বাংলার আকাশে শরতের হাওয়া। বঙ্গোপসাগরে আগমনীর ঢেউ। সেই স্রোত বুঝি এসে পৌঁছেছে বাল্টিক সাগরের তীরেও। দেবীর মর্ত্যে আগমনে সাজছে ডেনমার্ক। ‘বেঙ্গলিজ ইন ডেনমার্ক’-এর ১৩ বছরের পুজোয় সাজছে কোপেনহেগেন। বাল্টিকের তীর থেকে লিখলেন ড. অনামিকা বিশ্বাস।
বাঙালি মানেই আড্ডাপ্রেমী। আবেগপ্রবণ। আর যেখানে বাঙালি, সেখানেই মা দুর্গা। ঠিক তেরো বছর আগে, শারদীয়ার প্রাক্কালে এক জটলায় গুটিকয়েক প্রবাসী বাঙালির মন মোচড় দিয়েছিল পুজোয় বাড়িতে ফিরতে না পারা যন্ত্রণায়। তাঁদের না হয় ছুটি নিয়ে ঘরে ফেরা হল না, কিন্তু তা বলে মাকে কি আনা যায় না নিজেদের কাছে? যেমন ভাবনা, তেমন কাজ।
সালটা ২০১৩। মৃৎশিল্পী মোহনবাঁশি রুদ্রপাল ও প্রদীপ রুদ্রপালের হাতের ছোঁয়ায় প্রতিমা পেল প্রাণ। কৈলাস ছেড়ে উমা শুধু বঙ্গে নয়, পাড়ি দিলেন সমুদ্র পেরিয়ে প্রবাসেও। তরী এসে নোঙর করল বাল্টিক সাগরের তীরে। সূচনা হল ‘বেঙ্গলিজ ইন ডেনমার্কে’র দুর্গোৎসবের। যা আজ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বৃহত্তম শারদোৎসব।
বছর দুয়েক আগে বাংলার প্রান্তিক গ্রাম করিমপুর থেকে আসা এই নর্ডিক দেশে আসা। তারপরই আমি ও কর্তামশাই জুড়ে গেলাম এই পুজোর সঙ্গে। পুজোর ঠিক আগে এই শহরে পৌঁছছিলাম। মন খারাপ। সঙ্গে শঙ্কা মায়ের দর্শন হবে তো। হল, তবে শুধু মায়ের দর্শনই নয়। পুজোয় হাত লাগানো থেকে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান, সিঁদূর খেলা, সবেতেই মিশেগেলাম। মনেই হল না হেথায় আমি নতুন।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট তথা প্রধান পুরোহিত দেবর্ষি মুখোপাধ্যায় বলেন বাঙালির দুর্গোৎসব ‘সার্বজনীন।’ প্রবাসের মাটিতেও বাঙালিয়ানার সেই মূলমন্ত্র যেন কোনও অংশে ম্লান না হয়, তার দিকে ক্ষুরধার দৃষ্টি রাখেন এই অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যুক্ত সকল সদস্যবৃন্দ। লিঙ্গসাম্যের কথা মাথায় রেখে, দেবী-মায়ের আরতিতে যেমন সামিল হন মহিলা পুরোহিত। তেমনই দশমীতে মায়ের বরণে যোগ দেন সধবা-বিধবা নির্বিশেষে সকলে।
স্বামী বিবেকানন্দ তথা বেলুড় মঠের মার্গ অনুসরণ করে মহাষ্টমীর পুণ্যলগ্নে অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পুজো। জাতি-ধর্ম-বর্ণের বাধা সরিয়ে অংশ নেয় বাঙালি। বাদ যান না অবাঙালি, এমনকী ডেনিশ ‘গৌরী’রাও। পুজোয় অংশগ্রহণকারী অবাঙালি তথা বিদেশি দর্শনার্থীদের কথা মাথায় রেখে পুষ্পাঞ্জলির প্রতিটি সংস্কৃত মন্ত্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হয় ইংরাজিতে। পুজোর সূচনালগ্নের সদস্যা নবনীতা নন্দী ঘোষের কথায়, “বেঙ্গলিজ ইন ডেনমার্ক-এর দুর্গাপুজো শুধুই বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক-বাহক নয়। বরং এই চারদিন পুজো মণ্ডপ হয়ে ওঠে ডেনমার্ক ও বাংলা তথা ভারতের মেলবন্ধনের তীর্থক্ষেত্র। তাতে শিলমোহর পড়ে ড্যানিশ কালচারাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর বেন্তে ওল্ফ ও ভারতের রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে।
প্রতি বছরেরই মতোন এবারেও পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে মাস কয়েক আগে থেকেই। রামচন্দ্রের অকালবোধনের রীতি মেনে দেবীকে উৎসর্গ করা হয় ১০৮-টি পদ্ম। ইতিমধ্যেই মণ্ডপের সাজসজ্জার কাজের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলছে নাচ, গান, নাটকের মহড়া। অষ্টমীর দুপুরে খাবার পরিবেশনার দায়িত্বে থাকে “বেঙ্গলিজ ইন ডেনমার্ক”-এর প্রমিলা বাহিনী। এদিকে ম্যাগাজিনের জন্য জমা পড়তে শুরু হয়েছে কবিতা-গল্প-ছবির পসরা। এবছর থেকে নতুন উদ্যোগ “খুদে ভলেন্টিয়ার।” বড়দের তত্ত্বাবধানে পুজোর কাজে সক্রিয়ভাবে হাত লাগাবে এই ভবিষ্যতের কাণ্ডারিরা।
সব মিলিয়ে কোপেনহেগেনের দুর্গোৎসব শুধু দেবীপুজোই নয়, প্রবাসে থেকেও বাঙালিয়ানার আবেগ ধরে রাখার এক ঐকান্তিক প্রয়াস। প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে, আর হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র দিনের অপেক্ষা, তারপরেই আমরাও মেতে উঠব উৎসবে, আনন্দে, হুল্লোড়ে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন