- পূর্বা সেনগুপ্ত
উত্তরবাংলার এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র দেবী চৌধুরানি। যাঁকে আমরা শুধু একটি উপন্যাসের মধ্য দিয়ে স্মরণে রেখেছি। প্রায়শই আমাদের স্মরণে থাকে না এই চরিত্র উপন্যাসের নয়, কোনও একসময় তা এক রক্তমাংসের জীবন্ত অস্তিত্ব ছিল। দেবী চৌধুরানি ছিলেন প্রথম নারী, যিনি সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে ব্রিটিশ মদতে পুষ্ট দেশীয় জমিদারদের নারী ও সাধারণ মানুষদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন। তাঁর পথপ্রদর্শক ও গুরু ভবানী পাঠক জগৎ কল্যাণ্যের জন্য এক অভিনব উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন। তাঁরা জমিদার ও অবস্থাপন্ন মানুষদের ঘরে ডাকাতি করতেন আর সেই ডাকাতির অর্থ বিলিয়ে দিতেন সাধারণ ও গরিব মানুষদের মধ্যে।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের মধ্যে আমরা দেখছি, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে ২৭শে ডিসেম্বর, ১৮৮৪ সালে, শ্রীরামকৃষ্ণ বঙ্কিমচন্দ্র রচিত দেবী চৌধুরানি উপন্যাসটি আনিয়েছেন। ভক্তদের মধ্যে কেউ পাঠ করছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ শুনছেন সেই দর্শনের কথা, যা বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। সেখানে প্রফুল্ল যিনি দেবী চৌধুরানি হয়ে উঠবেন, তিনি জানাচ্ছেন, স্ত্রীর কাছে স্বামীই ভগবান। মাটির প্রতিমা কিংবা প্রতিমায় ঈশ্বরের ধারণা তাঁকে তৃপ্তি দিতে পারে না। তিনি তাঁর স্বামীকেই ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করেন।
প্রফুল্লের মুখের এই কথাগুলি শ্রীরামকৃষ্ণ স্বীকার করছেন এবং বলছেন নারীদের পতিই দেবতা এই ভাবনা ঈশ্বর সাধনার একটি অঙ্গ হতে পারে। সন্ন্যাসী আন্দোলনের হাত ধরে দেবী চৌধুরানি একটি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেছিলেন। সামান্যা নারী থেকে তাঁর দেবী হয়ে ওঠার কাহিনী সত্যই চমকপ্রদ।
তবে এখানে একটি বড় প্রশ্ন যে গৃহদেবতার আলোচনায় আমরা দেবী চৌধুরানির প্রসঙ্গ তুলে আনছি কেন? এর উত্তরে বলা যায়, দেবী চৌধুরানি ছিলেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ফসল। তাঁর গুরু ভবানী পাঠক অন্য ডাকাতদের মতোই দেবতাকে আরাধনার পরই ডাকাতি করতে যেতেন। ভবানী পাঠকের আরাধিত ডাকাতকালীই আজ আমাদের আলোচনার বিষয়। ভবানী পাঠকের আরাধিত কালীর অবস্থান ঠিক কোথায় তা নিয়েও মতদ্বৈধ আছে। একটি জলপাইগুড়ি থেকে কুড়ি মাইল দূরে, শিকারপুর চা বাগানের ভেতরে। একটি জলপাইগুড়ি শহরের একপাশে করলা তীরে।
আমাদের জানা জরুরি, যে তিনটি অঞ্চলে বিস্তৃত দেবী চৌধুরানি ও ভবানী পাঠকের অস্তিত্ব। দেবী চৌধুরানির সময় হল ১৭৮৫ সাল, বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চল। অধুনা বাংলাদেশের পীরগাছা উপজেলার মন্থনা নামক স্থানে দেবী চৌধুরানির রাজবাড়ি অবস্থিত। জমিদার অনন্তরাম ছিলেন কোচবিহার রাজার কর্মচারী। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ অনন্তরাম কর্মচারী থাকার সময়েই জমিদারি পত্তন করেন। কোচবিহারের রাজা তাঁকে নিজের অধীন জমিদার পদ প্রদান করেছিলেন। অনন্তরামের পুত্র যাদবেন্দ্র নারায়ণ। যাদবেন্দ্র নারায়ণের পুত্র রাঘবেন্দ্র নারায়ণ ও পৌত্র নরেন্দ্র নারায়ণ। এই নরেন্দ্র নারায়ণ অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর বিধবা পত্নী জয়দুর্গা দেবী জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই জয়দুর্গা দেবীই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ দেবী চৌধুরানি। তিনি জমিদার গৃহিণী হয়েও প্রজাদের সঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একজন সক্রিয় পরিচালক ও কর্মী ছিলেন। মন্থনার জমিদারদের ২৮ একর জমির উপর তৈরি বিরাট রাজবাড়ি এখন পরিত্যক্ত ও ভগ্নদশা নিয়ে পড়ে।
এই রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এখন ক্ষীণস্রোতা ‘ঢোস মারা খাল’ নামে এক বিরাট খাল। সেই খালের সঙ্গে রাজবাড়ির যোগ ছিল এক সুড়ঙ্গের মাধ্যমে। আর সেই সুড়ঙ্গ দিয়েই নৌকাযোগে জয়দুর্গা দেবী তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। এই মন্থনার জমিদারবাড়ি এখন জঙ্গলে পরিণত হলেও তার সম্মুখভাগে জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত মন্দির এখনও রয়েছে। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জমিদারি লাভের আগে, জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণের মাধ্যমে। সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তিনটি মূর্তি। অন্নপূর্ণা, বিশ্বেশ্বর শিব ও হরিহর মূর্তি। অন্নপূর্ণা ও বিশ্বেশ্বর শিব মঙ্গলকাব্যের মাধ্যমে গঠিত দেবভাবনা। এই তিন মূর্তি মঙ্গলকাব্যের সমসাময়িক বলে ধরা যায়।
ভবানী পাঠক ছিলেন মূলত উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর অঞ্চলের লোক। তিনি ভাগ্যান্বেষণে উপস্থিত হয়েছিলেন অধুনা দুর্গাপুর অঞ্চলে। এখন দুর্গাপুর মিশন হসপিটালের পিছনে ভবানী পাঠকের ডেরা দেখতে পাওয়া যায়। একমতে এই অঞ্চলের থেকে সোজাসুজি গেলে বাংলাদেশের রংপুরের গাইবান্ধা অঞ্চল। সেই গভীর জঙ্গলে ছিল দেবী চৌধুরানির ডেরা।
আমরা আগেই বলেছি দেবী চৌধুরানি মূলত উঠে এসেছিলেন নারীদের উপর অত্যাচারের ঘটনা থেকে এমনই একটি সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসেও তাঁকে বাগদির বেটি ও স্বামী পরিত্যক্তা রূপে দেখতে পাই। এই মতে তিনি জয়দুর্গা দেবীর কাছ থেকে সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন কিন্তু জয়দুর্গা ও দেবী চৌধুরানি এক চরিত্র নন কখনোই। জয়দুর্গা দেবী পশ্চিম দিনাজপুর শাসন করতেন। তিনি ট্রাইবাল বা আদিবাসী ছিলেন বলে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন এমন সম্ভাবনার কথাও অনেকে বলেন। দেবী চৌধুরানি অবশ্যই বাস্তব চরিত্র ছিলেন কিন্তু তাঁকে নিয়ে নানা কাল্পনিক কাহিনীর কোনও অভাব নেই।
আমরা জলপাইগুড়ি জেলার দুটি মন্দির নিয়ে আলোচনা করব। দুই মন্দিরই ভবানী পাঠকের মন্দির নামে চিহ্নিত। একটি জলপাইগুড়ি ন্যাশনাল হাইওয়ের পাশে। সেই অঞ্চলে মাটির নীচ থেকে পাওয়া গিয়েছে প্রাচীন বজরা ও নৌ সংক্রান্ত অনেক কিছু। সবই হয় থানায় বা মিউজিয়ামের বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ। স্থানীয় মানুষদের কাছে এটি শ্মশানকালীর মন্দির। কিন্তু পর্যটন বিভাগ এই মন্দিরকে দেবী চৌধুরানির মন্দির রূপে স্বীকার করেনি। ১৯০৫ সালে যে সিট ম্যাপ তৈরি হয় সেখানেও এই কালী মন্দিরের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ হল শতাব্দীপ্রাচীন এক মন্দির।
দ্বিতীয় যে মন্দিরটি সরকার কর্তৃক ভবানী পাঠকের মন্দির রূপে স্বীকৃতিলাভ করেছে সেই মন্দির হল জলপাইগুড়ি শহর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে শিকারপুর অঞ্চলে। এখানে চা বাগানের ধারে বহু প্রাচীন কাঠের মন্দিরের দেখা পাওয়া যায়। মন্দিরে দুটি কালীমূর্তি। একটি থানকালী অপরটি ভদ্রকালী। এই থানকালী হলেন খুব প্রাচীন কাঠের মূর্তি। এইরকম দারুমূর্তি সত্যই বিরল। এই মূর্তিই নাকি ভবানী পাঠক পুজো করে ডাকাতি করতে নির্গত হতেন। আরেকটি মন্দিরে দেবী চৌধুরানি, ভবানী পাঠক, তিস্তাবুড়ি, গঙ্গা দেবী, সিদ্ধিরাজ ও নরসিংহ শেয়াল প্রতিষ্ঠিত। সামনে দুটি সৈনিক, তাদের কাঁধে রাইফেল বেশ বিস্ময় সৃষ্টি করে।
মন্দিরে সৈনিক মূর্তি? বেশ আশ্চর্য ব্যাপার। ২০১৮ সালে এই মন্দির অগ্নিদগ্ধ হলে নতুন করে কাঠের মন্দির ও মূর্তি তৈরি হয়। এদের মধ্যে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানির দারুমূর্তির মুখটুকু বেঁচে যায়। সেই মুখের অনুকরণে, পুরোনো ছবির সাহায্য নিয়ে নতুন মূর্তি গঠন করা হয়েছে। পাশে আছে টিন ঢাকা একটি স্থান সেখানে বেশ কয়েকটি গ্রামদেবতার পুজো করা হয়। মন্দিরটিতে থানকালী আগে বৈষ্ণবী শ্যামাকালী ছিলেন। নিরামিষ ভোগ হত। কিন্তু পরে কেউ তাঁকে কৃষ্ণবর্ণ বানিয়ে আমিষ ভক্ষণে বাধ্য করেছেন। বর্তমান পুরোহিত নাকি বংশপরম্পরায় পুজো করে আসছেন। তিনি সেই পূজারি বংশের উনিশতম প্রজন্ম।
মন্দিরটিকে ভবানী পাঠকের মন্দির বলে চিহ্নিত করা হলেও একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে উঁকি দেয়, – দেবী চৌধুরানি ও ভবানী পাঠক নিজেদের মূর্তি পুজো করতেন? নাকি দুজনের মূর্তি পরবর্তীকালের সংযোজন। তবে এই মন্দিরে দেবী চৌধুরানি মূর্তির মুখে আদিবাসী প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট।
জলপাইগুড়ির রাজা দর্পদেব রায়কত ১৭২৮ থেকে ১৭৯৯ পর্যন্ত শাসন করেন। কথিত আছে এই সময় তিনি এক সন্ন্যাসীর মাধ্যমে প্রভাবিত হন। সেই সন্ন্যাসীই হলেন ভবানী পাঠক। রাজা দর্পদেবই নাকি এই দ্বিতীয় মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাই এই মন্দিরকে অনেকে ‘সন্ন্যাসী ঠাকুরের মন্দির’ নামেও চিহ্নিত করে থাকেন। রাজা দর্পদেব অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের অধীনতা কখনও স্বীকার করেননি বা মেনে নেননি। তাই ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব সর্বক্ষণ লেগেই থাকত। দেবী চৌধুরানির সঙ্গে রাজা দর্পদেবের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। শোনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র যে প্রফুল্লের স্বামী ব্রজেশ্বরের চরিত্র বর্ণনা করেন তা কিছুটা রাজা দর্পদেবের ছায়ায় রচিত।
বঙ্কিমচন্দ্র বৈকুণ্ঠপুরের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। তিনি এই কাহিনী নিয়ে দেবী চৌধুরানি উপন্যাস রচনা করেন, যার প্রথম সংস্করণে সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা থাকলেও পরবর্তীকালে তা কাল্পনিক চরিত্র বলে লেখা হতে থাকে। আবার উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ চারুচন্দ্র সান্যাল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে জানিয়েছেন রংপুর, দিনাজপুর আর বৈকুণ্ঠপুর– এই তিন জেলা ছিল দেবী চৌধুরানির এলাকা। সেদিক দিয়ে বৈকুণ্ঠপুরের শ্মশানকালীই কিন্তু ভবানী পাঠক বা দেবী চৌধুরানি পূজিত কালীরূপে মান্যতা পাওয়ার বেশি অধিকারী। শোনা যায় ১৮৯০ সালে নয়ন কাপালিক নামে এক কাপালিক এই মন্দিরে আসেন। কালীপুজোর কালে একজনকে তিনি বলি দিয়েছিলেন। সেই নরবলি দেওয়ার জন্য নয়ন কাপালিকের ফাঁসি হয়। বিতর্ক থাকলেও ভারতের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানির অস্তিত্ব যে এক উল্লেখযোগ্য বিষয় তাতে সন্দেহ নেই।