মৌমিতা আলম
এপ্রিল মাসের রোদ যেন হার মানাচ্ছে জুনের তাপপ্রবাহকে। যেদিন শীর্ষ আদালতের কলমের খোঁচায় চাকরিচ্যুত হলেন ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, সেদিনের কথা। টোটোয় কর্মস্থলে যেতে যেতে দেখলাম, এক মা তাঁর মেয়েকে রাস্তা পার করিয়ে দিচ্ছেন। মেয়েটি রুগ্ন, শীর্ণ। পায়ের জুতো জোড়া স্কুল থেকে পাওয়া। ব্যাগটাও। মা-মেয়ে হয়তো তখনও জানে না খবরটি। খুদে হয়তো স্কুলে গিয়ে দেখবে, তার প্রিয় দিদিমণির চেয়ার ফাঁকা। যে দিদিমণির মতো হতে চায় সে। কতটা বড় ধাক্কা বলুন তো, যখন একটা শিশুমন জানতে পারবে, তার রোল-মডেল নাকি টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার দলে। মেয়েটি নিজের রোল-মডেলকে হারিয়ে ফেলবে। হয়তো তিনি টাকা দেননি, কিন্তু সবাই মিলেমিশে একাকার এখন।
রাজ্য এখন সরগরম সুপ্রিম রায় নিয়ে। কোনও নেতা মুচকি হাসছেন, কোনও নেতা দিচ্ছেন আশ্বাস। কেউ বুক ঠুকে বলছেন, ‘আমি জেলে যেতেও তৈরি।’ আর নিভৃতে, নিঃশব্দে কিছু স্কুল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একেতেই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত ভারসাম্যহীন। নিয়োগ অনিয়মিত। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা পড়ল এবার। শিক্ষাকর্মীর অভাবে শিক্ষক গেট খুলছেন, প্রাক্তন শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন, বিএড ডিগ্রিধারীদের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে স্কুলকে, সরকার ভলান্টারি সার্ভিস দিতে বলছে। অথচ এগুলোর একটিও স্থায়ী সমাধান নয়। সমাধান স্থায়ী না হলে ক্ষত কমে না, বরং বাড়ে।
২০২৩ সালেই শুধু বন্ধ হয়েছে আট হাজারের বেশি বিদ্যালয়। এই যে বিশাল অংশের যাঁরা চাকরি হারালেন, তাঁরা মোট শিক্ষক সংখ্যার প্রায় ১১.৪ শতাংশ। এতজনের চাকরি চলে যাওয়ায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আরও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার মুখে। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর পুরোপুরি নির্ভর আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণি। একসময় সরকারি স্কুলগুলো ছিল রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র। আট-নয়ের দশকে মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত ঘরের একাংশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত হয়ে ওঠা এই ব্যবস্থার ওপর নির্ভর ছিল।
স্কুল সার্ভিস কমিশন ও মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন গঠনের পর রাজ্যের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা আরও পুষ্ট হয়। গ্রামের স্কুলগুলোতে গমগম করত টিচার্স রুম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থায় ঘুণ ধরতে শুরু করে। অনিয়মিত হয়ে পড়ে নিয়োগ। আর নিয়োগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে ‘দুর্নীতি’ শব্দটি। স্বেচ্ছাচারিতা আজীবন চলতে পারে না। কেলেঙ্কারির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যাওয়ার ফল এখন পুরো প্যানেল বাতিল। এর প্রভাব গ্রামীণ স্কুলে আরও মারাত্মকভাবে পড়বে।
প্রায়ই শোনা যায়, ছাত্র নেই, স্কুল বন্ধ হবে না তো কী হবে! কিন্তু কেন টানা কমছে ছাত্র সংখ্যা? অনিয়মিত নিয়োগের ফলে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমে যাওয়া আর সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়নে সরকারেরই গা-ছাড়া মনোভাব প্রশস্ত করেছে বেসরকারিকরণের রাস্তা। অনেক মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত আবার হাই তুলে বলেন, বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে। অথচ যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, তাদের ছেলেমেয়েরা কি ওই ‘ভালো পরিষেবা’র ছোঁয়া পাচ্ছে? আমরা সবাই চাই, তোমার শিশুর ভালো হোক। কিন্তু তোমার সোনার সমবয়সি যে পাশের বস্তিতে থাকে, তার কথাও তো ভাবতে হবে তোমাকে।
শিল্প ছাড়ুন, একশো দিনের কাজও নেই রাজ্যে। বাংলা থেকে দেশের নানা প্রান্তে পরিযায়ী শ্রমিক ও ডোমেস্টিক ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করতে যায় এক বিরাট অংশের লোক। এদের বাচ্চাদের বেসরকারি স্কুলে পড়ানো দিবাস্বপ্ন। বিলাসিতা। সামাজিক শ্রেণি কাঠামোয় এদের ওপরে ওঠার একমাত্র সিঁড়ি সরকারি শিক্ষা। সিঁড়িটা যেভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, একটা একটা করে অংশ খুলে পড়ছে, তাতে মঞ্চে ওঠার আগেই পড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। একটি স্কুলের সঙ্গে শুধু প্রথাগত শিক্ষা নয়, জড়িয়ে থাকে শিশুর স্বাস্থ্য। মিড-ডে মিল থেকে পুষ্টির জোগান পায় সে।
একদিক দিয়ে ভালোই হলো রাষ্ট্রের। স্বাস্থ্য তো বেসরকারি বস’দের হাতের মুঠোয় এখন। যেতে বসেছে শিক্ষাও। শুধু কিছু সংখ্যক অসহায় অভিভাবকের কথা কানে ভাসে, ‘হামার আর কী দিদিমণি! কামলার ব্যাটা কামলা, মিস্ত্রির ব্যাটা মিস্ত্রি হবে। হামার অত স্বপ্ন দেখি লাভ নাই।’
সরকারি স্কুলে পঠনপাঠনে ব্যাঘাত মানে একঝাঁক স্বপ্নে বাধা। প্রতিষ্ঠান বন্ধ মানে তো স্বপ্নের মৃত্যু। বাড়বে বাল্যবিবাহ। পরিবারের কাছে একটি বাচ্চার শিক্ষা কেনার ক্ষমতা থাকলে, পিতৃতন্ত্রশাসিত কাঠামোয় পরিবারটি শিক্ষা কিনবে ছেলে বাচ্চার জন্য। মেয়ের জন্য নয়। অনেক শূন্য স্কুলে বেল বাজবে না, মাঠে শিশুরা ছুটে বেড়াবে না, লাইন দেবে না মিড-ডে মিলের জন্য। দেশের উন্নতিতে সবার জন্য শিক্ষা যে কতটা জরুরি, তা হয়তো দুর্নীতিতে নিমজ্জিত রাষ্ট্র জানে না, জানতে চায়ও না। শিক্ষার অন্তর্জলিযাত্রার সাক্ষী হয়ে আমরা শুধু হাই তুলছি আর পোস্ট করছি। উদাসীনতায় বাঙালিকে একমাত্র হার মানাতে পারে মাঠে ঘাস চিবানো গোরু।