পাঠের শেষ, পাঠ্য কুচিকুচি

পাঠের শেষ, পাঠ্য কুচিকুচি

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


 

  • অম্লান কুসুম চক্রবর্তী

মহীনের ঘোড়াগুলির থেকে ধার করি। আবার বছর কুড়ি পরে নয়, আগে ফিরে যাই। আমার স্কুলজীবন। সামনেই মাধ্যমিক। এবারে অঞ্জন দত্তের কাছে ফিরে যাই ফের। আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়। যায় বলাটা ভুল হল। যেত। আজ তাকে খেয়ে নিয়েছে সতেরোতলা অট্টালিকা। হাইরাইজ। সামনেই ছিল এক মস্ত পুকুর। বেনেবুড়ি জলে ডুব দিত। পুণ্য করত। আর আমি পুণ্য করতাম পড়ার বই খুলে। ‘সামনে একটা মস্ত পরীক্ষা, বাবা। এই পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট জীবন বদলে দেয়। আর তো মাত্র দুটো বছর। উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট। ব্যাস। জীবন তৈরি।’ গুরুজনদের থেকে শোনা এই কথাগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল বলা চলে। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে পড়ার টেবিলের সঙ্গে লাগোয়া ড্রয়ারটা টানতাম। ওর মধ্যে বন্দি ছিল আমার আগামীদিনগুলোতে ছুটির মজা। মাধ্যমিকের শেষ আর উচ্চমাধ্যমিকের পড়ার শুরুর মধ্যে কয়েকটা দিন তো ময়ূরের মতো পেখম মেলে থাকে। পেখমজোড়া ছুটি। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। ড্রয়ারের মধ্যে রাখা ছিল গত বছরের শারদীয় আনন্দমেলা আর শুকতারা। প্লাস্টিকে মুড়িয়ে সেলোটেপ দিয়ে রেখেছিলাম, যেন গন্ধ না যায়। মনে পড়ে, খবরের কাগজ দেওয়া কাকু যেদিন ‘বাবু, পুজোটা দিয়ে গেলাম’, বলে হাঁক দিয়েছিল, মা এসে বলেছিল আমায়, ‘সামনে যে মাধ্যমিক। এবারও!’ প্লাস্টিকে মুড়ে রেখে দেওয়া কি নিজের কাছেই এক শপথগ্রহণ ছিল? নতুন বইয়ের গন্ধকে হাত জোড় করে বলেছিলাম, “যাস নে, যাস নে।” তাই প্লাস্টিক। তাই সেলোটেপ। বইমেলা যেতে পারিনি সেই বছর। বাবা এনে দিয়েছিল কাকাবাবু সমগ্র। আরেকটা প্লাস্টিকে মুড়ে রেখে দিয়েছিলাম সেটাও। ক্লান্ত লাগলে ড্রয়ার খুলে একবার দেখে নিতাম। প্রচ্ছদ থেকে কাকাবাবু যেন বলে উঠতেন, ‘আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। আমি আর সন্তু অপেক্ষা করে রয়েছি তোমার জন্য।’ সদ্য বিদেশ থেকে ফিরে আসা আমার এক দাদা আমায় উপহার দিয়েছিলেন দুটো ফ্লপির সেট। এক মাইক্রোচিপে এক টেরাবাইট তখন রূপকথার গল্পর মতো ছিল। পরীক্ষা শেষ হলে সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ১.৪৪ মেগাবাইটের ‘মস্ত’ স্টোরেজে যে কোন ওয়ালপেপার ছেড়ে কোনটা ডাউনলোড করব তা নিয়ে এক আমি অন্য আমির সঙ্গে যুদ্ধ করত। প্রিয় বন্ধু বলেছিল, ‘পুরী যাওয়ার ট্রেনের টিকিটটা ল্যামিনেট করে রেখে দিয়েছি পড়ার টেবিলে রাখা সরস্বতীর ঠিক পাশে। কবে যাচ্ছি জানিস? পরীক্ষা যেদিন শেষ হচ্ছে ঠিক সেদিন রাতে।’ দেবী পড়ার শক্তি দিতেন। আর টিকিটটা ক্লান্তি থেকে ওকে মুক্তির সন্ধান দিত। পাঠ্যবইয়ের ওপরে মাঝেমধ্যে হাত বুলোতাম আমি। আমি বলা ঠিক হল না। আমরা। ওদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হবে আর কয়েকদিন পরেই। হয় স্কুলের নীচু ক্লাসে পড়া ভাইদের কাছে চলে যাবে। কিংবা স্থান পাবে বাড়িতে রাখা বইয়ের আলমারির একেবারে ওপরের তাকে। ওদের সঙ্গে নিত্যদিনের ওঠাবসা আর থাকবে না। স্থানাভাব হলে হয়তো বিক্রিও হয়ে যেতে পারে কয়েক মাস পরে।

পরীক্ষার শেষ দিনে বইয়ের পাতা কুচিকুচি করে উড়িয়ে দেওয়া ছাত্রছাত্রীরা হয়তো এর মর্ম বুঝতে পারবে না কোনওদিন। কিংবা, আমরাই হয়তো বুড়িয়ে গিয়েছি অনেক। মাত্র কয়েকদিন আগে শেষ হয়েছে এ বছরের মাধ্যমিকের লিখিত পরীক্ষা। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে যেভাবে ভেসে এসেছে পরীক্ষা শেষের উদযাপনের ছবি, তা দেখে তাজ্জব বনে গেলাম। শুধু তাই নয়। গলার কাছে যেন চেপে ধরল ভয়ের আঁকশি। সামাজিক মাধ্যমে, টেলিভিশনে, খবরের কাগজের অফলাইন এবং অনলাইন সংস্করণে দেখলাম বই কুচিকুচি করার দৃশ্য। উড়িয়ে দেওয়া ছিন্ন পাতা। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললে ভুল বলা হবে। এক জেলার খবর লজ্জা দিল অন্য জেলাকে। বই ছেঁড়া হয়েছে শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিমে, রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে। যে জেলাগুলো থেকে বই ছেঁড়ার ঘটনার কথা জানতে পেরেছি, তার মধ্যে রয়েছে আলিপুরদুয়ার, মালদহ, উত্তর ২৪ পরগনা। আছে কলকাতাও। এই জেলাগুলি থেকে ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। আমরা জানতে পেরেছি। তবে বই ছেঁড়ার এই নয়া ট্রেন্ড দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যতটুকু জানতে পেরেছি, তার থেকে অনেক বেশি ঘটনা হয়তো আমাদের অজানাই রয়ে গিয়েছে।

পাঠ্যবই আমাদের কী দেয়? কয়েকটা পাতার মধ্যে শুধুই কি লুকিয়ে থাকে আগামী ক্লাসে ওঠার রাস্তা? বইয়ের পাতাগুলো কি আমাদের সঙ্গে কোনও কথা বলে না স্কুলজীবনে? বই মানে কি পরীক্ষা শুরুর আগের দিনে মাইক্রো ফোটোকপি? এক হতাশাগ্রস্ত ছাত্রের কথা জানতে পারলাম। সে বলেছে, ‘পরীক্ষার হলে যদি বই থেকে টুকতেই না পারি, তাহলে সেই বই রেখে দিয়ে কী লাভ?’ গার্ড নাকি অতিরিক্ত কড়া ছিলেন ওই স্কুলে। ছাত্রটি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বইয়ের পাতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায়। কালো ফুটপাথ আলো করেছে টুকরো কাগজের কোলাজ। বই ছিঁড়ে ফেলা কি ওই ছাত্রটির কাছে শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হাতিয়ার? পরীক্ষাকক্ষে যদি বই খুলে টুকতে পারা যেত, পাঠ্যপুস্তক প্রিয় হয়ে গিয়ে কি বক্ষে বিরাজ করত? হিজিবিজবিজ প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে চমকায়।

দিনের শেষে কপাল পুড়েছে মাধ্যমিকের পাঠ্যবইগুলির। পরিচিত এক অধ্যাপক এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘ক্লাস এইট পর্যন্ত বিনা বাধায় পাশ করে যাওয়া যায় বলে ওই বইগুলোর ওপরে ছাত্রছাত্রীদের রাগ থাকে না। মাধ্যমিকের গায়ে লেগে থাকে প্রায়োরিটি তকমা। এই পরীক্ষার্থীদের সমাজ দেখে। রেজাল্ট বেরোলে প্রতিবেশীদের ফোন আসে। একেবারে বইবিমুখ হলে মাধ্যমিকে ফেল করাও অসম্ভব নয়। নবম-দশম শ্রেণির বইয়ের সঙ্গে তাই জোর করে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। মনের মধ্যে রাগ থাকে বলেই সম্পর্কগুলোও হয়ে যায় অনেকটা ইউজ অ্যান্ড থ্রো-র মতো। পাতা ছিঁড়ে উল্লাসের মধ্যে তাই মিশে থাকে মুক্তির দামামা।’

কোন বিষয়ের পাঠ্যবইগুলির অন্তর্জলি যাত্রা সমাপ্ত হল তা জানতে বড় ইচ্ছে হয়। কতটা জটিল বই ছেঁড়ার সাইকোলজি? যে বিষয়ের পরীক্ষা খারাপ হল, সেই বই কি সবার আগে বিদায় নেয়? তার ওপরে তো সবচেয়ে বেশি রাগ থাকার কথা। ওটাই তো ডুবিয়েছে! পাতা ছিঁড়ে ফেলার সমীকরণ হয়তো এই সূত্র মেনে চলে না ঠিকঠাক। এক মনোবিদ বললেন, ‘পাঠ্যবই ছিঁড়ে উড়িয়ে দেওয়া তো মুহূর্তের উদযাপন। রাগস্খালন। ফলে শেষ দিনে যে বিষয়ের পরীক্ষা থাকে, সেই বইগুলোর বিদায়ের মাধ্যমে মনের মধ্যে ডিজে বক্স বাজানোর সম্ভাবনাই বেশি।’ বই ছিঁড়তে চাওয়া পরীক্ষার্থীদের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন করজোড়ে করা যেতে পারে।

পাঠ্যবই ছিঁড়তে বেশি ভালো লাগে না সহায়িকা? দ্বিতীয়টি থেকেই তো প্রশ্ন কমন আসে বেশি। বিজ্ঞাপন তাই বলে, অন্তত।

পরীক্ষার হলে টোকার বন্দোবস্ত থাকলে কি বইগুলো বেঁচে যেত?

বিনামূল্যে বই পাওয়ার সঙ্গে কি পাতা ছেঁড়ার ইচ্ছে সমানুপাতিক?

পরের দিন আফসোস হয়েছিল? জ্বালায় যারা, কুচিকুচি করে দিলেই কি প্রকৃত মুক্তি মেলে?

আমাদের মধ্যবিত্ত বড় হওয়ায়, যাপনে, পরীক্ষা খারাপ হওয়ার হতাশায় বইয়ের ওপর প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করেনি কখনও। উপায়ও ছিল না। ওপরের ক্লাসের দাদাদের থেকে পাওয়া বই, কিছু কেনা বই আর নিজেরা ওপরের ক্লাসে উঠলে নীচের ক্লাসের ভাইদের বই দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই বৃত্ত আবর্তিত হত। প্রথম দশজনে থাকা দাদাদের বইগুলোর ডিমান্ড ছিল খুব। প্রতি পাতায় আন্ডারলাইন করা থাকত ‘ইম্পরট্যান্ট’ লাইন। চাহিদা ছিল ফাঁকিবাজদের বইয়েরও। পাতায় পাতায় উল্লেখ করা থাকত মনে রাখার জন্য নানা আজব শর্টকার্ট। সেগুলো মনের মধ্যে আজও অবিনশ্বর। মেঘের নামের পাশে দেখেছিলাম ‘কেন মুলো নিম বাঁশ?’ কিউমুলোনিম্বাস!

কুচি কুচি করা পাতার সঙ্গে তো মিলিয়ে যায় এগুলোও। পরীক্ষা শেষ হয়। রাস্তাজুড়ে হাহাকার জেগে থাকে।

(লেখক সাহিত্যিক)

The publish পাঠের শেষ, পাঠ্য কুচিকুচি appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *