শুরু হল নতুন বঙ্গাব্দ ১৪৩২। প্রারম্ভে অনেক স্বপ্ন-আশা থাকে। বছরশেষে সেইসব স্বপ্ন-আশার অনেক কিছু অপূর্ণ রয়ে যায়। ১৪৩১ যেমন শেষ হল মুর্শিদাবাদের অশান্তি নিয়ে। অথচ অন্য যে কোনও রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্রটা বরাবর অনেক উজ্জ্বল। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। ফাল্গুন থেকে ধরলে পরপর শান্তিতে পালিত হয়েছে দোল-হোলি, ইদুলফিতর, বাসন্তী-অন্নপূর্ণাপুজো।
তারপর যখন গোটা রাজ্য চড়ক-গাজন-নীলপুজোয় ব্যস্ত, তখন সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের নামে অশান্ত হয়ে উঠল মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ান। হিংসার বলি ৩, নিখোঁজ বহু। আতঙ্কে ঘরছাড়া, জেলাছাড়া অজস্র পরিবার। হাইকোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হওয়ার পর অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।
১৪৩১-এ অপ্রাপ্তি অনেক ছিল। একশো দিনের কাজ সহ বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া বিপুল অঙ্কের বরাদ্দ। সেইসঙ্গে কেন্দ্রীয় বাজেটে বাংলাকে বঞ্চনা। তবে সদ্য শেষ হওয়া বাংলা বছরে গোটা দুনিয়াকে নাড়া দিয়েছে আরজি কর মেডিকেলের ঘটনাটি। গভীর রাতে কর্মরত অবস্থায় হাসপাতালের চারতলায় তরুণী চিকিৎসককে সেই ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলন ছড়ায় দেশজুড়ে। ন্যায়বিচারের দাবিতে মানুষ সোচ্চার হন তিরিশটিরও বেশি দেশে।
সেই ঘটনার পর সাড়ে আট মাস অতিক্রান্ত। আজও ন্যায় বিচারের প্রতীক্ষায় আছেন নির্যাতিতার বাবা-মা। নিম্ন আদালত অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাবাসের দণ্ড দিয়েছে। নির্যাতিতার পরিবার তাতে অখুশি। তাঁদের মতে, একজনের পক্ষে ওই অপরাধ অসম্ভব। দুষ্কর্মটির পিছনে আছে বিরাট চক্র। তাঁদের আর্জিতে সুপ্রিম নির্দেশে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে ফের তদন্ত করছে সিবিআই। অভয়ার বাবা-মা শেষপর্যন্ত ন্যায়বিচার পান কি না, তা অবশ্য অনিশ্চিতই।
আরজি কর মেডিকেলের ওই ঘটনার মতো তোলপাড় ফেলে দিয়েছে এসএসসির ২০১৬ প্যানেলের প্রায় ২৬০০০ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলে আদালতের নির্দেশ। হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল শীর্ষ আদালত। তারপর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাকরিহারাদের আশ্বাস দিয়ে পাঁচ দফা ঘোষণা করলেন।
ঘোষণাগুলি হল- (১) কারও চাকরি যাবে না, (২) কাউকে টাকা ফেরত দিতে হবে না, (৩) রাজ্য কাউকে বরখাস্ত করেনি, (৪) চাকরিহারা প্রত্যেকে নিজের নিজের স্কুলে গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দিন ও (৫) রাজ্য রায় পুনর্বিবেচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায় সকলে আশ্বস্ত হলেন না। অসন্তোষের মুখে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু চাকরিহারাদের সঙ্গে কয়েকবার বৈঠক করেন।
ততদিনে চাকরিহারাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ অনশন শুরু করে প্রত্যাহারও করেছেন। চাকরিহারাদের একাংশ দিল্লি গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করতে। সেই আশা মেটেনি। তাঁরা দিল্লিতে কারও দেখা পাননি। তার আগে কলকাতায় ডিআই অফিসে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের লাঠি-লাথি খেতে হয়েছে চাকরিহারাদের।
সকলেরই প্রশ্ন, সময় থাকতে মুখ্যমন্ত্রী কেন যোগ্যদের চাকরি বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না? এখনও কেন তিনি অযোগ্যদের আগলাতে চাইছেন? উদ্বেগের মধ্যে সাময়িক স্বস্তি এল অবশেষে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের আর্জিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ পড়ুয়াদের স্বার্থ এবং স্কুলের পঠনপাঠন স্বাভাবিক রাখার তাগিদে যোগ্য শিক্ষকদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দিল। তবে শিক্ষাকর্মীদের নয়।
শিক্ষকদের এই ছাড় অবশ্য শর্তাধীনে। প্রথমত, ৩১ মে-র মধ্যে নতুন করে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে শিক্ষা দপ্তরকে। দ্বিতীয়ত, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে। এই নির্দেশে চাকরিহারাদের একাংশ সাময়িক স্বস্তি পেলেও পুরো নিশ্চিন্ত হল না। শিক্ষাকর্মীরা তো পুরোপুরি হতাশই। ১৪৩২ তাই চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে শুরু হল।