বাংলায় পুজো-অর্থনীতি এক লক্ষ কোটি ছাড়াচ্ছে, উপকৃত ৫ কোটি মানুষ

বাংলায় পুজো-অর্থনীতি এক লক্ষ কোটি ছাড়াচ্ছে, উপকৃত ৫ কোটি মানুষ

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


কৃষ্ণকুমার দাস: বাংলা তথা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো এবছরও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে ‘সংস্কৃতির শিল্প ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি’র সোপানের শীর্ষে পৌঁছে গেল। বণিকসভাগুলির তথ্য, শুধু বাংলা নয়, ভিনরাজ্যের কয়েক লক্ষ মানুষকেও লাভবান করছে বাংলার দুর্গোৎসব। ভবতোষ সুতার, সুশান্ত পাল, প্রদীপ দাস, পরিমল পাল থেকে শুরু করে সমস্ত শিল্পী ও উৎসবে যুক্ত ডেকোরেটর-আলো ও বিজ্ঞাপন জগতের বিশিষ্টরা স্বীকার করে নিলেন, পুজোর কল্যাণে দেশ-বিদেশে সৃষ্টিধর্মী-বৈচিত্রময় কাজের ‘অফার ও অর্ডার’ দুইই পাচ্ছেন পুজো-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার শিল্পী-শ্রমিক-কর্মচারী। প্রচুর বিদেশি ও ভিন রাজ্যের পর্যটক বাংলায় এসে শিল্পীদের অপূর্ব সৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রচুর সৃজনশীল কাজের বরাত দিয়েছেন। টালা প্রত্যয়, সুরুচি, চেতলা অগ্রণী, হাতিবাগান, কাশী বোস লেন, শ্রীভূমি, সমাজসেবী, ত্রিধারা, দমদম পার্ক, কেন্দুয়া শান্তি সংঘ শুধু নয়, বাংলার অন্তাজ গ্রামের পুজো মণ্ডপের প্রভাবে শ্রীবৃদ্ধি ঘটল রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনীতির। এবছর সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে বাংলার গারমেন্টস ও ফুড-ইন্ডাস্ট্রি। তাৎপর্যপূর্ণ হল, শুধু কলকাতা কেন্দ্রিক নয়, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি, আসানসোল, পুরুলিয়া, বহরমপুর, মালদহ-কোচাবিহারের মতো এ বণিকসভাগুলির রিপোর্ট, জেলাতেও পুজোকেন্দ্রিক ব্যবসা আগের তুলনায় শহরের কয়েকগুণ বেড়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবছর পুজো থেকে আয় বেড়েছে বাংলার ৪ কোটি ৯০ লক্ষের বেশি মানুষের। বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স, মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্স, ফসমি, ভারত চেম্বার অফ কমার্স-সহ বিভিন্ন বণিকসভা মঙ্গলবার অষ্টমীর – সন্ধ্যায় স্বীকার করেছেন, “গতবছর ৮০ = হাজার কোটির বেশি বাণিজ্য ছিল পুজোকে ঘিরে। এবছর মুখ্যমন্ত্রীর পুজো অনুদান বৃদ্ধি ও রাজ্য সরকারের গুচ্ছ সিদ্ধান্তের জেরে সেই লক্ষ্যমাত্রা ১ লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিপুল কেনাবেচার জেরে জিএসটি থেকেও প্রচুর আয় হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের।” তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হল, এবছর সোশাল মিডিয়ায় রিল বানিয়ে ও বিভিন্ন সংস্থা ও দোকানের বিজ্ঞাপনে ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসাবে কাজ করে কয়েক কোটি টাকা রোজগার করলেন বাংলার লক্ষাধিক ছেলেমেয়ে। পিছিয়ে নেই টলিউডের বিনোদন শিল্প। একসঙ্গে চারটি ছবি রিলিজ ও তাকে ঘিরে প্রচারের রোজগার করেছেন টলিপাড়ার কয়েক হাজার শিল্পী-কলাকুশলী।

মেদিনীপুর, নদিয়া, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম থেকে শুরু করে উত্তরের জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দিনাজপুর, আলিপুরদুয়ারে ঘরে বসে শিল্পীদের তৈরি করা গয়না-হস্তশিল্প পুজোর-বাজারে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। মেদিনীপুরের গয়না বড়ি এবছর উত্তর কলকাতার রামমোহন সম্মিলনীর পুজোর থিম হওয়ায় মূহূর্তে ওই শিল্পীদের উৎপাদনের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। কারণ, ওই পুজো মণ্ডপ থেকেই গয়নাবড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। তিলোত্তমার এই মণ্ডপ থেকে বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামের মহিলাদের গয়না বড়িশিল্প। উপকৃত হচ্ছেন হাজার হাজার কুটির শিল্পী। এভাবেই বাড়তি রোজগার করেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও কুটির শিল্পের সঙ্গে যুক্ত দেড় কোটির বেশি শ্রমিক-নারী। বণিকসভা বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্সের শিল্পবিভাগের চেয়ারম্যান ঋত্বিক দাস এদিন জানিয়েছেন, “বাংলার দু-হাজারের বেশি কোম্পানি আমাদের সদস্য। এর মধ্যে হাজারের বেশি সংস্থা ও তাদের শ্রমিকরা মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের জেরে এবছরও সরাসরি পুজোয় গতবারের চেয়েও বাড়তি রোজগার করলেন। এই সংখ্যাটা দেড় লক্ষের বেশি। হাতে আসা প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, শুধু কলকাতা নয়, জেলার বণিকসভাগুলিও গতবারের তুলনায় এবার বেশি বাণিজ্য করেছে।” ভারত চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি নরেশ পাচিশিয়ার কথায়, “গ্রামাঞ্চলের পুজো কমিটিগুলি এবছর মুখ্যমন্ত্রীর তরফে অনুদান পাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। চাহিদা বেড়েছেন অন্যান্য পণ্যেরও।”

মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল শুভাশিস রায় বলেছেন, “সমাজের উচ্চশ্রেণি থেকে শুরু করে জেলার প্রান্তিক মানুষও, এমনকী, ভিনরাজ্যের বহু শ্রমিক বাংলার দুর্গাপুজোর মাধ্যমে এবছরও আরও বেশি সংখ্যায় উপকৃত হয়েছেন।” ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রির (ফসমি) অন্যতম কর্তা বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, “পুজোর সঙ্গে রাজ্য সরকার সরাসরি যুক্ত থাকায় মানুষ অনেক বেশি উৎসব ঘিরে আস্থা ও নিরাপত্তা পেয়েছে। এখানেই শেষ নয়, পুজোর আগে ও পুজোর সময়, রাজ্যজুড়ে পুলিশ ও প্রশাসন যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, তাতে ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা নির্ভয়ে বাজার করেছেন।”

প্রতিমার গায়ে শোলা বা ডাকের সাজের পরিবর্তে এখন আর্ট কলেজের ছাত্রদের ইমিটেশন বা ফেব্রিকের গয়না ও হস্তশিল্পের সামগ্রী যে বাংলার ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পকে স্বাবলম্বী করেছে, তা এবছরও পুজোর কথা লিখতে গিয়ে স্বীকার করেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘পুজো-অর্থনীতি’কে ইতিমধ্যে শিক্ষার অংশ হিসাবে রাখছে। থিমশিল্পী ভবতোষ সুতার, সুশান্ত পাল, প্রদীপ দাস থেকে কুমোরটুলি ঘরানার পরিমল পাল স্বীকার করেছেন, আগে শুধুমাত্র খড়-বাঁশ-মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি হত, মণ্ডপ করতেন ডেকরেটররা। মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রি থেকে মেদিনীপুরের পটশিল্পীরা, জঙ্গলমহলের আদিবাসী কাঠুরিয়ারাও পুজোর অন্যতম শিল্পী হয়ে পুজো-ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম অংশ হয়েছেন। তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, বাঁশের বদলে লোহার কাঠামো এবং প্রতিমাকে ২২ ক্যারেটের সোনার গয়নায় মুড়ে দেওয়ায় লোহা ও স্বর্ণশিল্পকে পুজোয় টেনে আনা হয়েছে। আগে পুজোর সময় বাঙালির বাইরে বেড়াতে যাওয়ার জন্য পর্যটনশিল্প চাঙ্গা হত, এখন বিদেশ থেকে বাংলায় পা রাখছে উৎসবমুখর মানুষ। বছর সাত-আট আগে বাংলা বিরোধীরা একসময় প্রচার করতেন, বাংলায় দুর্গাপুজো হতে দেওয়া হচ্ছে না। সেই গুজরাত-উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান থেকেই এবছরও কয়েক হাজার মানুষ ও রীতিমতো দল বেঁধে বাংলায় এসে পুজো দেখলেন, মুগ্ধ হলেন, বিশ্ববাংলা শোরুম থেকে কেনাকাটা সারলেন। শহর থেকে – আবার গ্রামে পুজো দেখতে যাওয়া বা পুজোর ক’দিন আলাদা ভর করে পাত পেড়ে খাওয়া কয়টারিং-রেস্তোরা শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে। অষ্টমীর রাতেও দেখা গিয়েছে, বড় থেকে ছোট সব রেস্তোরাঁর সামনেই খাবারের স্বাদ নিতে উৎসুক হাজার হাজার মানুষের ঢল। পুজো কমিটিগুলির তথ্য, “গতবছর যে চাউমিন বা খাবারের দোকানদার ২০০ বর্গফুটের স্টল নিয়েছিলেন, ক্র এবছর তিনি ৫০০ বর্গফুটের স্টল নিয়েছেন। এতেই প্রমাণ হয়, ডা বাংলার পুজোকেন্দ্রিক অর্থনীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *