শান্তনু বসু
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলায় এমন কিছু মানুষ জন্মেছেন, পরবর্তী সময়ে বাংলা সাংস্কৃতিক জগতে যাঁরা দৃষ্টান্তমূলক অবদান রেখেছেন। নচিকেতা ঘোষ তাঁদেরই একজন। সুরকার হিসেবে তিনি এত বৈচিত্র্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন, যার সব কিছু নিয়ে আলোচনা করতে গেলে হয়তো একটা গোটা খবরের কাগজ জুড়ে লিখলেও শেষ হবে না।
(১)
আজকের এই আলোচনার প্রথমেই নচিকেতা ঘোষের সৃষ্টি সৌজন্যের যে দিকটির প্রতি দৃষ্টিপাত করবার চেষ্টা করব, সেটি হ’ল শিল্পী অনুযায়ী ওঁর গান নির্বাচন বা গান তৈরি করবার অনন্য ক্ষমতা। সংগীত জগতে প্রায় তিন দশকের উপর কাজ করবার পরে এবং নিজে সুরের কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি যে, কোন গান কাকে দিয়ে গাওয়ালে ঠিক ঠিক ফল পাওয়া যাবে সেটা নির্ধারণ করাটা একজন সংগীতকারের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এবং এই কাজটি সুরকার নচিকেতা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং সফলভাবে সারা জীবন ধরে করে গেছেন।
সত্তরের দশকের ছবি ‘সন্ন্যাসীরাজা’। ছবির নায়ক উত্তমকুমার। সুরকার নচিকেতা। সেই সময় উত্তমের লিপের সব গান মান্না গাইছেন। এই ছবিতেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। ছবির হিরো উত্তমকুমার জমিদারের রোল করছেন। ছবিতে দেখছি সেই জমিদার শুধুমাত্র সংগীতরসিক নন, সুগায়কও বটে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যার মজলিশ জমে উঠছে জমিদারবাবুর নিজের গানে। সেইসব মজলিশি মেজাজের গান মান্না দে’কে ভেবেই তৈরি করেছেন সুরকার। কারণ সেইসব গানে একদিকে যেমন ছিল ভারতীয় রাগসংগীতের ঠুংরির মেজাজ, অন্যদিকে ছিল ছায়াছবির উপযুক্ত উপস্থাপনা। এ কথা অনস্বীকার্য যে রাগাশ্রিত বা ক্ল্যাসিকাল অঙ্গের গানকে আধুনিকতার মোড়কে মুড়ে মান্না দে যেভাবে গেয়ে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন তার জুড়ি মেলা ভার। আর তারই পূর্ণাঙ্গ রূপ আমরা পাই সন্ন্যাসীরাজা ছবির ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’, থেকে শুরু করে ‘ভালোবাসার আগুন জ্বালাও’, ‘ঘর সংসার সবাই তো চায়’ প্রমুখ সব গানে। প্রতিটি গানই এক একটি হীরক খণ্ড।
আশ্চর্যের বিষয় হল এই সমস্ত গানই ছিল ছবির প্রথমার্ধে অর্থাৎ ‘বিশ্রাম’-এর আগে। ‘বিশ্রাম’-এর পরে ছবির নাটকীয়তায় আমরা দেখি গ্রামের মানুষ তখন জানেন যে জমিদার মৃত। এমন সময় পর্দায় দেখা যায় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর ধার দিয়ে দূর থেকে কয়েকজন অনুজ সন্ন্যাসীকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ কেশযুক্ত ঋজু লম্বা একজন সাধু গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দেবকণ্ঠ মারফত ভেসে আসছে শঙ্করাচার্য রচিত শ্লোক ‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্রহঃ, সংসারহয়ম অতীববিচিত্রহঃ’। আজকের প্রেক্ষিতেও এক অসামান্য দৃশ্যকল্প।
সারা ছবিতে তিনি ব্যবহার করলেন মান্না দে’র গায়ন শৈলীর বিশেষ দক্ষতাকে। কিন্তু যখনই গাম্ভীর্যের ব্যাপার এল তখনই তিনি ডাকলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। কেন? মান্না দে কি ওই স্তোত্রটা গাইতে পারতেন না? নিশ্চয়ই পারতেন। কিন্তু তিনি নচিকেতা ঘোষ। তিনি সবসময় সেরা ফলের প্রত্যাশা পূরণের তাগিদে কাজ করে গেছেন।
হেমন্ত ও মান্না, দুজন শিল্পীই ছিলেন নচিকেতার অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে দুজনকেই তিনি এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যাতে করে দুজনেরই শ্রেষ্ঠত্বের ভিন্ন ভিন্ন দিক আমরা পেয়েছি। এক্ষেত্রেও সংবেদনশীল সুরকার হিসেবে নচিকেতা অনুভব করেছিলেন যে ওই স্তোত্রের সিচ্যুয়েশানে গায়কের দক্ষতার থেকেও গায়কের কণ্ঠের চরিত্রের গান্ধর্ব প্রতিভা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ বা ইম্পালসিভ করে তুলবে সমগ্র সিচ্যুয়েশনকে। ভাবনা যে একেবারে অব্যর্থ ছিল, এখন আর তা বলে বোঝাবার অপেক্ষা রাখে না।
(২)
এবারে আসি নচিকেতার আর একটি বিশেষ দিকের আলোচনায়। সেটি হল সুরকার হিসেবে তাঁর আত্মবিশ্বাস। গল্পটি প্রখ্যাত শিল্পী নির্মলা মিশ্রের কাছ থেকে শোনা।
সেই বছর এইচএমভি থেকে নির্মলা মিশ্রকে যা বলা হল তার ব্যাখ্যা এইরকম যে, ওই বছর নির্মলাদির গান যদি সেভাবে বিক্রি না হয় তাহলে কোম্পানির পক্ষে আর ওঁর গান রেকর্ড করা সম্ভব হবে না। ওই বার্তা পেয়ে হতাশ নির্মলা কী করবেন ভেবে পান না। হঠাৎ কী মনে হল সোজা চলে গেলেন নচিকেতার বাড়িতে। প্রায় কাঁদো কাঁদো নির্মলার কাছ থেকে সব শুনে নচিবাবু বললেন, “যা, এখন বাড়ি চলে যা। এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি তোকে কয়েকদিন পরে ডাকব।’’
কয়েকদিন পরে সেই ডাক এল। স্নেহের ‘ঝামেলা’ (নির্মলাদিকে এই নামেই ডাকতেন নচিকেতা ঘোষ)-র জন্য গান তৈরি করেছেন নচিবাবু। এইচএমভি স্টুডিওতে যেদিন সেই গান রেকর্ড হয়েছিল সেদিন রেকর্ডিং শেষে স্টুডিওতে দাঁড়িয়ে নচিকেতা ঘোষ নির্মলা মিশ্রকে বলেছিলেন, “ঝামেলা, তোর সারা জীবন ধরে গাওয়ার একটা গান আজ দিয়ে দিলাম।’’ সত্যিই তাই। যতদিন নির্মলাদি গান গেয়েছেন ততদিন সেইদিনে রেকর্ড হওয়া ‘এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না’ গানটা না গেয়ে তিনি স্টেজ থেকে নামতে পারেননি। একজন সৃষ্টিকারের তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি এই মাত্রার আত্মবিশ্বাস সচরাচর মেলা ভার।
একই ঘটনা ঘটেছিল পিন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এক তাজমহল গোড়ো’ গানের সময়।
(৩)
বাংলা সংগীত জগতে বেসিক রেকর্ডের গানের সুরকার হিসেবে ও সিনেমার গানের সুরকার হিসেবে সমান সফল এরকম যে ক’জনার নাম করা যায় তার মধ্যে অন্যতম নচিকেতা ঘোষ। তিনি যখন সিনেমার গান তৈরি করছেন তখন তিনি সেই গানের দৃশ্যকে সংগীতায়ন করছেন। আবার যখন বেসিক গানের সুর করছেন তখন তিনি গান দিয়ে শ্রোতার মনে ছবি আঁকছেন। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রের জন্যই গান অনুযায়ী শিল্পী নির্বাচন করবার ক্ষমতা যে ওঁর শৈল্পিক জীবনে তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করেছে সে কথা বারংবারই বলতে হয়। তারই জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে মেলে ধরা যায় মান্না দে’র গাওয়া ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝরো না গো’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘লজ্জা, মরি মরি এ কি লজ্জা’, গীতা দত্তের ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে’, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বনে নয় মনে মোর’, শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘পুতুল নেবে গো’, বা তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘চল রীণা’ সহ এক দীর্ঘ তালিকা। এই সুদীর্ঘ তালিকা পথে অবশ্য স্থানযোগ্য একটি গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া –
‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে
পান্থ পাখির কূজন কাকলি ঘিরে
আগামী পৃথিবী কানপেতে তুমি শোনো…”
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, নচিকেতা ঘোষের সুরে হেমন্তের গাওয়া এই গান এমন এক সৃষ্টি যাকে লিখে প্রকাশ করা সত্যিই দুরূহ। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, নচিকেতা ঘোষ গত হলে একটি পত্রিকায় এই গানটি প্রসঙ্গে হেমন্তের কথা, “গান ও সুরের মধ্যেই তাঁর ও আমার একটা আত্মার আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। …এই গানটির সুর কোনওদিনই ভুলতে পারব না। আমি ওঁর প্রতি সত্যিই কৃতজ্ঞ। আসলে ওঁর গানের স্বরলিপিই লেখা থাকবে চিরদিন, আগামী পৃথিবী কান পেতে তা শুনবেও।’’ এক মহতের এই স্মৃতিরোমন্থন দিয়েই শেষ হোক শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা নচিকেতা ঘোষের প্রতি পেশ করা এই সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য।