- রুদ্র সান্যাল
আজকাল সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল ফোন হাতে না নিলে যেন দিনটাই অপূর্ণ থেকে যায়। নোটিফিকেশন দেখে মনে হয় পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রাতের মধ্যে ঘটে গিয়েছে! আর সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই নতুন নতুন ট্রেন্ডের জোয়ার। কিন্তু এসব ট্রেন্ডের মধ্যে কোনটা সত্য, কোনটা ফাঁপা গুজব- তা বোঝার উপায় নেই।
একবার ভাবুন,‘নীল তিমি’ গেমের কথা। কয়েক বছর আগে ইন্টারনেটজুড়ে এ নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটি এমন এক মারণ গেম, যা খেলোয়াড়কে ধাপে ধাপে মানসিক চাপে ফেলে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। খবরের কাগজ থেকে টেলিভিশন, সবাই আতঙ্কিত! অথচ পরে দেখা গেল, নীল তিমির অস্তিত্বই নেই!
সাম্প্রতিক সময়ে আরেক ‘নীল’ আমাদের জীবন ওলট-পালট করে দিয়েছে- নীল বোতাম বা নীল টিক! হ্যাঁ, সেই ছোট্ট ‘ভেরিফায়েড’ চিহ্ন, যা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলে থাকলে মনে হয় আমরা হঠাৎ করেই বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে গিয়েছি। আগেকার দিনে মানুষ সম্মান অর্জন করত জ্ঞানের জন্য, সমাজে অবদান রাখার জন্য। আর এখন? টাকার বিনিময়ে নীল বোতাম কিনলেই আপনি ‘বিশেষ ব্যক্তি’!
এটা ঠিক যে, সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়া আমাদের অনেক সুবিধা দিয়েছে- দ্রুত খবর পাওয়া, দূরের মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখা, নিজের চিন্তা প্রকাশ করা। কিন্তু একই সঙ্গে এটি আমাদের এমন এক জগতে নিয়ে গিয়েছে, যেখানে সত্য-মিথ্যার ফারাক বোঝা মুশকিল হয়ে গিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, কয়েকদিন আগে এক ভদ্রলোক সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন, ‘আজ থেকে আমি ফেসবুক ছেড়ে দিচ্ছি’- আর সে পোস্ট রাতারাতি ভাইরাল! সবাই লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করতে লাগল। মজার ব্যাপার হল, যিনি ফেসবুক ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেন, তিনিই পরের দিন আবার নতুন পোস্ট দিলেন! এটা যেন এক ধরনের ডিজিটাল নাটক।
তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি? প্রযুক্তির এই যুগে আসল তথ্যের চেয়ে গুজব বেশি প্রচারিত হয়, সত্যের চেয়ে লাইক-কমেন্টের গুরুত্ব বেশি। ‘নীল তিমি’ আমাদের ভয় দেখিয়েছে, আর ‘নীল বোতাম’ আমাদের অহংকার বাড়িয়েছে।
এবার ভাবুন, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমরা নিজেদের চিন্তাশক্তি কতটা ব্যবহার করছি? আমরা কি সত্যিই বিশ্লেষণ করছি, নাকি ভিড়ের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি? আগে মানুষ বই পড়ত, গবেষণা করত, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করত। এখন? এখন খবরের শিরোনাম পড়েই আমরা মতামত দিয়ে দিই, যাচাই করার প্রয়োজনই বোধ করি না।
এর চেয়েও ভয়ংকর দিক, অনেক মানুষ আজকাল নিজেদের জীবনের মূল উদ্দেশ্যই ভুলে যাচ্ছে। কেউ কেবল লাইক আর শেয়ারের পেছনে ছুটছে, কেউ বা নীল বোতামের পেছনে। অথচ বাস্তব জীবনে তাদের কোনও সত্যিকারের প্রভাব নেই। জনপ্রিয়তা মানেই প্রভাব নয়, আর সত্যের সঙ্গে ভাইরাল হওয়ার কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই।
তাই, সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু দেখলেই আতঙ্কিত হওয়ার আগে একটু ভাবুন, যাচাই করুন। কারণ, এক ক্লিকেই আপনি হতে পারেন বিভ্রান্তির শিকার, আবার এক ক্লিকেই আপনি ছড়িয়ে দিতে পারেন আলো! প্রশ্ন হল, আপনি কোনটা করবেন?
(লেখক বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্রের শিক্ষক)