রূপায়ণ ভট্টাচার্য
বহিরাগত মানে আপনি ঠিক কী বোঝেন?
অভিধান ঘাঁটলে দুটো কি তিনটি মানে পাবেন। সংসদ অভিধানে বহিরাগত মানে তিনটি। ১) বাইরে আগত। ২) বাহির থেকে আগত। ৩) বিদেশি।
অথচ চারপাশে তাকালে অনেক বহিরাগত খুঁজে পাবেন। মানেই পালটে যাবে। এক রাজ্যের অন্য শহরে চাকরিতে গেলেও অনেকের চোখে সে বহিরাগত।
মোথাবাড়ি ও জঙ্গিপুর অতিসম্প্রতি যে ভয়ানক দৃশ্য দেখাল, তাতে জড়িয়ে গিয়েছে বহিরাগতদের নাম।
দুটো জায়গার দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বললে উঠে আসবে একটাই কথা। ‘কারা যে এসে ঝামেলা বাড়াল, বুঝতে পারলাম না। এই বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলোকে এলাকায় দেখিইনি কোনওদিন।’
হিন্দুরা বলছেন, কাউকে আগে দেখেননি। হামলাবাজরা অধিকাংশই বাইরের ছেলে।
মুসলিমরা বলছেন, কাউকে আগে দেখেননি। হামলাবাজরা অধিকাংশই বাইরের লোক।
অদ্ভুত! ওই ছেলেগুলো কি তা হলে চাঁদ বা মঙ্গলগ্রহ থেকে এল?
আমাদের রাজ্যে এই ধরনের বহিরাগত তত্ত্ব আসে প্রতিবার। নির্বাচনের সময় আরও আরও আরও বেশি করে।
এবার বোধহয় অনেকটাই আগে চলে এল সেই শব্দের দাপাদাপি। মালদা বা মুর্শিদাবাদের ঘটনায় দুশ্চিন্তার আরও বড় কারণ কী জানেন? গুজব ছড়ানোর কাজে, হামলা শুরুর কাজে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল তরুণ প্রজন্ম। দু’পক্ষেই। ধর্ম নিয়ে যাঁদের তেমন বেশি মাথাব্যথা হওয়াই উচিত নয়।
এই ছেলেগুলোকে তাতাল কে? গুজব ছড়াল কারা?
দুটোর স্পষ্ট জবাব নেই। রাজনীতিবিদদের দিকেই তুলতে হবে আঙুল। বৃত্ত আরও ছোট করে আনলে বিজেপি এবং তৃণমূলের দিকে। সিপিএম বা কংগ্রেসের (বিশেষ করে কংগ্রেসের) ভোট এই দুই জেলায় বেশি হতে পারে, তবে সংগঠন বলে কারও নেই কিছুই।
বহিরাগত আনতে, তাদের এক করতে, অনেক সময় এবং সংগঠন লাগে। কোনও বিধায়ক বা স্থানীয় পুলিশ অফিসাররা ওই বহিরাগতদের জমায়েতের খবর, টেনশনের চোরাস্রোতের খবর না জানতে পারলে, তাঁদেরই দোষ। এক যুগ আগে ক্যানিংয়ে যে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ২০০-র বেশি বাড়ি-দোকান পুড়ে যায়, তার পিছনেও ছিল সেই গুজব এবং অন্য গ্রামের লোক। পুলিশ বুঝতে পারেনি প্রথমে।
বহিরাগত ওষুধ প্রয়োগ যে শুধু রাজনীতিতে দরকার হয়, তা নয়। খেলার কর্তাদেরও দরকার পড়ে। ঠিক সংস্থায় নির্বাচনের মুখে। সবাইকে ম্যানেজ করতে পারলে নির্বাচন দরকার হয় না। দিনের পর দিন জাদুমন্ত্রে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া যায়। নির্বাচন হলে দরকার পড়ে বহিরাগত মাসলম্যানদের। ময়দানের বহু প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি এমন বেআইনি পথে ক্ষমতায় থেকে গিয়েছেন ভোটে বহিরাগতদের কাজে লাগিয়ে।
অতীতে ময়দানের ভোট হলে ভোটারদের পাড়ার পোস্ট অফিসে নির্বাচনি ব্যালট যেত। সদস্যর বাড়ি যাওয়ার আগে ছিনতাই হয়ে যেত সব ব্যালট। যে কর্তাদের গোষ্ঠী যত ব্যালট জোগাড় করত, জিতত তারাই। এই সময় বহিরাগতরা হঠাৎ উদয় হত ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ক্লাবের লনে। গণহারে।
আজ ভাবলে অবাক লাগে, আগের বাম সরকার এই গাজোয়ারি নিয়ম বন্ধে কোনও নজর দেয়নি। এই তৃণমূল সরকার যেমন দাদা-ভাইদের ময়দানে নামিয়ে খেলার শোক মিছিল সেরে ফেলেছে, বামেরাও নিজেদের প্রার্থী নামিয়ে দিয়েছিল। উদাহরণ, ইস্টবেঙ্গলে শচীন সেন, সিএবিতে প্রসূন মুখোপাধ্যায়।
তাকাই আরও অন্যদিকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাণিজ্য…। সব জায়গাতেই এই বহিরাগতদের দাপট। আপনি এদের মধ্যেই দালালরাজ, দাদাগিরির দুই ‘দ’ খুঁজে পাবেনই পাবেন। ইংরেজি ধরলে ডি ফর ডেঞ্জার।
কথায় কথায় কোথায় ভুলে যাব বলতে– এখানে লিখে ফেলি।
ভালো ব্যাপার হল, মোথাবাড়ির প্রভাব পড়েনি মালদা শহরে। প্রথম দিন পড়েছিল। এখন সব উধাও। মুসলিম ও হিন্দু টোটোচালক স্বচ্ছন্দে গাড়ি নিয়ে ঘুরছেন। শহরের প্রাণকেন্দ্র রথবাড়িতে প্রায় সারা রাত টোটো মিলবে। উত্তরবঙ্গে এমন জমজমাট মোড় নেই। রাত এগারোটা নাগাদ দেখা যাবে, অন্তত পাঁচছয়েক ভলভো বাস কলকাতার দিকে যাওয়ার জন্য তৈরি। গোটা আটেক টিকিট কাউন্টার। সেখানে ভালো ভিড় সব সম্প্রদায়ের।
বিজেপি এবং তৃণমূল এখন ধর্মের নামে যে খেলাটা খেলছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সাপের খেলা দেখানোয় ওস্তাদ অনেক সাপুড়েই মারা গিয়েছেন সাপের ছোবলে। এক নেতার যে কোনও কথা থেকে, যে কোনও একটা গুজব থেকে ঝামেলা হতে পারে। ২০২৪ সালের এক সমীক্ষায় সেন্টার ফর সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজম (সিএসএসএস) যে হিসেব দিয়েছে, তা চমকে দেওয়ার মতো। ২০২৪ সালে ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ছিল ৫৯। ২০২৩ সালে সংখ্যাটা ছিল ৩২। ২০২৪ সালে সেটা ৫৯। সংখ্যার হারে ৮৪ শতাংশ বেড়েছে। দাঙ্গায় মারা গিয়েছেন ১৩ জন। ১০ জন মুসলিম, ৩ জন হিন্দু।
এমন শুকনো পরিসংখ্যান অধিকাংশ সময় বিরক্তি তৈরি করে। আবার চমৎকার কিছু দৃশ্যপট ও ভাবনা তৈরি করে দেয়। যেমন এই সমীক্ষা থেকেই জানি, দেশে সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা হয়েছে মহারাষ্ট্রে, সংখ্যাটা ১২। তারপরই উত্তরপ্রদেশ ও বিহার (৭), গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড (৬), কর্ণাটক (৪), বাংলা ও তেলেঙ্গানা (৩), ওডিশা ও রাজস্থান (২), ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, রাজস্থান ও হরিয়ানা (১)। স্বস্তিতে থাকা রাজ্যের মধ্যে তামিলনাড়ু, পঞ্জাব, কাশ্মীর, অসম বা অন্ধ্রপ্রদেশ আছে।
সিএসএসএসের সমীক্ষা বলছে, অধিকাংশ হাঙ্গামা হয়েছে ধর্মীয় উৎসব বা মিছিলের সময়। অযোধ্যা রামমন্দির হওয়ার সময় ৪ দাঙ্গা হয়েছে। সরস্বতী বিসর্জনের সময় ৭টি। গণেশ উৎসব চলাকালীন ৪টি। ইদুজ্জোহার সময় ২টি।
ভোট আসছে। ভোটও তো অনেকের কাছে উৎসবের মতো। ‘বহিরাগত’ এবং গুজব থেকে দূরে থাকাই ভালো।