পত্রিকাকাকু

পত্রিকাকাকু

খেলাধুলা/SPORTS
Spread the love


  • জয়দেব সাহা

সন্ধ্যা সবে ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। শীতের দিন তো, বিকেল পাঁচটা বাজতেই সূর্যমামা বিদায় জানাতে তড়িঘড়ি শুরু করে দেয়। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলোতে আলো জ্বলছে। একটা লাল সাইকেল নিয়ে অনন্যা বড় রাস্তার বাঁক পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে ঢুকল। এই শহর বহুদিন ধরেই এই বাসস্ট্যান্ডকে ঘিরে আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। যদিও শহরের যানজট কমানোর জন্য, এখানে এখন আর বাস আসে না, তবু এই জায়গাটাকে ঘিরে ব্যস্ততা আজও এই শহরের বাস্তব। দোকানপাটগুলো এখনও আছে, মানুষ কেনাকাটা করতে আসেন।

নতুন স্ট্যান্ড শহর ছাড়িয়ে খানিকটা দূরে। বাসগুলো সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে শহরের বাইপাসের মোড়ে এসে দাঁড়ায়। সেখানে যাত্রী তুলে রওনা দেয় যে যার গন্তব্যের পথে। সে যাই হোক, অনন্যা সাইকেল নিয়ে পুরোনো বাসস্ট্যান্ডের মুখে পত্রিকার দোকানে গিয়ে দাঁড়াল। ঘড়িতে সময় এই সাড়ে পাঁচটা হবে হয়তো। অঙ্কের টিউশন থেকে ফেরার পথে মাসে দু’তিনবার ও এই পথে আসে। যদিও এর জন্য ওকে খানিকটা পথ ঘুরে হস্টেলে পৌঁছোতে হয়। তাতে অবশ্য কী-ই বা যায় আসে! শহরের বুকে এই একটা পত্রিকার দোকান, যেখানে নানান লিটল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে কমার্সিয়াল পত্রিকা, দৈনিক খবরের কাগজ থেকে শুরু করে পুজো সংখ্যা, বিশেষ ক্রোড়পত্র- সবই পাওয়া যায়। অবশ্য অনন্যার বিশেষ আকর্ষণ হল পত্রিকাকাকুর সঙ্গে গল্প করা।

ওঁর ভালো নাম আছে একটা, তবে অনন্যার কাছে উনি হলেন গিয়ে পত্রিকাকাকু। কাকু প্রায় কুড়ি বছর ধরে এই দোকানে কাজ করছেন। একসময় তো এই মস্ত শহরের বুকে একমাত্র পত্রিকার দোকান ছিল এটি। এখন অবশ্য আরও কয়েকটা দোকান গজিয়ে উঠেছে, কিছু কিছু বইয়ের দোকানও এখন পত্রিকা বিক্রি করে। তবে যদি পত্রিকার এক বিশাল সম্ভার পেতে হয়, তবে আজও এই শহরের একমাত্র ঠিকানা পুরোনো বাসস্ট্যান্ড। অনন্যা এগারো ক্লাসের ছাত্রী, গ্রাম থেকে এসে আস্তানা পেতেছে এই শহরেরই এক হস্টেলে। সাহিত্যের নেশাটা ওর ছোটবেলা থেকেই। ওদের গ্রামে সামান্য কিছু পত্রপত্রিকা ছাড়া আর সেরকম কিছু পাওয়া যেত না। এখানে এসে এই দোকানের সজ্জা দেখে তো ওর খুশির অন্ত নেই। নিয়মিত আসতে আসতে পত্রিকাকাকুর সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়েছে। সন্ধ্যাবেলার এই সময়টাতে এখানে খুব বেশি ভিড় হয় না। কাকুর সঙ্গে দিব্যি গল্প করা যায় তখন। ঘণ্টাখানেক বা তারও বেশি সময় অনায়াসেই কেটে যায় গল্পের তালে তালে।

পত্রিকাকাকুর সাহিত্যের জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যায় অনন্যা। “একজন মানুষ এত কিছু জানতে পারেন?”, প্রশ্নটা নিজেকেই করে ও। সত্যিই তো, কী জানেন না উনি? কোন পত্রিকার সম্পাদক কে, কোন লেখক-লেখিকাকে কোন সম্পাদক সুযোগ দিয়েছেন। কোন জেলায় সাহিত্যের আড্ডা বসে, কোন সাহিত্যিকের বাড়িতে বসে, কোন লেখাটা প্রথম কোন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল- সবই তাঁর নখদর্পণে।

সন্ধেরা যখন হাতছানি দেয়, পত্রিকাকাকুর কাছে বায়না করে অনন্যা- আবোল তাবোল থেকে ছড়া শোনাতে হবে। কাকু যখন সুর করে একুশে আইন পড়ে শোনান, মুগ্ধতার সঙ্গে তাকিয়ে থাকে ও। কখনও বা রামগরুড়ের ছানা শুনতে শুনতে ও যেন সত্যিই কোন এক অদ্ভুত দেশে হারিয়ে যায়। সেখানে কেউ হাসছে না, অথচ হাসিটা যেন বাতাসের সুরসুরির মধ্যেও ভেসে বেড়াচ্ছে। অনন্যা বিচরণ করতে থাকে কোন এক ভাবনার দেশে। টুকটাক কবিতা লেখার চেষ্টা করে অনন্যা। বেশ কয়েকবার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাঠিয়েছেও, কিন্তু কোথাও ছাপানো হয়নি। এ নিয়ে খুব মন খারাপ করলে, কাকু বলেন, “কবিতা তো শব্দের সমষ্টি না রে, কবিতা তো ভাবনার নাম। তুই আরও ভাবতে থাক, ভাবতে ভাবতেই দেখবি একদিন তোর ভাবনা নিজেরাই ডানা মেলতে শুরু করবে, তখন আর শব্দের বন্ধনীতে তোকে উপস্থিতি খুঁজতে হবে না। তোর কবিতাগুলোও দেখবি ছাপা হবে বড় বড় পত্রিকায়। যদিও সেদিন তুই আর ছাপার অক্ষরে আনন্দ খুঁজে পাবি না, সেদিনের আনন্দ শুধু কবিতার এলোমেলো হাতছানির মধ্যে লুকিয়ে থাকবে।’’ এত কঠিন কঠিন কথাগুলোর সবটা অনন্যা বুঝতে পারত না, তবে বোঝার চেষ্টা করত। হস্টেলে ফিরে কাকুর কথাগুলো ভাবত আর সত্যিই একটা কবিতার মায়াজাল তৈরির চেষ্টা করত।

একদিন শীতের সন্ধ্যা কুয়াশাদের নিয়ে খেলা করতে শুরু করেছে, ল্যাম্পপোস্টগুলো আলো আর আঁধারির গল্প বুনবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহরটা সেদিন বড্ড ছমছমে। শীত বেড়েছে, ঠান্ডা হাওয়া কাঁপুনি দিচ্ছে বারবার। আজ টিউশন নেই, হস্টেলে বসে বসে অনন্যা ভাবল একটু হাঁটা যাক। শীতল বাতাসের ছোঁয়া যেন কোনও প্রেমের গল্প শোনাচ্ছে। এই বাতাসের সঙ্গেই গল্প করতে করতে ও পৌঁছে গেল ওর প্রিয় কাকুর দোকানে। কিন্তু এ কী! কাকু যে দোকান বন্ধ করতে শুরু করেছে। অনন্যাকে দেখে বলে ওঠেন, “এসেছিস! আরেকটু পরে এলে তো বন্ধই করে দিচ্ছিলাম। কী করব বসে বসে? যা ঠান্ডা পড়েছে, লোক নাই একদমই।’’ দু’খানা ছোটদের কাগজ কিনল অনন্যা। তারপর কাকু দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বললেন, “আইসক্রিম খাবি?” শীতকালে আইসক্রিম খেতে খুব ভালোবাসে এই বছর পনেরোর বাচ্চা মেয়েটা।

“কিন্তু আজ তো দেখছি সব দোকানপাট প্রায় বন্ধ! আইসক্রিম কোথায় পাব?”, কৌতূহলী চোখে জিজ্ঞেস করল ও।

“সুকান্ত মোড়ে একটা নতুন আইসক্রিমের দোকান খুলেছে। আমি তো রোজ ওদিক দিয়েই বাড়ি ফিরি, অনেক রাত অবধি খোলা থাকে।’’, বলতে বলতে কাকু মোটর সাইকেলটা টেনে রাস্তায় নিয়ে এলেন।

“সুকান্ত মোড় তো অনেক দূর গো। স্টেশন যাওয়ার রাস্তায় পড়ে।’’

“হ্যাঁ, তো কী হয়েছে? বসে পর আমার বাইকে। দুজনে আইসক্রিম খেয়ে তারপর তোকে হস্টেলে ছেড়ে আসব।’’

পত্রিকা দুটো ব্যাগে ভরে উঠে পড়ল অনন্যা। আকাশের চাঁদটা ঠিক ওলটানো নৌকার মতো মনে হচ্ছে আজ। ঠান্ডা হাওয়া মুখের মধ্যে এসে ঝাপটা মারছে। এই শহর আজ বড্ড  নিঝুম, যেন কোনও কবি শব্দের জাদুকাঠি দিয়ে এঁকে দিয়েছেন আজকের দিনটা। মাফলারটা ভালো করে জড়িয়ে নিল অনন্যা। এ যেন এক অসম লড়াই, ঠান্ডা হাওয়া বদ্ধপরিকর যে ওর কানের কাছে গুনগুন গান শোনাবেই। আর মাফলার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে তাকে আটকানোর, কিন্তু পারছে না। সবকিছু তো আর বাঁধন মেনে হয় না। এই যেমন আজ প্রতিদিনের নিয়মের বাইরে একটু অন্যরকম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে অনন্যার জীবনে। বছর পনেরোর বাচ্চা মেয়েটার ভাবনাতেও আসেনি ওর জীবন আজ কোন দিকে বাঁক নেবে।

মিনিট দশেক বাদে আইসক্রিমের দোকানে পৌঁছাল ওরা। চকোলেট আইসক্রিম খুব পছন্দ ওর। সুতরাং, এই ব্যস্ত শহরের থেমে যাওয়া এক সন্ধ্যা ওদের দুজনের চকোলেট আইসক্রিমের ছবিটাও এঁকে রাখল ইতিহাসের এক অনামী পাতার মধ্যে। এই পাতা হয়তো কেউ কোনওদিন খুলেও দেখবে না। এই শহর তো কত গল্পই লিখে রাখে, কত ছবিই তো এঁকে রাখে কখনও অচেনা, কখনও বা চেনা ক্যানভাসে।

“চল, আজ তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব।’’, আইসক্রিম শেষ করে কাকু বলে উঠল।

“কোথায় গো?”

“চল, গেলেই দেখতে পারবি।’’

আবারও শুরু হল মাফলার আর হাওয়ার লড়াই লড়াই খেলা। একটা অন্ধকার গলি দিয়ে ওদের বাইক এগিয়ে যাচ্ছে।

“কাকু, এদিকে কি তোমার বাড়ি?”, জিজ্ঞেস করেছিল অনন্যা।

“না রে। চল না গিয়েই বুঝতে পারবি।’’

কিছুক্ষণ বাদে একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। কেমন যেন আলো-আঁধারির ছিমছিমে উপস্থিতি এখানে। ঠান্ডাটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। বাড়ির ওপরের তলায় আলো জ্বলছে। নীচের তলাটা পুরো অন্ধকার। বোধহয় নীচে কেউ থাকে না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল ওরা। একজন বৃদ্ধ একাই বসে আছেন।

এই শহর এলোমেলো কবিতা আর মানুষের ভিড়ের মধ্যেই প্রাণ খুঁজে বেড়ায়। কখনও হট্টগোল, আবার কখনও নিঝুম রাত্তিরে সুর তৈরি করে এই শহর, এই ছোট্ট শহর। যেমনভাবে আজ থেকে দশ বছর আগে তৈরি করত। রাস্তায় অনেক বেশি আলো এখন, মানুষজনও বেড়েছে, দোকানপাটও সব বদলে গিয়েছে অনেক। পুরোনো বলতে শুধু এই রাস্তাগুলো, আর এতগুলো বছর বাদে ফিরে আসা অনন্যা। দশটা বছর তো আর কম নয়। বড় রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ও, আরেকটু বাদে একটা বাঁক আসবে, ওখানেই পুরোনো বাসস্ট্যান্ড। লোকে বোধহয় ভুলতেই বসেছে যে এখানে এককালে বাস আসত। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তো জানেই না। অনন্যা ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পুরোনো আর নতুনকে মেলানোর চেষ্টা করছে হয়তো। কতদিন হয়ে গেল সেই আইসক্রিম খাওয়ার দিনটা। তারপর পত্রিকাকাকু নিয়ে গেলেন অবনী দাদুর বাড়িতে। অবনী দাদুর লেখা অনেক পত্রপত্রিকাই পড়েছিল ও। মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে চমকে উঠল। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অনেক গল্প চলেছিল সেখানে। বাড়ির ভেতর এত বই দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনও স্বর্গে এসে দাঁড়িয়েছে। অনন্যার লেখা কবিতা শুনে দাদু বললেন, “কী দারুণ ভাবনা রে তোর লেখার মধ্যে। এই লেখা একদিন আগুন লাগিয়ে দেবে। তুই লেখাটা ছাড়িস না কোনওদিন।’’ দাদু একটা ছোট পত্রিকা চালাতেন তখন, অনন্যার কবিতাও নিয়েছিলেন সেদিন, মাসখানেক বাদে প্রকাশিতও হয়েছিল সেটা। পত্রিকাকাকু এনে দিয়েছিল পত্রিকাটি। সেদিন ফেরার সময় দাদু বলেছিলেন, “আমার এখানে প্রতি রবিবার করে একটা সাহিত্যের আড্ডা হয়। যদিও তোর হস্টেল থেকে অনেক দূর হয়ে যাবে, তবু সুযোগ হলে আসিস কখনও।’’ না, অনন্যার আর যাওয়া হয়নি সেই আড্ডায়। সময়ের সঙ্গে সবকিছুই আজ কত আবছা হয়ে এসেছে। একটা সময় অনন্যা এই শহরকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল অনেক দূরে, আবারও একটা নতুন শহরে, নতুন গল্প আর নতুন সুরের খোঁজে। পেছনে এই শহর শুধু অপেক্ষায় থাকল। সময়ের সঙ্গে পত্রিকাকাকুও স্মৃতির পাতায় ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। নতুন শহরে নতুন পত্রিকাকাকুদের ভিড়ে, এই ছোট্ট শহর, এই পুরোনো বাসস্ট্যান্ড আর পুরোনো পত্রিকাকাকু শুধু অতীত। অবনী দাদু আর বেঁচে নেই, খবরের কাগজে ওঁর মৃত্যুর খবরটা ছোট্ট করে বেরিয়েছিল বছর তিনেক আগে। দাদুর সেই কথাটা খুব মনে পড়ে অনন্যার, “এই লেখা একদিন আগুন লাগিয়ে দেবে…”। না, আগুন হয়তো লাগায়নি, কিন্তু ওর লেখা এখন অনেক বড় কাগজে প্রকাশ পায়। কবিতার বই প্রকাশের ব্যাপারেও ভাবছে ও। কখনো-কখনো মনে হয়, দাদু বেঁচে থাকলে প্রথম বইটা দাদুর হাতে দিয়ে আসত।

বড় রাস্তা থেকে এবার বাঁক নিল অনন্যা, কিন্তু পত্রিকার দোকানটা কোথায়? বেশ খোঁজাখুঁজির পরে মনে হল একটা খাতা-কলমের দোকানে কিছু পত্রিকা ঝুলছে।

“দাদা, এখানে একটা পত্রিকার দোকান ছিল না?”, দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করল অনন্যা।

“হ্যাঁ, এটাই তো।’’

কেমন যেন একটা ধাক্কা খেল ও। মনটা মুষড়ে গেছে। কিছু পুজো সংখ্যা, কয়েকটা সাহিত্যের পত্রিকা আর খবরের কাগজ রাখা আছে দোকানটাতে। অথচ এই দোকানেই এক সময়…। না আর ভাবতে পারছে না ও, “দাদা, এখানে তো আগে অনেক পত্রিকা থাকত।’’

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দোকানের দাদা উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এখন আর থাকে না। শহরের বাইপাসের রাস্তায় একটা দোকান আছে, ওখানে অনেক পত্রিকা পাওয়া যায়। এদিকটায় তো লোকজনও আর আগের মতো আসে না।’’

খুব কষ্ট হতে লাগল অনন্যার। হ্যাঁ, সত্যিই তো শহরের কেন্দ্রবিন্দু পালটেছে। এই শহর এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। “দাদা, এখানে একজন কাকু থাকতেন তো। উনি কখন আসবেন?”

“ও তো আর থাকে না গো। ও তো কর্মচারী ছিলেন দোকানের। মালিক তো দোকান বেচে দিয়েছে। আমি কিনেছি।’’

“কাকু এখন কোথায় গো?”

“ও এখন টোটো লাইনে আছে। টোটো চালিয়ে রোজগার আছে বেশ, পেট চালাতে হবে তো!’’



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *