- মাধবী দাস
দাড়িয়াবান্ধ্যা-বৌবসন্তবিকেলে হঠাৎ করেই খেলার মাঠের এককোণে পলাশ গাছটার সবুজ পাতার আড়ালে কৃষ্ণবর্ণের থোকা থোকা কুঁড়ি আর কুল গাছে ফুল এসে উঁকি দিতেই মাঠের ধুলো ঝেড়ে জটলা শুরু হত- সরস্বতীপুজো এসে গিয়েছে। ‘সরস্বতী’ বানান জিজ্ঞেস করলে দুধের দঁাত যেন ভেঙে না পড়ে, সেই প্রস্তুতি নিয়ে হলুদ রঙের রসিদ ছাপিয়ে ছেলেরা বেরিয়ে পড়ত বাড়ি বাড়ি। আমরা ধনী-গরিব নির্বিশেষে পাটের দড়ি দিয়ে রাস্তা আটকে নারকেল তেলের কৌটো কেটে দঁাড়িয়ে থাকতাম খুচরো পয়সার জন্য।
সাদা কাগজে আলতা রঙে লিখে প্রতিবার পুজোর নির্ধারিত স্থানে ঝুলিয়ে দেওয়া হত- এবারের বিশেষ আকর্ষণ, ‘মশুর ডাল কিংবা ছোলার ডালের, তুলোর কিংবা কাচের প্রতিমা।’ নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দুধভাতব্যস্ততায় আগের বছরের প্রতিমার শরীরে নিখুঁতভাবে আঠা দিয়ে লাগানো হত ডাল, তুলো, কাচ কিংবা চুমকি। সঙ্গে থাকত টুনি লাইটের বাহাদুরি। নিজেদের আয়োজনের দাম্ভিকতায় সবাই তখন ‘ছাপান্ন ইঞ্চি’। বাজার করা, ফল কাটা, মণ্ডপসজ্জা, পুরোহিত ধরে আনার মতো ফুলচুরিটাও ছিল পুজোর অঙ্গ। কেউ চঁাদা দিতে অস্বীকার করলে তাদের ফুল, বাগান সমেত তুলে আনার দায়িত্ব থাকত একটু হাট্টাগোট্টাদের ওপর। অনেকে এসব উপদ্রবের কথা মাথায় রেখে ‘ফুলগাছ কারেন্ট করে রাখা আছে’ বলে ভয় দেখিয়ে ঘুেমাতে যেতেন। পাকা বাঁশের ডালে ছুরি দিয়ে সেসব ফুল তোলা হত। এসবে কোনওদিন অপরাধবোধ কাজ করেনি। নির্মল আনন্দ ছিল কেবল।
চাপা গাছে ব্রহ্মদত্যি রয়েছে কিনা, তা নিজে চোখে না দেখে বিশ্বাস করেননি নরেন্দ্রনাথ। ক্লাস থ্রি’র এই পাঠের পর আমিও একবার কুলে কামড় দিয়ে ভূগোলে একশোতে একুশ পেয়ে কুল তো দূরের কথা জিভের জলটুকুও গেলার সাহস পাইনি। বড়দের কথাগুলো যুক্তিতর্ক দিয়ে বিচার করা আমাদের শৈশব জানত না। বিশ্বাস ছিল, সবটুকু আমাদের হিতার্থে। পুজোর সকাল মানে গায়ে হলুদ আর টিউবওয়েলর ধোঁয়া ওঠা জলে স্নান। পাড়ার প্যান্ডালে অঞ্জলি দিতে গিয়ে পরখ করে নেওয়া, কার মুখ কতটা হলুদ। পঠনমুক্ত দু’দিনের জীবনে অপেক্ষাকৃত কঠিন বিষয়গুলো দেবীর পায়ের কাছে রেখে দেওয়া হত।
পঞ্চমী ছেড়ে গেলে খাগের কলম, দোয়াতে ডুবিয়ে বেলপাতায় ‘ওম সরস্বতই নমঃ’ লিখে সেসব বইয়ের পাতায় রেখে দিয়ে ভালো রেজাল্টের সব দায়িত্ব অর্পণ করতাম দেবীর ওপর। এভাবেই জাতিধর্মনির্বিশেষে বিদ্যা আর বাগদেবী সমার্থক হয়ে, পুজো হয়ে উঠত পাঞ্জাবি কিংবা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ানো আর খিচুড়ি-লাবড়ার উৎসব।
নাইন মানে স্কুলের পুজোর আমেজে একটু অন্যমাত্রা। আমন্ত্রণপত্র দিয়ে একটি বয়েজ স্কুলের বাইরে দঁাড়াতেই জানলা থেকে, ‘ওগো নারী হাওয়ায় উড়ছে তোমার শাড়ি’ এমন চিৎকার শুনে আর সহপাঠীদের মুচকি হাসিতে ঠোঁটটা দু’একবার কেঁপে উঠেছিল।
বসন্তের শিহরণে কান গরম করা দিন। আমি তখন নবম শ্রেণি, আমি তখন শাড়ি। বড় চণ্ডীদাসের বড়াইয়ের মতো শুলেখাদিদের অভাব ছিল না। আড়াআড়ি দৃষ্টিগুলো এতটা খুল্লামখুল্লা না থাকলেও শ্রী এবং পঞ্চমী- দুটো শব্দই অত্যন্ত তাৎপর্যময় হয়ে শৈশব-কৈশোরকে নারী-পুরুষে বিভাজিত করে দিত।’
জীবনের মধ্যবেলায় এসে দলে দলে ছেলেমেয়েদের একইরকম আবেগে সেজেগুজে মুক্তবিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে দেখলে ডাউন মেমরি লেনে পৌঁছে মনে হয়, সব আসলে আবহমান! স্টুডিও’র গ্রুপ ছবি সেলফিজোনে দঁাড়িয়ে, বদলে নিয়েছে শুধু মোড়কটা।
‘ফুরোয় না তার কিছুই ফুরোয় না/ নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে কিন্তু মুড়োয় না।’
The submit ‘ডাউন মেমরি লেন’ থেকে সরস্বতীপুজো appeared first on Uttarbanga Sambad.