বহু চেষ্টাতেও প্রেমিকার নামটি মোছা যায়নি – Uttarbanga Sambad

বহু চেষ্টাতেও প্রেমিকার নামটি মোছা যায়নি – Uttarbanga Sambad

শিক্ষা
Spread the love


  • তনুশ্রী পাল 

যুগযুগান্তর ধরে দেহপটকে অনন্য করে তোলার অক্লান্ত সাধনা মানুষের।  সে পথে হেঁটে একদিন আবিষ্কার হল দেহ অলংকরণের বিশেষ পদ্ধতি, ‘ট্যাটু’। এ শুধু বহিরঙ্গের প্রসাধনী নয়। ত্বকের ভিতর রং প্রবেশ করিয়ে শরীর অলংকৃত করা হয়। যাঁর শরীরের ক্যানভাসে ট্যাটুশিল্পী ছবি আঁকবেন সেই উপভোক্তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছবির বিষয় ও শরীরের নির্দিষ্ট স্থান নির্বাচন করেন।

উলকি বা ট্যাটু নিয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলি। একবার ছুটিতে পরিবারের নবীন সদস্যরা বাড়ি এলে চোখে পড়ে একজনের বাহুর গোড়ায় ইঞ্চি দুয়েকের ট্যাটু, লম্বা কানওয়ালা একটা প্রাণীর ছবি! জানলাম ওটি খরগোশের মুখ। অপরজন বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় আঁকালে ইঞ্চি সমান একটি নরমুণ্ডের উলকি! বিপজ্জনক বস্তুর গায়ে সাঁটা ‘চেতাবনি’ যেন! অবাক হলেও বুঝি ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ তারা। অনুমতি নেয়নি, কারণ তারা জানে বারণ করা হবে। কিন্তু আপত্তির কারণ বোঝে না। কারণ হল ভীতি! শিল্পী দক্ষ কি না, ট্যাটু স্টুডিও ও সেখানে ব্যবহৃত সব সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত কি না, সংক্রমণের ভয় নেই তো? নানা কালে নানা ফ্যাশনের হাওয়া ওঠে। নবীনেরা আলোড়িত হয় বেশি।

একটা বয়স পর্যন্ত ফ্যাশন বিষয়টি পরাণুকরণই। বাঘ, সিংহ, ইগল, হরিণ, ঠাকুর-দেবতা, ত্রিশূল, বিখ্যাত নায়ক-নায়িকা, খেলোয়াড়দের মুখ কাঁধে, হাতে আঁকিয়ে খুশি অনেকেই। হয়তো বিশ্বাস, হয়তো শুধুই ভালো লাগা!  আজকাল বছর বছর বাজারে ডিজাইনার জুতো, জামা, গয়নাগাটি, সাজগোজের অজস্র উপকরণ। সেখানে নতুনত্বের জোয়ার। কিন্তু উলকি বা ট্যাটুর ক্ষেত্রে সেটা চলে না। শরীরের ত্বকের ওপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এই ট্যাটু বা উলকি। একবার অঙ্গে ধারণ করলে মুছে ফেলা বা পালটে ফেলা মোটেই সহজসাধ্য নয় বরং বেশ কঠিন এবং ব্যয়বহুল। নতুন ট্যাটুর তুলনায় ‘কভারআপ’ ট্যাটু অনেক বেশি খরচের। কভারআপ ট্যাটুর অর্থ নতুন ডিজাইন এঁকে পুরোনো ট্যাটুর ছবি বা নামটি ঢেকে ফেলা। অর্থাৎ একসময় যে প্রিয় নামটি চিরকালীন ভেবে হৃদয়ে শুধু নয় হাতে বা শরীরের অন্য কোথাও সযত্নে খোদিত হয়েছিল ট্যাটুশিল্পীর মহার্ঘ স্টুডিওতে, একদিন সে নাম-চিহ্ন একেবারে মুছে ফেলবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে মন। তখন অন্য ডিজাইন এঁকে আগের ট্যাটুকে কভারআপ করা হয় বা লেসারের সাহায্যে মুছে ফেলা হয়। দুটি পদ্ধতিই যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। আবার লেসারের প্রভাবে অতি সংবেদনশীল ত্বকে জ্বালাযন্ত্রণা সহ অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে।

ট্যাটুর কথায় সংবাদপত্রে প্রকাশিত গা শিউরে ওঠা একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল- ‘কর্ণাটকের চিম্পুগানাহাল্লি গ্রামের দশটি জায়গা থেকে এক অজ্ঞাতপরিচয় মহিলার টুকরো টুকরো দেহাংশ উদ্ধার করল পুলিশ। পরে তারা জানায় মহিলার হাত ও মুখে ট্যাটু ছিল। সেই সূত্র ধরে মৃতার পরিচয় জানা যায়। নাম লক্ষ্মীদেবম্মা, বয়স ৪২, তিনি তুমাকুরু তালুকের বেলাভির বাসিন্দা।’ ট্যাটু চিহ্ন না থাকলে তিনি হয়তো হারিয়ে যেতেন অজ্ঞাতপরিচয় মৃতের ভিড়ে! আশা করা যায় অপরাধীও ধরা পড়বে।

‘কভারআপ’ নাহলে পুরোনো ট্যাটু পারিবারিক মহাসংকটের কারণও হয়, সে প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। ক’বছর আগে হিমাচল ভ্রমণে সুনীল শর্মাজির গাড়ি নেওয়া হল। ভারী দিলখোলা হাসিখুশি মানুষটি কয়েকদিনে বেশ আপন হয়ে উঠলেন। মন খুলে প্রায়ই বাড়ির কথা, মা-বাবা, দুটো বাচ্চা ছেলে, বৌ পার্বতী সবার গল্পই করেন। লক্ষ করি তাঁর স্টিয়ারিং ধরা ফর্সা হাতে কালো ট্যাটু। ছোট্ট একটি গোলাপের পাশে হিন্দিতে নিধি নামটি খোদিত। রহস্য! পুছতাছ করতে বেরিয়ে আসে গল্প। খানিক হেসে সুনীলজি তাঁর মহা পরেশানির কথা ব্যক্ত করেন। এ ট্যাটু তাঁর স্কুলবেলার, নিধি তাঁর প্রথম প্রেমিকা। এখন সে রেডিওতে, জলসায় গায়। কিন্তু শত চেষ্টাতেও সে নাম মোছা যায়নি। ‘তা ঘরওয়ালি কিছু বলে না?’ ‘বাপ রে, দুসরা ট্যাটু বানায়া উসকি লিয়ে, বিলকুল হার্ট কি উপর। দেখিয়ে।’ তিনি শার্ট খুলে হৃদয়ে যে শুধুই স্ত্রী পার্বতী রয়েছেন তার প্রমাণ দিতে উদ্যত হন। আমরা তাঁকে বিরত করি।

উলকি বা ট্যাটু প্রায় একই ধারণার দুই রূপ। দুটি ক্ষেত্রেই বিশেষ পদ্ধতিতে শরীরের ত্বক ছিদ্র করে চিরস্থায়ী কালি ব্যবহার করে নকশা বা অলংকরণ করা। ফ্যাশন হিসেবে শরীর অলংকরণে ট্যাটুর ব্যবহার বেশি; শব্দটিও আধুনিক। এতে নির্দিষ্ট প্রযুক্তি বা মেশিনের সাহায্যে ত্বকে নকশা বা বিশেষ চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। কিন্তু উলকি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কলা। সুপ্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে উলকির ব্যবহার। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর উলকির নিজস্বতা ও সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, মর্যাদা ও ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক অবস্থান। উলকি আঁকার পদ্ধতিও বেশ জটিল বেদনাদায়ক ও সময়সাপেক্ষ। ধারালো কাঁটা, মাছের হাড় বা সুচ দিয়ে ত্বকে ছিদ্র করে কালি বা রঞ্জক প্রবেশ করানো হত, কোথাও সুতোকে কালি বা রঞ্জকে ডুবিয়ে ত্বকে সেলাই করা হত। কাঠকয়লা, ছাই বা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হত কালি বা রঞ্জক।

ট্যাটু আঁকা একটা পেশাদার শিল্পে পরিণত হয়েছে। ট্যাটু স্টুডিওগুলোয় বিভিন্ন বয়সের মানুষের ভিড় আজকাল। ব্যয়বহুল হলেও রঙিন ট্যাটুর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। হাতে, পিঠে, কণ্ঠে, কাঁধে, আঙুলে, আর্ম ব্যান্ডের মতো করে আঁকা হচ্ছে জ্যামিতিক নকশা, তন্ত্রের নানা চিহ্ন এবং  আরও অজস্র কিছু! বৈদ্যুতিক ট্যাটু মেশিন আবিষ্কার ট্যাটু শিল্পে বিপ্লব এনে দিয়েছে। ট্যাটুশিল্পী সেলাই মেশিনের মতো একটি হ্যান্ডহেল্ড মেশিন ব্যবহার করেন, ত্বকে ছিদ্র করবার জন্যে তাতে এক বা একাধিক সুচ পরানো থাকে। সুচের উপরের দিক থেকে বিন্দু বিন্দু কালি বা রং ঢেলে ত্বকের ভিতর প্রবেশ করানো হয়। ডিজাইন অনুযায়ী ত্বকে বহুবার ছিদ্র করতে হয়। ট্যাটু করবার সময় সামান্য রক্তপাত ও ব্যথা হয়, জায়গাটি সেরে উঠতে সপ্তাহ দুয়েক সময় লেগে যায়।

বিষয়টি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ তাই চিকিৎসকরা ট্যাটু করাবার আগে ও পরে কিছু সতর্কতার পরামর্শ দেন। ট্যাটু থেকে যাতে অ্যালার্জি, সংক্রমণ বা অন্য গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা না হয় সেজন্যে সাবধানতা নিতেই হবে। প্রথমেই সংবেদনশীল ত্বকের জন্যে অ্যালার্জি টেস্ট আবশ্যিক। বেছে নিতে হবে একটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত, খ্যাতিসম্পন্ন আধুনিক সমস্ত সুবিধাযুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সেরা স্টুডিও। অভিজ্ঞ, লাইসেন্সপ্রাপ্ত, দক্ষ এবং স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত সেরা প্রশিক্ষিত শিল্পীর হাতেই ট্যাটু করানো উচিত। প্রত্যেকবার ভালো করে হাত ধুয়ে নতুন গ্লাভস পরে, সিল করা প্যাকেট থেকে সুচ ও রঙের টিউব নিয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য ডিসপোজাল কাপে মিশ্রণ তৈরি করে ব্যবহার করবেন। ত্বকে ছিদ্র করা হয় তাই সংক্রমণের সব সম্ভাবনা মাথায় রেখে ট্যাটু করা উচিত। অপারেশন থিয়েটারের মতো বারবার স্টুডিওর প্রতিটি জিনিস যত্নের সঙ্গে জীবাণুমুক্ত করা জরুরি। একই সুচ বা সরঞ্জাম একাধিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি বা অন্যান্য মারাত্মক কোনও সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। উপভোক্তার ডায়াবিটিস বা বিশেষ রোগ থাকলে ট্যাটু করানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। রোদে পোড়া ত্বকে ট্যাটু করা ঠিক নয়। ট্যাটু করানোর পরে সেরে না ওঠা পর্যন্ত সরাসরি রোদ লাগানো যাবে না। জায়গাটি পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখতে হবে। অ্যান্টিসেপটিক এবং বিশেষ ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতে হবে। সুইমিং পুল, নদী, জলাশয়ে নামা যাবে না। জ্বালাপোড়া, ব্যথা, ফুলে যাওয়া, ফুসকুড়ি, চুলকানি বা অন্য সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *