বাঙালির কুম্ভ

বাঙালির কুম্ভ

খেলাধুলা/SPORTS
Spread the love


শেষ হল বাঙালির ‘চতুর্দশ পার্বণ’ বইমেলা। বিধাননগরে বারোদিন ধরে চলছিল এই উৎসব। যাকে ‘বাঙালির কুম্ভমেলা’ বলে আখ্যা দিয়ে গেলেন এক বিদেশি রাষ্ট্রদূত। ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ মাত্র ৫৪টি স্টল নিয়ে শুরু হয়েছিল বাঙালির এই পার্বণ কলকাতা বইমেলার। বিড়লা তারামণ্ডলের উলটো দিকের মাঠে যার পথ চলা শুরু। এই ৪৯ বছরের পথ চলায় মিলেছে ‘আন্তর্জাতিক’ তকমা। আগামী বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার ৫০ বছর।

যার জন্য এবারের বইমেলার শেষদিনে বিধাননগর পুরসভার কাছে পরের বারের জন্য এক মাস আগে মাঠ চেয়ে রাখল আয়োজক সংস্থা কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। ২০২৬-এ মনের মতো করে মেলা প্রাঙ্গণ সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এই দীর্ঘ যাত্রাপথ কেমন ছিল? কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মেলায় সর্বাধিক প্রকাশনী সংস্থা ১,০৫৭টি অংশ নিয়েছিল।

অর্থাৎ শুরুর দিন থেকে এই বছর পর্যন্ত এক হাজার তিনটি স্টল বেড়েছে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আরও বহু প্রকাশনা সংস্থাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাদ দিতে হয়েছে বলে গিল্ড সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের দাবি। এবার হাজারেরও বেশি লিটল ম্যাগাজিন মেলায় টেবিল পেয়েছে। না পাওয়ার সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। আড়েবহরে ক্রমাগত বাড়তে থাকা কলকাতা বইমেলার জনপ্রিয়তার হাত ধরে আশির দশকে জেলায় জেলায় বইমেলা সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।

পরে তা মহকুমা, ব্লক পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এখনও সেই সংস্কৃতি বজায় রয়েছে। বইমেলা মানে পাঠকের মুক্তাঞ্চল। তাঁদের এক টুকরো স্বাধীন পৃথিবী। পাঠক, প্রকাশন, বই বিক্রেতা, লেখক, উদ্যোক্তা সবার হুটোপাটিতে মনে হয়, এই পুণ্যভূমির ধুলো মাখার এটাই হয়তো শেষ সুযোগ। সেজন্যই হয়তো ২০২৫-এ ‘থিম কান্ট্রি’ জার্মানির রাষ্ট্রদূত ফিলিপ আকারম্যান মেলার মাঠে দাঁড়িয়ে বলতে বাধ্য হন, ‘বইমেলা বাঙালি ঘরানার কুম্ভমেলা।’

পুরাণ মতে, প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর সংগমে স্নান করলে অক্ষয়-মোক্ষ লাভ হয়। লাখো মানুষের ‘পদধূলি’ মেখে জ্ঞান-মোক্ষ লাভ করে বইমেলা। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষের হাতে হাতে অ্যানড্রয়েড কিংবা আইফোন। জেনারেশন-জি ও ৪০ বছরের কমবয়সি মিলেনিয়ালদের মনোজগতের খোঁজ পাওয়া এখন গবেষণার বিষয়। এজন্য সমীক্ষক নিযুক্ত করে তাঁদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ফরমায়েশি বই লিখিয়ে নেন বহু প্রকাশক।

এ তথ্য মনগড়া নয়, মেলার মাঠে দাঁড়িয়ে দিল্লির এক প্রকাশকের সহজ স্বীকারোক্তি। যতই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রহস্য-রোমাঞ্চ বা ভৌতিক সিরিজে তরুণ প্রজন্ম মজে থাকুক না কেন, তারা যে বই পড়ছে মেলার মাঠে বেচাকেনা তার প্রমাণ। কলকাতার এক স্বনামধন্য সাংবাদিক-লেখকের দাবি, বর্তমান প্রজন্ম যদি বইয়ের জগতে না ঢুকত, তাহলে মেলায় এত মানুষ আসত না। মেলায় সমবেত মানুষের ৭০ শতাংশ তরুণ প্রজন্ম। তাঁরা বইমুখো না হলে এত বই বিক্রি হত না।

গিল্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-এর বইমেলায় ২৫ লক্ষ মানুষ ছিলেন। ২০২৪-এ সংখ্যাটি হয় ২৯ লক্ষের কিছু বেশি। চলতি বছরের মেলায় সব রেকর্ড গুঁড়িয়ে বারোদিনে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান। এই ক’দিনে মেলায় প্রায় ২৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে বলে গিল্ডের দাবি। বেশ কয়েকজন প্রকাশক জানালেন, ফি বছর স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ের বাইরে ভিন্ন স্বাদের বই বিক্রি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার।

এটা শুধুমাত্র পাঠকের ব্যক্তিগত সংগ্রহের হিসাব। এর বাইরে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতের সংগ্রহ। সবমিলিয়ে বছরে আটশো থেকে হাজার কোটি টাকার বইয়ের ব্যবসা হয়। যে কোনও উৎসবের পিছনে থাকে ব্যবসায়িক লক্ষ্য। পিছিয়ে থাকে না বইমেলা। সেজন্যই হয়তো কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়ে উঠেছে বাংলার অন্যতম জাতীয় উৎসব। পেয়ে গেল ‘কুম্ভমেলা’-র তকমাও।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *