- মৈনাক ভট্টাচার্য
মানুষের ইলেক্টনিক্স নির্ভরতা আজ আর আগের মতো শুধুমাত্র প্রসাধনী বিনোদনে সীমাবদ্ধ নেই। ডিজিটাল কর্মসংস্কৃতির দুনিয়ায়, অফিসটাকে এখন আর নিশ্চিন্তে অফিসে ফেলে আসা যায় না। ফেউয়ের মতো অফিসতরঙ্গ পিছু নিতেই থাকে। এর সুফলও অবশ্য আছে, আমাদের সন্তান পরিজন এখন তাই চাইলেই চোখের আড়াল হতে পারে না। নেটওয়ার্কের এই তরঙ্গশৃঙ্খলকে কবজায় রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে, সব চাওয়া-পাওয়া আমাদের মুঠোয়। ‘কোথায় পালাবে তুমি?’ সব সমস্যার ডিজিটাল সমাধান এখন আমাদের চুটকিতে, এমন সত্যের সারকথা জেনে স্বার্থের তাগিদে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করলেও আলাদিন চিরাগের এই মুশকিল আসান, ডিজিটাল জিনসাহেব সবার হরিহর হৃদয়ের মাঝে আবার হৃৎকম্পেরও কারণ। নব্যপ্রযুক্তির এই নাগপাশে পকেটবন্ধু স্মার্টফোন থেকে ট্যাব কম্পিউটার যে আদপেই এক প্যান্ডোরার বাক্স, সেটা কিন্তু না বুঝেই আমরা খুলে ফেলেছি। তাই শরীর মনের ব্যক্তিগত ঘেরাটোপে আজ ডিজিটাল নির্ভরতার দখলদারি।
বিশেষজ্ঞদের নতুন ভাবনায় সচেতনতার এভারগ্রিন স্বাস্থ্যস্তব ‘অ্যান অ্যাপল এ ডে, কিপস ডক্টর অ্যাওয়ে’র বদলে এখন আমাদের স্লোগানের নতুন বাইনারি তাই ‘সুস্থ মনের জন্য চাই কিছুটা সময় ডিজিটাল ডিটক্স’।
আমরা এখন জেনে গিয়েছি সামাজিক এবং পেশাদার নেটওয়ার্কের সঙ্গে সামান্য সময় না থাকতে পারলেই পিছিয়ে যাব। এই ‘ফোমো’ বা ফিয়ার অফ মিসিং আউটের এই হারিয়ে যাওয়ার ভয় থেকেই কিন্তু জড়িয়ে যাচ্ছি হীনম্মন্যতা এবং উদ্বেগের এক প্যাথলজিকাল ইন্টারনেট জালে। মানুষের ব্যক্তিত্বে বাসা বাঁধছে এক রকম হীনম্মন্যতা এবং উদ্বেগ। এর প্রভাবে নানাভাবে বারেবারে সচেতনতার পরও আমরা অভ্যস্ত হতে পারছি না প্রকাশ্য মেলামেশায়। তার বদলে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি ক্রমশ ব্যান্ডওয়াগনের সঙ্গে চলায়। শেষপর্যন্ত সেই ভার্চুয়াল আঙ্গিকেই থেকে যাচ্ছে এই সব মেলামেশা। মুখোমুখি মেলামেশার অভাবে আমাদের সুখ-দুঃখ দুটোই বোঝার মতো চেপে বসছে মনের ভেতর। মনোবিদদের দাবি, সমাজমাধ্যমের এই নেশা থেকে তৈরি হচ্ছে নানা রকম ‘আচরণগত আসক্তি’।
বোঝার উপর শাকের আঁটির কম্পিউটার স্কিন এবং স্মার্টফোনে খুব বেশি সময় চোখ রাখায় বরাহুত হয়ে আমাদের চোখে বাসা বাঁধছে ‘ড্রাই আইজ’-এর সমস্যা। চোখ পর্যাপ্ত পরিমাণে অশ্রু তৈরি করতে না পারায় চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ জ্বালা করা এবং চোখের ক্লান্তিতে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া এখন নিত্য ঘটনা।
মেঘের ভেতর রুপালি আস্তরণের মতো সমাজের এখন তাই নতুন দাওয়াই, দিনের বেশ কিছুটা সময় অন্তত বাধ্যতামূলক ‘ডিজিটাল ডিটক্স’, অর্থাৎ নিজেকে ডিজিটাল ডিভাইস থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সাময়িক বিরতি দিতে হবে। মাঝে মাঝে বোতলবন্দি করতে হবে এই ডিজিটাল জিনকে। উৎসাহিত করতে হবে সব রকম অফলাইন কার্যকলাপকে। জীবনের ব্যস্ততাকে উপভোগ করতে, দিনের কিছুটা সময় আবার আমাদের পূর্বজদের মতো সেই পুরোনো অভ্যাসের ঢঙে খোলা হাওয়ায় বসে বইয়ের পৃষ্ঠায় কিংবা খবরের কাগজের পাতায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে মন পাবনের নাওয়ে ভেসে থাকতে পারলেই আমরা অনেকটা বেঁচে থাকতে পারব প্রাণবন্ত জীবনের ভেতর। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এই বোধ শুধু মননে রাখলেই চলবে না, ছড়িয়ে দেওয়াটাও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা।
(লেখক শিলিগুড়ির ভাস্কর এবং অক্ষরকর্মী)