নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
কৃষ্ণ যখন মথুরায় পৌঁছোলেন, তখন বোধকরি সন্ধ্যা নেমেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ভেদ করে বৃহৎ বৃহৎ সৌধগুলিতে আলো জ্বলে উঠেছে। রাজমার্গে বিভিন্ন বিপণিতে বিচিত্র রকমের পণ্য শোভা পাচ্ছে। রাজপথের মধ্যে হাতির দেখা পাওয়া যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। অশ্বারোহী সৈনিক নগরপাল রাজমার্গে বিচরণরত রমণী-পুরুষের ওপর নজর রাখছে, যাতে কংসের শাসনে কোনও ত্রুটি ধরা না পড়ে। পরের দিনই কংসের ধনুর্যজ্ঞ মহোৎসব। অতএব ধনুষ্ক পুরুষেরা রথচক্রের ঘর্ঘর তুলে সন্ধ্যার শান্তি ব্যাহত করছে। কারণ, কংসের রাজমহলে তাঁদের পৌঁছে যেতে হবে। পথের ধারের বিপণিগুলিতে গজদন্তনির্মিত তথা শঙ্খনির্মিত চুড়ি, মালা এবং অন্যান্য শৃঙ্গারদ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে। পুরুষ, রমণী-দুই পক্ষই সেখানে ক্রেতার ভূমিকায়। মথুরায় ‘শাটক’ নামে এক ধরনের কাপড় বা শাড়ি পাওয়া যেত, যার চাহিদা ছিল অন্যত্রও। অতি মহার্ঘ চিনাংশুক অথবা রেশমি কাপড়, যেগুলি উত্তরাপথ এবং ভরুকচ্ছ হয়ে রোমক সাম্রাজ্য পর্যন্ত রপ্তানিও হত। সেগুলিও যেহেতু মথুরার রাজাকে স্পর্শ করে যেত, অতএব মথুরায় বস্ত্রশিল্পের বিপণন হত ভালোরকম।
ভাগবত পুরাণে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণ-বলরাম প্রথমে গিয়ে অক্রূর অনুরোধে তাঁর বাসভবনে উঠলেন, তারপর তাঁর অনুমতি নিয়ে দুই ভাই মথুরা নগরী দেখতে বের হলেন। তবে হরিবংশে দেখছি, মথুরায় পৌঁছেই তাঁরা নগরদর্শনে বেরিয়েছেন। বিশেষত বাসুদেব-দেবকী কিংবা অন্য কোনও পরিজনের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাতের সংবাদ পুরাণে পাওয়া যায় না।
কৃষ্ণ-বলরাম পথে যেতে যেতে এক জায়গায় এসে থামলেন-যেখানে কাপড় রাঙানো হচ্ছে এবং বেশ কিছু কাপড় বিচিত্র রঞ্জকদ্রব্যে রঞ্জিত করে শুকিয়ে পাট-পাট করে রাখা হয়েছে। কাপড় রাঙানোর ব্যাপারটা একরকম শিল্পকর্মের অন্তর্গত ছিল মথুরায়। কাপড় রাঙানোর পারিপাট্যে বিচিত্র বসন দেখে তখনও গোপালকের সজ্জায় সজ্জিত কৃষ্ণের মন বেশ আকৃষ্ট হল। রঙ্গকার ব্যক্তিটি রজক হলেও তার ধরন-ধারণ, ব্যক্তিত্ব একটু অন্যরকম। কৃষ্ণ সেই লোকটির কাছে গিয়ে একটু আমোদিতভাবেই বললেন, ওই পাট-করা ‘শাটক’গুলি থেকে আমাদের দুটি কাপড় দাও তো ভাই। বেশ ভালো দামি কাপড় দিও কিন্তু যাতে আমাদের দুই ভাইকে বেশ মানায়। মূল্যের জন্য কোনও চিন্তা কোরো না। আমাদের কাপড় দিলে তোমার ভবিষ্যৎ ভালো হবে।
কৃষ্ণের বক্তব্য থেকে ভালো করে বোঝা যায় না যে, তিনি মূল্য দিয়েই মথুরার নাগরিক সাজ কিনতে চেয়েছিলেন, নাকি বিনামূল্যে। এতাবৎ বৃন্দাবনে যা তিনি পেয়েছেন-যশোমতীর স্নেহ থেকে রাইকিশোরীর প্রেম-সবই তিনি বিনামূল্যে পেয়েছেন। অতএব এই কাপড় চাইবার পিছনে গ্রাম্য গোপবালকের সেই স্বাভাবিক আবদারও কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু রজক মূল্য অথবা তজ্জাতীয় কোনও বণিকসুলভ বাক-নৈপুণ্যের মধ্যে গেল না। সে আসলে রাজবাড়ির পরিধেয় প্রস্তুত করার বরাত পেয়েছে। রাজগৃহের সংশ্লেষে সে নিজেকে কংসরাজার নিতান্ত কাছের লোক মনে করে। অতএব তার সাহসটাও অন্য বণিকজনের চেয়ে বেশি। সে জবাব দিল- এই তো তোমার জামাকাপড়ের হাল দেখছি, বাছা! বনে-পাহাড়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াও, এই তো তোমার উপযুক্ত বসন। তাহলে নিজের অভ্যাস ছেড়ে হঠাৎ এই রাজসজ্জা করার ইচ্ছে হল কেন বাপু!
রঙ্গকার রজক এইটুকু বলেই থামল না। রাজবাড়ি অথবা ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষের সঙ্গে যদি সামান্য সংশ্রবও থাকে, তবে সাধারণ পণ্যজীবী মানুষও কেমন দুর্মদ হয়ে ওঠে, এই রজক তার উদাহরণ। সে কৃষ্ণকে রীতিমতো কংস রাজার ভয় দেখিয়ে দুর্ব্যবহার করে তাড়াবার চেষ্টা করল। কৃষ্ণ আপাতত শত্রুপুরীতে এসেছেন। তাঁর আপন পিতা-মাতা এখানে নজরবন্দি, তাঁকেও এখানে আনা হয়েছে বধের অভিপ্রায়ে। বৃন্দাবনের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে কৃষ্ণের ছিল প্রাণের বন্ধন, পরম আত্মীয়তা। আর এখানের পরিবেশ একেবারেই অন্যরকম। হাওয়ায় প্রতি মুহূর্তেই যেন শত্রুতার গন্ধ। সামান্য রজকও এখানে কৃষ্ণকে কংস রাজার ভয় দেখাচ্ছে। সেই কবে থেকে যে ব্যক্তির হাতে তাঁর পিতা-মাতা নিগৃহীত হয়ে চলেছেন, যার ভয়ে জন্মলগ্নেই তাঁকে বিসর্জন দিয়েছেন তাঁর পিতা, সামান্য রজক যখন সেই কংসের ভয় দেখাল, তখন কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি জানেন, নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে এসে যদি জনসমক্ষে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তার জন্য চরমপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেষ্ঠ উপায়। তাতে অন্য লোক ভয়েই তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে না। অতএব রজকের কথাবার্তা শুনে কৃষ্ণ একটি মোক্ষম আঘাত করলেন তাঁর মাথায়। মল্লযুদ্ধে কৃষ্ণের এই একটি আঘাতেই রজকের মৃত্যু হল।
কংস রাজার সঙ্গে একান্ত সংশ্রব আছে এমন একটি লোক যখন রাজভয় প্রদর্শন করতে গিয়েও মারা পড়ল, তখন সেই প্রতাপশালী ঘাতক পুরুষের ওপর সম্ভ্রম এল অনেকেরই। কৃষ্ণ-বলরাম যখন হাতে দু’খানি কাপড় নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, তখন একজন ‘বায়ক’ এসে ওই মহার্ঘ কাপড় দুটি পরিয়ে দিতে চাইল। টীকাকার শ্রীধরস্বামী লিখেছেন, ‘বায়ক’ হল এক বিশেষ ধরনের তন্তুবায় অর্থাৎ তাঁতি। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে ‘বায়কের’ ক্রিয়াকর্ম দেখে যা বুঝতে পারি, তাতে এই ব্যক্তিটিকে ঠিক তন্তুবায় মনে হয় না। মনে হয় যেন এ এক ধরনের ‘বিউটিসিয়ান’। যে মানুষকে সুন্দর করে কাপড়চোপড় পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। এ তাই করেছে। কৃষ্ণ এবং বলরামকে বিচিত্র বেশে মথুরার নাগরিক সাজে সাজিয়ে দিয়েছে, পরিয়ে দিয়েছে পুরুষের যোগ্য অলংকার। সহৃদয় টীকাকার মনে করিয়ে দিয়েছেন-কংস রাজা ঠিক করে রেখেছেন-কৃষ্ণের বিরুদ্ধে তাঁর প্রধান মল্লযোদ্ধাদের উত্তেজিত করবেন। অতএব ‘বায়ক’ কৃষ্ণকে এবং বলরামকেও উত্তম এবং বিচিত্র চৈলেয় বসন এবং মল্লজনোচিত অলংকারে সাজিয়ে দিল।
বায়কের সাজসজ্জায় সেজে কৃষ্ণ-বলরাম মালাকারের ঘরে পৌঁছোলেন। মালাকারের নাম সুদামা, হরিবংশ পুরাণ মতে গুণক। মথুরা নগরে সন্ধ্যার সময় মালার চাহিদা বাড়ে এবং কৃষ্ণ বোধহয় এই মালাকারের ঠিকানা জানতেন আগে থেকেই। হয়তো মালাকার সুদামাও জানত যে, কৃষ্ণ আসবেন তাঁর ঘরে। অতএব কৃষ্ণ আসতেই সুদামা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলেন কৃষ্ণকে। বসার আসন, পা ধোয়ার জল সব একে একে এগিয়ে দিলেন সুদামা। সুদামা এমনভাবেই কথা বললেন, যে কথার মধ্যে কৃষ্ণের ভগবত্তার সমস্ত তত্ত্বই মেশানো আছে। পরম ঈশ্বরত্বের মহিমা যতখানি থাকে ঠিক ততখানি মহিমা প্রকট করলেই মালাকার সুদামা কৃষ্ণ-বলরামকে স্বাগত জানালেন। মালাকার সুদামা সুন্দর সুন্দর কতগুলি মালা উপহার দিলেন কৃষ্ণ-বলরামকে। মাথায়, গলায়, হাতে বিচিত্র পুষ্পের আভরণ পরে দুই ভাই আবারও মথুরার রাজমার্গে চলতে আরম্ভ করলেন।
মালাকারের দোকান থেকে বেরিয়ে আবার পথ চলতে চলতে কৃষ্ণের সঙ্গে একটি রমণীর দেখা হল। ভারী সুন্দর তার মুখখানি, শরীরে যৌবনের চিহ্নও অতি প্রকট। অথচ তার শরীরটি ঈষৎ বাঁকা। সে নারীর আসল নামটি কোনও পুরাণই আমাদের জানায়নি। পুরাণে দেখা যাচ্ছে, শরীরের এই বক্রতার কারণে লোকে তাকে কুব্জা বলে, কেউবা বলে ত্রিবক্রা, কিংবা অনেকবক্রা। কৃষ্ণ যখন তাকে পথে দেখলেন, তখন তার হাতে নানা অনুলেপন, অঙ্গরাগ, সুগন্ধি থালায় সাজিয়ে নিয়ে চলেছে একটু ব্যস্তভাবে। কুব্জ দেহ নিয়ে দ্রুত পথ চললে পথ চলার মধ্যেও একটা কুটিলতা দেখা দেয়- কুব্জা বিদ্যুৎকুটিল গামিনী। কুব্জাকে দেখে একেবারে নাগরিক সরস সম্ভাষণে কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন-তুমি কে? কার জন্য এই সুগন্ধের বাহার সাজিয়ে চলেছ?
এত যে মধুর মধুর সুগন্ধ নিয়ে যাচ্ছ, তা আমাদের একটু-আধটু দিয়ে যাও। আমরাও একটু মাখি। একটু দিলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। বরং তোমার ভালোই হবে। এমন মধুরতায় এখনও পর্যন্ত কোনও যুবা পুরুষ কথা বলেনি কুব্জার সঙ্গে, হয়তো কুব্জা বলেই। কিন্তু কৃষ্ণ বলেছেন এবং ভাগবত পুরাণ বলেছে, তিনি সানন্দ সরসতায় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন।
কুব্জা বলল, সুন্দর আমার। আমি দাসী। আমি এই অনুলেপন-অঙ্গরাগ কর্মে অতি নিপুণ বলে কংস খুব খাতির করেন আমাকে। আর দেখছই তো আমার চেহারার কী অবস্থা! লোকে আমাকে ত্রিবক্রা বলে ডাকে।
কৃষ্ণের রূপ-মাধুর্য, তাঁর রসিকতাবোধ এবং তাঁর সহাস্য আলাপ দৃষ্টিপাতে ত্রিবক্রা কুব্জা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি দুজনেরই হাতে তুলে দিলেন সান্দ্র চন্দনাগুরু-কুঙ্কুমের অঙ্গরাগ। কুব্জার দেওয়া অঙ্গরাগে কৃষ্ণ-বলরাম দুজনেই খুব সুন্দর করে সাজলেন। যতরকম হলুদ বর্ণের অঙ্গরাগ ছিল, সেগুলো নিজের গায়ে-মুখে চিত্রিত করলেন কৃষ্ণ। আর বরলাম গ্রহণ করলেন কৃষ্ণবর্ণের অঙ্গরাগ। গাত্রবর্ণের সঙ্গে চরম বৈপরীত্যে সেই অনুরঞ্জন কৃষ্ণ-বলরামকে উন্মুক্ত রাজপথের মধ্যে পরম দর্শনীয় এবং চোখে পড়ার মতো করে তুলল। কুব্জা কৃষ্ণের বাক্যে আপ্যায়িত হতে যেভাবে কংস রাজার জন্য কল্পিত প্রসাধন তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তাতে কৃষ্ণ বড় খুশি হলেন। তিনি ঠিক করলেন, তাঁর সঙ্গে এই যে কুব্জার দেখা হল এবং কুব্জা তাঁকে আপ্যায়িত করলেন, তার কিছু প্রতিদান তিনি দেবেন। তিনি কুব্জার ত্রিবক্র শরীরটি সমান করে দেবেন।
পুরাণে বর্ণিত হয়েছে, কৃষ্ণ হঠাৎই নিজের পা দুটি দিয়ে কুব্জার দুই পায়ের অগ্রভাগ চেপে ধরলেন এবং হাত দিয়ে তাঁর চিবুকটি ধরে তাঁর বক্র দেহটিকে উপরের দিকে টেনে তুললেন। কৃষ্ণের ভগবত্তার ফলে কুব্জা কয়েক মুহূর্তেই অসামান্য সুন্দরী রমণীতে পরিণত হলেন। তাঁর দেহের বক্রতা দূর হল, ঋজু দেহে রমণীর উচ্চাবচ শরীর সংস্থানগুলি যথোচিতভাবে প্রকট হয়ে উঠল।
কৃষ্ণ কিন্তু সহজে ছাড়া পেলেন না। কৃষ্ণের স্পর্শে স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফিরে পেয়ে কুব্জা অতীব আনন্দিত হলেন। আর যে পুরুষটি তাঁর রূপযৌবনকে তার সমস্ত বিরূপতা ঘুচিয়ে সিদ্ধি প্রদান করলেন, তার প্রতি জাগল তাঁর কামনা। কৃষ্ণের উত্তরীয় প্রান্ত ধরে আত্মনিবেদনের লাস্যময়ী হাসি হেসে, নির্লজ্জভাবেই কৃষ্ণের সঙ্গ কামনা করলেন কুব্জা।
কুব্জা প্রসঙ্গ মিটে যাবার পর কৃষ্ণ তাঁর মথুরায় আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্যসাধনে মনোনিবেশ করলেন।