মৃড়নাথ চক্রবর্তী
সেদিন এক সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজে একটা খবরের পোস্ট দেখলাম। শিরোনাম ছিল মোটামুটি এরকম : গাড়ির ধাক্কায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল। কমেন্ট সেকশন থেকে লিংক খুলে খবরটা পড়লাম। আসল ঘটনা হল, রাতে পেট্রলিংরত একজন পুলিশ কনস্টেবল ও একজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে একটি দ্রুতগতিতে ছুটে আসা গাড়ি ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। ধাক্কা মারে এক বাইক আরোহীকেও। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় সেই পুলিশ কনস্টেবলের এবং গুরুতরভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি বাকি দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পুজোর আগে এমন খবরে খানিকটা মন খারাপ হল। কিন্তু তার চেয়েও বেশি অবাক হলাম কমেন্ট সেকশন দেখে। কেউ লিখেছেন, ‘পুজোর আগে খুশির খবর।’ কেউ লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই গাড়ি দাঁড় করিয়ে তোলা তুলেছিল।’ কারও কমেন্টে দেখলাম, ‘অভিযুক্ত গাড়ির ড্রাইভারকে ধন্যবাদ।’
মানুষের মৃত্যুসংবাদে সর্বৈবভাবে এমন উল্লাস করতে কি কখনও দেখা যায়? এখানেই সমস্ত গোলমাল। সাধারণ মানুষের কাছে ‘মানুষ’ আর ‘পুলিশ’- দুটো ভিন্নধর্মী সত্তায় পরিণত হয়েছে। সামগ্রিক পুলিশ জাতটার প্রতিই তীব্র ঘৃণা নিয়ে চলে প্রায় বেশিরভাগ মানুষ এবং এটা আশ্চর্যের বিষয় মোটেই না। এর জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী পুলিশ নিজে ও সরকার।
সেদিন দেখলাম ট্রাক দাঁড় করিয়ে টাকা তোলা নিয়ে বিবাদ ও তার জেরে সিভিক ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে ট্রাকচালকদের হাতাহাতি। শেষে সমস্ত ট্রাকচালক প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করেন। পুলিশের এই তোলাবাজি হাইওয়েতে উঠলেই চোখে পড়ে। এই তোলাবাজির হাত থেকে বাঁচতে যেভাবে বড় গাড়িগুলো দ্রুত পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, তাতে দুর্ঘটনাও ঘটে অহরহ। এই তোলাবাজির সুতো কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তা সহজানুমেয়। সে প্রসঙ্গ নাহয় বাদ দিলাম।
আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি তাতে হাইওয়েতে ওঠারও প্রয়োজন নেই। কিছুদিন আগের কথা। কোচবিহারে, বাড়ির কাছে সাগরদিঘির পাড়ে আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম চারজন বন্ধু মিলে। পকেটে তাস ছিল। ঘাটে বসে ব্রিজ খেলছিলাম। খেলার মাঝামাঝিতে কয়েকজন ছেলে পেছন থেকে বলল, ‘দাদা এখানে তাস-টাস খেলো না। কখন তুলে নিয়ে যাবে, কিছু বুঝবে না।’ যতদূর জানি, তাস খেলা আমাদের দেশে নিষিদ্ধ নয়। উত্তর দিলাম, ‘কেন? আমরা তো টাকা দিয়ে খেলছি না!’ তারা বলল, “জানি। কিন্তু ‘মামা’-দের বোঝাতে পারবে? ওদের টাকা তোলা দিয়ে কথা! আমরা তো তাসও না, উনো খেলছিলাম, তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভালোর জন্যই বললাম।”
এ শুধু একটা ঘটনার উদাহরণ। এমন হাজার হাজার ঘৃণা রোজ পুঞ্জীভূত হয় পুলিশের বিরুদ্ধে। কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজ থেকে শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা জানানোতে সাধারণ মানুষের বিদ্রুপ ছিল দেখার মতো। যখন অনুব্রত মণ্ডলের পুলিশকে দেওয়া খিস্তি, তার পরিবারের মহিলা সদস্যদের নিয়ে অশ্লীল কটূক্তি, তাকে জনসম্মুখে পেটানোর হুমকির কল রেকর্ডিং ভাইরাল হল, সাধারণ মানুষ দেখেনি পুলিশকে তার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনও কড়া পদক্ষেপ করতে। সাধারণ মানুষ পুলিশকে নেতা-মন্ত্রীর জুতোর সুকতলা চাটতে দেখেই অভ্যস্ত এবং তা অবাস্তব মোটেই না। তাই পুলিশে-মানুষে তারা একটা তফাত করতে শিখে গিয়েছে বহুদিন হল।
তবে যেটা ভাবার তা হল, এই গণতন্ত্র অচলায়তন নয়। অচলায়তনেরও দেওয়াল ভেঙেছিল। শাসকেরও পতন ঘটবে একদিন। সেদিন পুলিশের অবস্থানটা দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও নেপালের গণ অভ্যুত্থানে পুলিশের যে অবস্থান হয়েছিল, তাতে গিয়ে ঠেকলে তা হবে ভয়াবহ এবং অবশ্যই প্রত্যাশিত।
(লেখক অক্ষরকর্মী। খাগড়াবাড়ির বাসিন্দা)