- শৌভিক রায়
দশ বাই বারো ফিতের ঘরটায় বসে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, এটা স্টুডিও নাকি বিপণী? হস্তশিল্পের কাজ চলছে একদিকে। সেখানে শামিল বাড়ির বাচ্চা-বুড়ো সবাই। মহিলারাও আছেন। তাঁরা অবশ্য বেশি ব্যস্ত বেচাকেনায়। বাড়ির উঁচু দাওয়ায় পসরা নিয়ে দিব্যি বসে আছেন।
এমনই এক বিক্রেতা তরুণীর সঙ্গে কথা হল। সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছেন। জানতে চাইলাম, এর পরের পরিকল্পনা কী। নির্দ্বিধায় বললেন, নিজেদের গ্রামের এই বিপুল সম্ভারকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়া। ভালো লাগল কথাগুলি। বর্তমান প্রজন্মের সবাই বোধহয় এটাই চাইছেন।
আসলে মাত্র দশ কিমি দূরে পুরী শহর। এত মানুষের ভিড় সেখানে। কিন্তু তাঁদের গ্রাম রঘুরাজপুরে আসেন আর ক’জন! অথচ বিশ্ববন্দিত নৃত্যগুরু কেলুচরণ মহাপাত্র জন্মেছেন এখানে। বিখ্যাত গোতিপুয়া নৃত্যশৈলীরও উৎসভূমি এই গ্রাম। তবে সেসব ছাপিয়েও পটচিত্রের জন্য আজ তার বিশেষ খ্যাতি। নারকেল, পাম, আম, কাঁঠাল ইত্যাদি গাছের ছায়া সুনিবিড় রঘুরাজপুরে বংশপরম্পরায় চলে আসছে পটচিত্রের কাজ।
পটচিত্র কথাটি এসেছে পট্ট অর্থাৎ বস্ত্র আর চিত্র বা ছবি থেকে। কাপড়ের ওপর আঁকা ছবিকে তাই পটচিত্র বলা হয়। ঠিক কবে থেকে পটচিত্রের চল সেই বিষয়ে প্রামাণ্য কোনও তথ্য নেই। তবে মনে করা হয়, দ্বাদশ শতকে এর উদ্ভব। আজকের দিনে ছবি আঁকার জন্য মূলত তসর ব্যবহৃত হলেও, অন্য কাপড়েরও চল রয়েছে। কাপড়ের ওপর প্রাকৃতিক রং ব্যবহারের আগে, তেঁতুল বীজের আঠার প্রলেপ দেওয়াই রেওয়াজ। রঙের জন্য ব্যবহার করা হয় শঙ্খের ও বিভিন্ন পাথরের গুঁড়ো, কেরোসিন তেলের আলো থেকে প্রাপ্ত কালি, শাকসবজি ইত্যাদি। কখনও দুটো কাপড়কে জোড়া দিয়ে আঁকার চলও প্রচলিত। বিষয়বস্তু হিসেবে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের নানা কাহিনীর পাশাপাশি অতি অবশ্যই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা স্থান পান।
মনে করা হয়, জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা ও রথযাত্রাকে কেন্দ্র করেই পটচিত্রের আবির্ভাব। রীতি অনুসারে স্নানযাত্রার সময় তাঁদের তিন ভাইবোনকে ১০৮ ঘড়া জলে স্নান করানো হয়। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁরা। দর্শন দিতে পারেন না। তখন জগন্নাথ দেবের প্রতিভূ হয়ে দেখা দেন পুরীর কুড়ি কিমি দূরে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের স্মৃতিবিজড়িত ব্রহ্মগিরি শহরের আলারনাথ। আবার রথযাত্রার সময়েও জগন্নাথ দেবের দর্শন পাওয়া যায় না, যেহেতু তিনি তখন থাকেন মাসি গুন্ডিচা দেবীর কাছে।
যেহেতু বহু সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়, তাই পরিধেয় বস্ত্রের ওপর তাঁদের ছবি আঁকার প্রচলন শুরু হয়। কালক্রমে সেটিই পরিণত হয় পটচিত্রে। তবে শুধু পটচিত্র নয়, শুকনো তাল পাতার ওপর আঁকা দেখলেও চমকে উঠতে হয়। সরু পাতাগুলিকে ভাঁজ অথবা সেলাই করে যে ছবি আঁকা হচ্ছে, সেগুলি চাক্ষুষ না দেখলে বোঝা যায় না কতটা সূক্ষ্ম সেসব কাজ। এসব বাদেও নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বানানো বিভিন্ন শোপিস, সুপারির ওপর আঁকা ছবি ও নকশা দেখে স্তম্ভিত হতে হল। পাথরের ওপর কাজগুলিও অনবদ্য।
শিল্পীগ্রাম বলে খ্যাত রঘুরাজপুরে পৌঁছোনো মাত্রই মন ভরে উঠেছিল সুদৃশ্য বাড়িগুলি দেখে। প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল সুন্দর সব ছবিতে সজ্জিত। নানা কিছু এঁকে রেখেছেন এই গ্রামের শিল্পীরা। বাড়িগুলি নিজস্বতায় আলাদা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। প্রায় একশো তিরিশটি পরিবারের প্রায় সকলেই শিল্পী। এরকম একটি গ্রামও যে থাকতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না কখনও।
বরং রঘুরাজপুরের আটাশ কিমি দূরে পিপিলিতে এসে প্রথমটায় হতাশ হলাম। আসলে আমার ধারণা ছিল রঘুরাজপুরের মতো এটিও একটি গ্রাম। কিন্তু পিপিলি ইতিমধ্যেই শহরের আকার নিয়েছে। পিপিলিতে আসার কারণ একটাই। পুরীর রথযাত্রার সময় রথগুলিকে যে বিরাট বিরাট রঙিন কাপড়ে সাজানো হয়, সেগুলি তৈরি করেন এখানকার মানুষ। তাছাড়াও অ্যাপ্লিকের কাজের জন্য বিখ্যাত হল এই জনপদটি। চাঁদোয়া, ছাতা, কাপড়ের ব্যাগ, মানিব্যাগ, মেয়েদের পোশাক ইত্যাদির জন্য ওডিশা তো বটেই, দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসছেন এখানে। পাসাপালি ডিজাইন ও সম্বলপুরী ইক্কতের খনি হল পিপিলি। তাজ্জব হলাম এখানকার ছোট ছোট দোকানগুলির বিপুল পরিমাণ মজুত দেখে। প্রত্যেকটি বিপণী নিজের মতো করে অনবদ্য।
তবে রঘুরাজপুরের গ্রাম্য সৌন্দর্য নেই এখানে। আধুনিক সভ্যতার স্পর্শে সে যেন একটু অন্য ধরনের। অন্যদিকে, ইতিমধ্যেই ইউনেসকোর ‘হেরিটেজ ক্রাফট ভিলেজ’-এর মর্যাদা পেয়েছে রঘুরাজপুর। পিপিলি অবশ্য ব্যবসার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে রীতিমতো পরিচিত।
দুটি জনপদের মিল একটি জায়গায়। এখানকার মানুষ হাজার বছরের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আবহমানকাল থেকে এইভাবে শিল্পকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার দৃষ্টান্ত খুব কম। শিল্প তাঁদের কাছে শুধুমাত্র জীবিকা নয়। বরং এক অন্তর্গত তাগিদ…ভেতর থেকে উঠে আসা একমাত্র ভালোবাসা।