নবনীতা মণ্ডল ও সৌম্যজ্যোতি মণ্ডল, নয়াদিল্লি ও চাঁচল: দিল্লির তুঘলকাবাদে রিকশা চালান আদতে কোচবিহার মাথাভাঙ্গার সেলিম শেখ। অনেকদিন আছেন রাজধানীতে। রিকশা চালানোর সময় তাঁকে তুলে নিয়ে যায় দিল্লি পুলিশ। অপরাধ? সেলিম বললেন, ‘আমাকে বলল তুমি বাংলাদেশি, চলো। রিকশা পড়ে রইল। পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে গেল।’ আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সবই আছে। সেলিমের কথায়, ‘পুলিশ বলল, এগুলো চলবে না। তুমি ডাউটফুল।’
সাতদিন থানায় আটকে রাখা হয়েছিল তাঁকে। ভালো করে খেতে দিত না বলে অভিযোগ। সেলিমের ভাষায়, ‘শেষে একটা লোক ১২ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দিল।’ বাংলাদেশি অভিযোগে হয়রানি তো হচ্ছেই। তাছাড়া ছেড়ে দেওয়ার জন্য টাকা হাতিয়ে নেওয়াও ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে নয়াদিল্লিতে। সেলিমের অভিযোগের সমর্থন মিলল প্রবীণ নকশাল নেতা, সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের কথায়।
দীপঙ্কর বলেন, ‘শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ পোশাকে লোকজন এসে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রেখে দিচ্ছে অজানা জায়গায়। টাকা দিলে ছাড়া পাচ্ছে, না হলে ডিটেনশন ক্যাম্প।’ শুধু নয়াদিল্লি নয়, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ইত্যাদি রাজ্যে একই ছবি। পরিস্থিতিটা এমন যে, বাংলায় কথা বলেছেন তো মরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আঙুল উঁচিয়ে বলা হবে, ‘তুমি বাংলাদেশি নিশ্চয়ই।’
সঙ্গে নির্যাতন। শুধু থানায় বা অজানা জায়গায় আটকে রাখা নয়। মারধরের ঘটনাও আকছার ঘটছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবিবার এক্স হ্যান্ডেলে আপলোড করা একটি ভিডিওতে দিল্লিতে মালদার চাঁচল থেকে যাওয়া এক পরিযায়ী শ্রমিককে তাঁর সন্তানের কানে ও কপালে ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘দেখো আমার ছেলেকে মেরে কী করেছে। পুলিশ মেরে কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে।’
ওই তরুণের কথায়, তাঁর স্ত্রীকেও খুব মেরেছে পুলিশ। স্ত্রীর মুখে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট ওই ভিডিওতে। যা উল্লেখ করে মমতা লিখেছেন, ‘ভয়ংকর সন্ত্রাস। দেখুন, দিল্লি পুলিশ এক শিশু ও তার মাকে কী নির্মমভাবে মেরেছে। বিজেপির ভাষা সন্ত্রাসে একটি শিশুকেও রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!’ রাজধানীর বুকে এখনও বাঙালিদের ত্রাস।
গুরুগ্রামের এক শ্রমিক আবাসে দেখা হল মালদার কালিয়াচকের রহিমা বিবির সঙ্গে যিনি আট বছর সেখানে থেকে অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। তাঁর বাচ্চারা নয়াদিল্লির স্কুলে পড়ে। রহিমা বললেন, ‘হঠাৎ একদিন বাংলায় কথা বলছি শুনে পুলিশ বলল বাংলাদেশি! আধার কার্ড, ভোটার কার্ড দিলাম। বলে, এটা তো জালও হতে পারে। কী অসহায় আমরা বলুন!’ কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম, সিপিআই (এমএল) ইত্যাদি দলগুলি একজোট হয়ে বাংলার শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, এলাকা ভাগ করে দায়িত্ব নিচ্ছে, ভাষার জন্য এই নিপীড়নের অভিযোগ সংসদে তোলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না পরিযায়ী শ্রমিকরা। মালদা, কোচবিহার, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া থেকে বহু বছর আগে দিল্লিতে আসা হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনে আচমকা নেমে এসেছে অন্ধকার।
আতঙ্কের আরেক নাম ‘বাঙালি ধরার’ গাড়ি। থানায় থানায় ‘পুলিশ ক্লিয়ারেন্স’-এর নামে টাকা তোলার খেলা। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের কেউ কাগজ কুড়োন, কেউ সবজি বেচেন, কারও পেশা নির্মাণকাজ, কিংবা পরিচারিকার কাজ। সঙ্গে বৈধ নথি থাকলেও কেউ নিরাপদ নন। নকশাল নেতা দীপঙ্করের ভাষায়, ‘পরিযায়ী শ্রমিক, বাংলায় কথা বলছে এবং মুসলমান- এই তিন বৈশিষ্ট্য একসঙ্গে থাকলেই বিজেপি শাসিত রাজ্যে এখন অত্যাচার।’ মুক্তার খান নামে যে শ্রমিকের ভিডিও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আপলোড করেছেন, তাঁর বাড়ি চাঁচল থানার হাজতপুরে। স্ত্রীর নাম সাঞ্জিরা বিবি। স্বামী, স্ত্রী দিল্লিতে শৌচালয় পরিষ্কারের কাজ করেন। পরিবারের অভিযোগ, দু’দিন আগে আটক করে থানায় নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার করা হয়। রবিবার কুড়ি হাজার টাকা আদায় করে তাঁদের ছাড়া হয় বলে পরিবারের দাবি।
পুলিশ ও প্রশাসনের আধিকারিকরা রবিবার সন্ধ্যায় ওই শ্রমিকের বাড়িতে গিয়ে কথা বলেন। শ্রমিকের বাবা আজমল খানের মুখে একটিই প্রশ্ন, ‘এসব কী হচ্ছে!’ তৃণমূলের মালদা জেলা সভাপতি আব্দুর রহিম বক্সী হুমকি দিলেন, ‘এই অন্যায়ের শেষ দেখে ছাড়ব।’ উত্তর মালদার বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু শুধু বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দেখব, কেন এরকম হল। এরকম হয়ে থাকলে দুঃখজনক।’ দক্ষিণ মালদার কংগ্রেস সাংসদ ইশা খান জানালেন, এনসিআর অঞ্চলে ৭-৮ হাজার বাঙালি শ্রমিকের নথি থাকা সত্ত্বেও পুলিশ বাংলাদেশি অভিযোগে হেনস্তা করছে। কখনও শংসাপত্র, কখনও রাজ্য সরকারের চিঠি চাওয়া হচ্ছে, যা এই শ্রমিকদের পক্ষে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। একইরকম হেনস্তার শিকার আদতে মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বাসিন্দা মিতালি দাস। নয়ডার একটি আবাসনে পরিচারিকার কাজ করেন। তিনি বললেন, ‘সকালে কাজ করতে গিয়েছি, পুলিশ এসে বলে তুমি বাংলাদেশি, ফেক আইডি বানিয়ে কাজ করছ। যে ফ্ল্যাটে কাজ করি, সেখানকার ম্যাডামও বললেন, ও অনেকদিন ধরে কাজ করছে। তবুও কানে তুলল না পুলিশ। বলল, পুলিশের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দেখাও, না হলে থানায় চলো।’