সৌভিক চক্রবর্তী: পুজোর সময় কাতারে কাতারে মানুষ আসেন কলকাতায় ঠাকুর দেখতে। অনেকেই হয়তো এর আগে কোনওদিনই এ শহরে পা রাখেননি। তাঁদের এই ঠাকুর দেখার অভিজ্ঞতা যেন আজীবন মনে রাখার মতো সুখস্মৃতি হয়ে থাকে, তা দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। আমার মতো বাকিদের, যারা সারা বছর শহর কলকাতার যানজট সামলাই। কলম ধরলেন অফিসার ইনচার্জ হাওড়া ব্রিজ ট্রাফিক গার্ড সৌভিক চক্রবর্তী।
আমাদের ব্যস্ততা কিন্তু কেবল পুজোর সময়েই বাড়ে, তা নয়। মানুষ যখন থেকে পুজোর কেনাকাটা শুরু করেন, তখন থেকেই আমাদের তৎপর হতে হয়। প্রায়শই বাবা-মায়ের হাত ধরে পুজো শপিংয়ে আসা কোনও খুদে দলছুট হয়ে যায়। ভাবুন তো, ওই অবস্থায় কতখানি ভয় হবে তার! ওই দমবন্ধকর ভিড়ের মধ্যেও যাতে সুষ্ঠুভাবে সে তার বাড়ির লোকের কাছে ফিরতে পারে, সেদিকে নজর রাখাই ট্রাফিক পুলিশের কাজ। পুজোর চারটে দিন পেরিয়ে, ভাসান পর্যন্ত এতখানিই তৎপর থাকতে হয় আমাদের।
ছোটবেলায় পুজো ছিল একেবারে অন্যরকম। পঞ্চমীর সন্ধেবেলা বাবা নিয়ে আসত নতুন জামা। সেই জামা গায়ে দিয়ে আমার আর আমার ভাইবোনেদের ষষ্ঠীর সকাল শুরু হত। কবে নতুন জামা আসবে, কার ক’টা জামা হল, এসবই ছিল আলোচনার বিষয়। আর ছিল পুজোসংখ্যা পড়ার আনন্দ। বাবার হাত ধরে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। বিখ্যাত সব প্যান্ডেলে ঘুরতাম, এগরোল খেতাম। আমাদের ছোটবেলায় তো খুব একটা ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হত না। পুজোয় যে একটু বেশি ছাড় পেতাম, বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ঘুরতাম, সে-ই অনেক। এখন বাবা নেই, খুব মনে পড়ে ওই দিনগুলোর কথা।
আমি ১৯৯৬-এ কলকাতা পুলিশে ঢুকি। ২০১৪ থেকে অ্যাডিশনাল ওসি হিসেবে, তারপর ওসি হিসেবে ট্রাফিকে আছি। পুজোতে সবার নতুন জামা হয়, আমাদের নতুন ইউনিফর্মই পুজোর জামা। এই যে দুর্গাপুজোর কয়েকটা দিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারি না আমরা, তাতে কিন্তু কোনও আপসোস হয় না! আমি মনে করি, জনসাধারণই আমার পরিবার। সাধারণ মানুষের সঙ্গেই আমার পুজো কাটে। বিশ্বাস করুন, আমার পুজো যথেষ্ট ভালো কাটে। পুজোয় যে গুরুদায়িত্ব আমি সামলাই, তা করেই আনন্দ পাই।
কলকাতায় যারা ঠাকুর দেখতে আসেন, তাঁদের অনেকেই এখানকার ট্রাফিক সম্পর্কে একেবারে ওয়াকিবহাল থাকেন না। ফলে আনন্দ করতে এসে ঝামেলায় পড়েন। সাধারণ পথচারীর সংখ্যাও এই সময় বেড়ে যায়। ফলে যত আগে থেকেই সার্ভে করে সম্ভাব্য ভিড়ের আন্দাজ লাগাই না কেন, শেষ মুহূর্তের দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। বলতে বসলে মনে হয়, আমার ক্ষেত্রে কিন্তু পুজোর খারাপ অভিজ্ঞতা একেবারেই কম। তুলনায় ভালো অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।
গত একবারের ঘটনা বলি, এক বিখ্যাত পুজো প্যান্ডেলের সামনে ভিড় সামলাচ্ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের ভিড়ে তিলধারণের জায়গা নেই। হঠাৎ কানে এল এক বৃদ্ধার হাউহাউ কান্না। ভিড়ের মাঝে পরিবারের লোকেদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এমনিতেই আগে কখনও কলকাতায় আসেননি, তার ওপর সম্ভবত ভুলে যাওয়ার রোগও ছিল তাঁর। ফলে অনেক চেষ্টাতেও কোথায় বাড়ি তা বলে উঠতে পারছিলেন না আমাদের। আমরা আগে তাঁকে শান্ত করি, চা-জল খাওয়াই। তারপর গল্পে গল্পে বোঝার চেষ্টা করি, তাঁর বাড়ির ঠিকানা। যে এলাকার কথা তিনি বলেন, সেখানে থাকা আমার পরিচিতের মাধ্যমে খোঁজ লাগাই। বৃদ্ধার পরিবার তো কাছাকাছিই ছিল, তাঁরাও খুঁজছেন হন্যে হয়ে। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাকে সফলভাবে পৌঁছে দিই তাঁর পরিবারের কাছে।
বাড়ির লোকেদের ফিরে পেয়ে, বৃদ্ধা হঠাৎই জড়িয়ে ধরেন আমাকে। কান্না সামলে বলেন, “বাবা, তুমি অনেক আশীর্বাদ নিও। ভালো থেকো।” আমার নিজের দুই চোখও ভরে উঠেছিল জলে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কীই বা হতে পারে? মানুষ নিজের মনের মতো করে মায়ের কাছে পৌঁছে যাক, প্রাণভরে মায়ের আশীর্বাদ গ্রহণ করুক, এটুকুই লক্ষ্য আমার।