তবু প্রেম সগর্বে বেঁচে ভারত-পাক আকাশে

তবু প্রেম সগর্বে বেঁচে ভারত-পাক আকাশে

শিক্ষা
Spread the love


রূপায়ণ ভট্টাচার্য

যুদ্ধ বা যুদ্ধ যুদ্ধ হাওয়া সব সময়ই খারাপ। আচমকা নয়া সব যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ভরে উঠেছে পাড়ায় পাড়ায়। তবু এই মুহূর্তই মানবতাবাদের বহু দৃষ্টিনন্দন চরাচর মনে করিয়ে দিয়ে যায় আবার। দেখায়, রক্তারক্তির আবহেও ভালোবাসার রক্তগোলাপের কত সুবাস ছড়িয়ে ভারত-পাকিস্তানের হৃদকমলে।

দেশপ্রেমকে ঘিরে অহেতুক হিংসা-হুংকারকে নিঃশব্দে হারায় সেই অন্তহীন প্রেম।

ওয়াঘা সীমান্তে ক’দিন আগের কিছু অন্যরকম ছবি আর্দ্র করে দিচ্ছিল দু’চোখ। আমাদের চিরায়ত ধারণার শিকড়ে কুঠারাঘাত চালিয়ে।

কী বলে যায় ওই ছবিগুলো? ভালোবাসার, ভালোবাসবার কোনও দিনক্ষণ নেই। একটা ছবিই একটা গল্প। কোনটা বেশি হৃদয়বিদারক আমি জানি না। প্রেম তো কাঁটাতার মানে না, যুদ্ধ মানে না!

অটোরিকশার ভিতরে বাচ্চারা পাগলপারা কাঁদছে এদিকে। অদূরে মায়ের চোখভরা জল। বাচ্চারা পাক নাগরিক। মা ভারতের। ভারত বলেছে, পাকিস্তানিরা ফিরে যান। পাকিস্তান বলেছে, ভারতীয়দের থাকা চলবে না। তাই এমন হৃদয় ভাসানো পরিস্থিতি।

তরুণী সায়রা নয় মাসের ছেলে আজলানকে নিয়ে পাকিস্তানে ফিরছেন প্রবল অনিচ্ছেতে। পাশে স্বামী ফারহান। নয়াদিল্লির ফারহান স্ত্রী-সন্তানকে ফেরাতে এসেছেন অমৃতসর সীমান্তে। ছেলের কপালে বিদায়িচুম্বন আঁকলেন তিনি। স্ত্রী চলে যাচ্ছে ছেলে কোলে। এই সময়ই সীমান্তরক্ষীরা বোরখাপরা সায়রাকে আটকালেন, ‘ম্যাডাম, বাচ্চার পাসপোর্টটা?’

বাচ্চার পাসপোর্ট নীল। মায়ের পাসপোর্ট সবুজ। কোথাও কোথাও একটা রংই জীবনের সংজ্ঞা ঠিক করে দেয়।
মূহূর্তে সেই নয় মাসের শিশুর ঠিকানা গেল বদলে, পলকে পালটে গেল বাবা-মায়ের জীবন, অভিব্যক্তি। ভেঙে পড়ছে মা, অসহায় বাবা। করাচি-দিল্লির মেলবন্ধন করেছিল ফেসবুক প্রেম। তারপর বিয়ে। এবার আবার বিচ্ছিন্ন। এখানেই প্রশ্ন একটা। নিয়ম নিয়মই, মানতেই হবে। তবে মানবিকতা তো নিয়মেরও ঊর্ধ্বে। এমন শিশুদের জন্য, অসহায় প্রবীণদের জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারে না? দু’দেশেই নাগরিকত্ব পেতে যে বহু জটিলতা!

বছর আটচল্লিশের হালিমা বেগম করাচি ছাড়েন ২৫ বছর আগে। ওডিশার ভদ্রলোককে ভালোবেসে বিয়ে করে। এখন দুই ছেলে তরুণ। হালিমা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাননি বলে ফিরতে হল পাকিস্তানে। মহিলা সীমান্ত ছাড়ার সময়ও জানতেন না, কোথায় থাকবেন ওপারে। বাবা-মা প্রয়াত, ভাই ছয় সন্তানকে নিয়ে থাকছেন বাড়ির দুটো ঘরে। জায়গা নেই। আজ তাঁর খবর কে রাখে?

দেখে মনে পড়ে জীবনের শেষ প্রান্তে বাঙালি দার্শনিক, সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের উপলব্ধি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে তখনই তিক্ততার ঘুণ ধরব ধরব। অন্নদাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘দুই বাংলার সম্পর্কের তিক্ততা মোছাতে পারে দুটো জিনিস। দু’দেশের ছেলেমেয়েদের বিয়ে যত বেশি হবে। দু’দেশের লোকেরা সীমান্ত পেরিয়ে যদি হোটেলের বদলে পরিচিতদের বাড়িতে থাকে।’ বাস্তব বলছে, সেটা এখন আর বোধহয় সম্ভব নয়!

কাশ্মীরের সিআরপিএফ জওয়ান মুনির আমেদের সাম্প্রতিক গল্প বহুচর্চিত। ফেসবুকে আলাপ ও প্রেমের পর ভিডিও কলে বিয়ে করেছিলেন পাক তরুণী মেনাল খানকে। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে এসে মেনাল ফেরেননি আর। সাসপেন্ড হন মুনির। তাঁর হয়ে জনতা ব্যাপকহারে প্রতিবাদী কথা বলছে বলেও খবর নেই। মুনির আমেরিকা বা ইউরোপের কাউকে বিয়ে করলে কি এত হেনস্তার শিকার হতেন? আমরা হেনা, বীর-জারা, গদর : এক প্রেম কথা, রিফিউজি, পরম্পরার মতো ভারত-পাক প্রেমকাহিনীর সিনেমা হাউসফুল করেছি হল ভরিয়ে। বজরঙ্গী ভাইজান বা পিকের মতো ভারত-পাক বন্ধুত্বের ইঙ্গিতবাহী ছবিও সুপারহিট। আজ বোধহয় সলমন বা আমিরের পক্ষেও ওরকম ছবি হিট করানো কঠিন। শুটিংয়ের অনুমতিই মিলবে না। বরং এলওসি কার্গিল বা উরি : দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক জাতীয় ছবিই হবে দেশপ্রেমকে ঘিরে।

ভাবতে ভাবতে পুনরাবিষ্কার করি, প্রচুর পাকিস্তানি ক্রিকেটার ভারতীয় তরুণীর দিল জিতেছেন। শোয়েব মালিক-সানিয়া মির্জা সেরা উদাহরণ। রীনা রায়-মহসীন খান, জাহির আব্বাস-রীতা লুথরা, হাসান আলি-সামিয়া আর্জু। কিছু প্রেম ভেঙে গিয়েছে, কিছু অটুট।

সাধারণ মানুষের প্রেমের কী হবে? পাক তরুণী জাভেরিয়া খানুম পাঁচ বছর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রেম করেছেন কলকাতার সমীর খানের সঙ্গে। ভিসা নিয়ে এখানে এসে বিয়ে। সীমা হায়দার নেপাল হয়ে পালিয়ে আসেন নয়ডায়, প্রেমিক শচীন মীনাকে বিয়ে করতে। ভারতের অঞ্জু এভাবেই পালান পাকিস্তানে নাসরুল্লাকে বিয়ে করতে। পাকিস্তানি হুডা ভালোবেসেছিলেন ভারতীয় জৈন সম্প্রদায়ের মনীতকে। চার বছরের প্রেম। মনীতকে বাবা-মা বলেন, মুসলিম বিয়ে করলে বাড়ি ছাড়তে হবে। বাড়িই ছাড়েন মনীত। পরে সব দেখে দু’পক্ষের বাবা-মা মেনে নেন সম্পর্ক। এঁরা একদিকে ভাগ্যবান, সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য পাচ্ছেন। যোগাযোগ থাকছে প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে। অনেকে তৃতীয় দেশে ঘর বাঁধছেন কষ্ট করে। এর মাঝে রাজনীতির তিক্ততা কত প্রেম মুছে দিয়েছে, তা হিসেবহীন। করাচি-মুম্বইয়ের সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।

পাকিস্তানের হায়দরাবাদের বছর উনিশের ছাত্রী ইকরা জিভানি আর বেঙ্গালুরুর মুলায়ম সিং যাদবের সাম্প্রতিক প্রেমকাহিনী যেমন। অনলাইনে লুডো খেলতে খেলতে আলাপ। প্রেম। নিজের গয়না বিক্রি করে, বন্ধুদের কাছে টাকা ধার নিয়ে ইকরা যান নেপালে। কাঠমান্ডুতে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা, সেখানেই বিয়ে। মুলায়ম স্ত্রীর জন্য নকল আধার কার্ড ও পাসপোর্ট বানিয়ে নেন। ইকরার নাম হয় রিয়া যাদব।

বেঙ্গালুরুতে ফিরে সংসার করছিলেন শান্তিতেই। প্রতিবেশীরা কেউ বুঝতেও পারেননি রিয়া পাকিস্তানি। সব গোলমাল করে আসলে হোয়াটসঅ্যাপ কল। সে সময় বেঙ্গালুরুতে জি টোয়েন্টি শীর্ষ বৈঠক, এয়ার শো চলছে। পুলিশ আন্তর্জাতিক কল পরীক্ষা করতে করতে দেখে এক রহস্যজনক কল প্রতিদিন যাচ্ছে পাকিস্তানে।

ইকরা ওরফে রিয়া তখন বাড়ি থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কলে কথা বলত মা-আত্মীয়দের সঙ্গে। পুলিশ তাকে তুলে আনে। মুলায়ম গ্রেপ্তার হয়ে যায় জাল পাসপোর্ট বানানোয়। রিয়াকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তান। উত্তরপ্রদেশের গ্রামে রিয়ার শাশুড়ি এখনও ছেলের বৌয়ের অপেক্ষায়। পাক হায়দরাবাদে ইকরার বাবাকে সাংবাদিকরা ফোন করলেই বলেন, ‘বিষয়টা ক্লোজড চ্যাপ্টার।’ মানে রিয়ার এপারে ফেরার পথ বন্ধ। বেঙ্গালুরুর অনেক পুলিশকর্তা এখন আক্ষেপ করেন, মেয়েটার তো বেআইনি অনুপ্রবেশ ছাড়া তেমন দোষ ছিল না। দেশই সবার আগে। নিয়ম হল নিয়ম। তবু আজ যখন সীমান্তের দু’পারে অজস্র মুখ বিচ্ছেদ যন্ত্রণায় কাতর, কারও সন্তান কোলছাড়া, তখন শেষ দুটো মুখ বেশি করে মনে পড়ে। অন্যদের হয়তো কয়েক যুগ পরেও দেখা হবে। ইকরা-মুলায়মের কি দেখা হবে আর? ভালোবেসে কিছুই তো তারা পেল না!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *