দিন-দিন ব্রাত্য রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা

দিন-দিন ব্রাত্য রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


শঙ্খনাদ আচার্য

সময়টা বিগত শতাব্দীর নব্বই-এর দশক কিংবা একবিংশ শতকের গোড়ার দিক। উত্তরের প্রান্তিক জনপদগুলোতে তখন সংস্কৃতিমনস্কতার বিকাশে বছরে হাতেগোনা কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত কিছু ক্লাব বা সংস্থা। এই অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বলার মতো, গ্রীষ্মের তীব্র তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করে আয়োজিত রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার‌। কখনও রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যা হত সুকান্ত ভট্টাচার্যকে এনে।

জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি থেকে আযাঢ় অর্থাৎ গোটা জুন মাস ধরে এমনকি জুলাই-এর প্রথম পর্যন্ত উত্তরের মফসসল শহরগুলোতে অন্ততপক্ষে দু’দিনব্যাপী আয়োজিত হত ‘বিশ্বকবি’ ও ‘বিদ্রোহী কবি’-র যৌথ বন্দনা। দিনদশেক আগে থেকেই বাঁশ দিয়ে শুরু হত মঞ্চ বাঁধার কাজ। পাড়াজুড়ে ছিল যেন একটা সাজো-সাজো রব। গোটা এলাকার কচিকাঁচা থেকে মধ্যবয়স্ক সকলেই প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা সহযোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেন এই অনুষ্ঠানগুলোতে।

ছবি আঁকা, নাচ, গান, আবৃত্তি, প্রশ্নোত্তর, নাটক বিভিন্ন আঙ্গিকে মোড়া থাকত অনুষ্ঠানগুলো। কবিতার চাহিদায় আমাদের মতো মফসসল শহরের বইয়ের দোকানে কিংবা পাঠাগারে ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের হাতে ঠাঁই পেত সঞ্চিতা কিংবা সঞ্চয়িতা। প্রশ্নোত্তরে অংশ নিতে খোঁজ পড়ত রবীন্দ্র অথবা নজরুলের জীবনীর। নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় চলত নাটকের মহড়া। অনুষ্ঠান আঙিনা হয়ে উঠত জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে গোটা এলাকার মানুষের মিলনক্ষেত্র।

রবীন্দ্র-নজরুল চর্চার সেই অনুষ্ঠানগুলোতে সেলফির নকল হাসি ছিল না, ছিল প্রাণের খুশি, সমাজমাধ্যমের আস্ফালন ছিল না, ছিল নিখাদ সামাজিকতা। সীমিত খরচে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রাচুর্য ছিল না, কিন্তু প্রাণ ছিল।

বর্তমানে সংস্কৃতির বহমানতায় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে উত্তরের জনপদগুলো। তথাকথিত মফসসলের তকমা ঝেড়ে ক্রমবর্ধিষ্ণু শহর আজ শপিং মল-রেস্টুরেন্টে অভ্যস্ত। একসময় যেসকল ক্লাব বা সংস্থা রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যাকে আশ্রয় করে অস্তিত্বের শিকড় খুঁজত, তারা আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। রোজ সন্ধ্যায় এখন সেখানে বাহারি রোশনাই জ্বলে, অবসর সময় কাটাতে লোকসমাগম হয়। সেই সন্ধ্যায় ব্রাত্য শুধু রবীন্দ্র-নজরুল।

শহরগুলোয় এখন বছরভর কোনও না কোনও অনুষ্ঠান এখানে লেগেই রয়েছে। সাড়ম্বরে আয়োজিত সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অনুষ্ঠান সবেতেই ‘সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার’ অবাধ বিচরণ। স্বভাবতই হয়তো রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার পৃথক বন্দনায় ভাটা পড়েছে। এরই মাঝে দায়সারা মাল্যদানে সমাপ্ত হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী কিংবা নজরুলজয়ন্তী। সমাজমাধ্যমে ফলাও করে তা প্রচারও পায় সংস্থার তরফে।

আজকাল শহরের অলিতে গলিতে জন্ম নিয়েছে নাচের স্কুল, গানের স্কুল কিংবা আবৃত্তি শিক্ষাকেন্দ্র। তারাও মাল্যদান করে। ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে। তবে তা তাদের নিজস্ব বার্ষিক অনুষ্ঠানের মতো জাঁকজমকপূর্ণ নয়। এছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন বিদ্যালয় বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান করে থাকে। এই অনুষ্ঠানগুলোতে জৌলুস আছে, বৈভব আছে। সব সংস্থা, সব ক্লাব মিলে অনুষ্ঠান করলে তা অনেক বেশি প্রাণ পায়। এইসব বিচ্ছিন্ন অনুষ্ঠানের বাহুল্যে উত্তরের প্রান্তিক শহরগুলোতে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

আসলে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ঘিরে আয়োজিত কোনও অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র সংস্কৃতির চর্চাই হয় না। এর মাধ্যমে দুটি বিপরীত মেরুতে অবস্থিত জীবন দর্শনকে এবং তাদের কলমের ছোঁয়ায় ফুটে ওঠা চিন্তাভাবনাকে চেখে দেখার সুযোগ পায় শিশু-কিশোর-কিশোরীরা। যা তাদের আগামী জীবনকে মসৃণ করার পক্ষে অনেকটাই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

(লেখক দিনহাটার শিক্ষক)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *