উজ্জ্বলা প্রকল্পে রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫০ টাকা। অর্থাৎ সেখান ভরতুকি কমেছে। গৃহস্থের বাড়ির গ্যাসের দাম বাড়লেও, গত এপ্রিল মাসেই তেল কোম্পানিগুলি বাণিজ্যিক এলপিজি সিলিন্ডারের দাম কমিয়েছে। একটি ১৯ কেজি বাণিজ্যিক এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৪১ টাকা কমানো হয়েছে। তাতে রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম কমেছে বলে কিন্তু কোনও খবর নেই। এই দাম কমানোর প্রভাব আমজনতার উপরে পড়ছে কি না এমন কোনও সমীক্ষার হদিস কিন্তু এখনও পাইনি।
আর এসবেই কিন্তু প্রমাদ গুনছেন গ্রাহকরা। তাঁদের হেঁশেলে কবে কোন খাঁড়া নেমে আসে সেই দুশ্চিন্তা গ্রাস করেছে তাঁদের।
(লেখক সাংবাদিক)