- শুভঙ্কর দাস (সুভান)
এক
আমার দোতলার ঘরের জানলাগুলো আমি কখনও খুলি না। জানলাগুলো না থাকলেও হয়তো খুব অসুবিধে হত না। একাই থাকি এই দোতলা বাড়িতে। লক্ষ্মীর মা সকালে এসে দু’বেলার রান্না করে দিয়ে যায়। সঙ্গে ঘর মোছা, বাসন মাজা আর যা যা কাজ থাকে সেগুলো করে দিয়ে যায় একেবারে। ছোট থেকে দেখছে আমাকে। আমাদের বাড়িতে বাইশ বছর ধরে কাজ করে লক্ষ্মীর মা। আগে যদিও মা নিজেই রান্না করত। লক্ষ্মীর মা, মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিত সব। লক্ষ্মীর মার নাম শীতলা। মা মারা যাওয়ার পরে আমাদের তিনজনের সংসারে প্রথম ভাঙন আসে। মায়ের চলে যাওয়া বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। দীর্ঘ ৩০ বছরের সম্পর্ক। বিয়ের আগেও পাঁচ বছর ওরা ক্লাসমেট ছিল। ভাবতেও অবাক লাগে, এত বছর আগেও ওই জামানাতে দুজন স্কুল পড়ুয়া নিজেদের মধ্যে যে কোন বাঁধনে বেঁধে গেল। তারপর কলেজ, চাকরি, বিয়ে। তারপরে শুভ দিন দেখে এই অপদার্থের আগমন ঘটেছিল।
এই বাড়িটা মা আর বাবা নিজেদের জমানো টাকায় তিল তিল করে বানিয়েছিল। বাবার পৈতৃক সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। মা কিন্তু দাদুর কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নেয়নি। কী দেখে যে বাবার প্রেমে পড়েছিল মহিলা, সেই রহস্য আমি আজও আবিষ্কার করতে পারিনি। বাবা গান গাইত ভালো। সে তো কত ছেলেই গায়। মাকে মজা করে বলতাম, চাইলে আরও ভালো ছেলে পেতে বিয়ের জন্য আর বাবা কান ধরে বলত তাই নাকি? হ্যাঁ? তাহলে এই কথাটা বলার জন্য তুই দুনিয়াতে আসতি কী করে? বাবার জন্য খুব কষ্ট হত আমার। স্ত্রী-হারানো একরকম শোকের, কিন্তু এই বয়সে ৩৫ বছরের দীর্ঘ বন্ধুতা হারানো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সম্পর্কটা তো শুধু স্বামী-স্ত্রীর নামেই জড়িয়ে ছিল না। মা আর বাবা ছিল ভীষণ ভালো বন্ধু। আমার হিংসে হত বাবার ওপর। মায়ের মতো যদি একটা প্রেমিকা পেতাম। বাবা নাকের কাছে চশমাটা নামিয়ে হেসে জবাব দিত, হ্যাঁ রে, আমারও থেকে থেকে মনে হয়, শালিনীর মতো যদি একটা প্রেমিকা পেতাম। আমার কথা বন্ধ হয়ে যেত বাবাকে এমন মশকরা করতে দেখে।
শালিনী, আমার কলেজবেলার বান্ধবী। ভীষণ প্রাণবন্ত মেয়ে। কলেজে সবাই ওর প্রেমে পড়ত আর সে কি না আমার মতো রিজার্ভ, ইন্ট্রোভার্ট ছেলের প্রেমে পড়ল শেষে। বাবা তো বলত গোল্লায় গেছে আমার মতো অপদার্থের প্রেমে পড়ে। তারপর রীতিমতো জেরা করত আমাকে বসিয়ে, বলত কিছু একটা ফন্দি করেই আমি নাকি ওর মন পেয়েছি। এই ছিল বাবার বিশ্বাস। বাবা আরও কয়েক শব্দ জুড়ে দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলত- আমার ছেলে তো এত ভালো মেয়ে পাওয়ার মতো কিছু করেনি এখনও। বামনের হাতে জ্যোৎস্না সমেত চাঁদ ধরা পড়েছে গো, শুনছ…। আমার কিন্তু বেশ রাগ হত তখন। এমনই ছিল আমার আর বাবার সম্পর্কটা। সুযোগ পেলেই দুজন দুজনের যতটা বন্ধু হয়ে উঠতাম ঠিক পরক্ষণেই জন্মের শত্রু। বাবার সঙ্গে আমার এই শত্রুপক্ষ-মিত্রপক্ষ মার্কা সম্পর্কে মা পড়ত মুশকিলে। কার দিকে যে যায়।
আমাদের বাড়িতে প্রথম থেকেই আসা-যাওয়া ছিল শালিনীর। নিজেই খুঁজে খুঁজে চলে এসেছিল হঠাৎ একদিন। আমি বাড়ি ফিরে দেখি তিনি মায়ের সঙ্গে সোফায় বসে চা-মুড়ি খেতে খেতে গল্প জুড়েছেন। ওদের দেখে মনেই হচ্ছিল না প্রথম দেখা হয়েছে। এত সহজে মিশে যেত সকলের সঙ্গে শালিনী। কিন্তু খুব মুডি ছিল ও। জোর করে ওকে কিছু করানো যেত না। রাগ ছিল নাকের ডগায়। কিন্তু জীবনে চলার পথে সবকিছুই তো আর নিজের ইচ্ছে, মর্জিমতো হয় না। কলেজ পাশ করার পরে পরেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ওর। না আমার সঙ্গে নয় অবশ্যই। হলে হয়তো গল্পটা লেখাটাই হত না। ও ছিল খুব চঞ্চল, প্রচুর ছেলে বন্ধুর মাঝে একটি মাত্র মেয়ে টাইপ, যখন-তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাস, ফেরার কোনও ঠিক নেই। আমিও ভীষণ প্রশ্রয় দিতাম ওকে। কিন্তু সেই মেয়েও বাবার অসুস্থতার কাছে নতিস্বীকার করে নিয়ে বিয়েটা করেই নেয়। কিন্তু বিয়ের বছর দুই পরেই ডিভোর্স হয়ে যায় ওর৷ শালিনী কলেজ শেষ করার পর থেকেই আমাকে বারবার বলত, ওর বাবা খুব স্ট্রিক্ট। বেশিদিন ঘরে রাখবে না। আর আমিও তো তখন বেকার ছিলাম। সেই সময়ে শালিনীর হাতটা ধরে টেনে আনতে পারিনি এই বাড়ির চৌকাঠে। খুব মনে আছে, শালিনী বিয়ের পাকা খবরটা দিতে এসেছিল যখন, মা তখন শয্যাশায়ী। বাবা রিটায়ার্ড। পেনশনে চলে সংসার। আমি মাথা নীচু করে শালিনীর কাছে দু’হাত জড়ো করে বলেছিলাম, আমাকে ক্ষমা করে দে শালিনী। আমি তোর যোগ্য নই এই মুহূর্তে৷ আমাকে আরেকটু সময় দিলে… কথাটা আর সম্পূর্ণ করতে পারিনি। শালিনীও আর একটাও কথা বলেনি সেদিন। চোখও মোছেনি। চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে শুকনো বুকের ওপর এসে পড়ছিল। চৌকাঠ থেকেই ফিরে গিয়েছিল শালিনী।
দুই
মা যে বছর অসুস্থ হয়, সে বছর বৈশাখের শেষের দিকে ওর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত শালিনী আমার সঙ্গে দেখা করেছিল গঙ্গার ঘাটে। আমার ওপর যে খুব রাগ করেছিল ও তেমনটা নয়। আমার পরিস্থিতি ও খুব ভালো করেই জানত। আমি নিরুপায় ছিলাম। সেই সময় আমার পক্ষে ওকে ঘরে নিয়ে আসার মতো অবস্থা ছিল না। শালিনী নিজেও ওর বাবার বিরুদ্ধে যায়নি। যেতে পারেনি। হয়তো বা আমার ওপর অভিমান করেই বিয়েটা করেছিল…। কিন্তু ওর বিয়ের পরেও আমাদের মধ্যে যোগাযোগ খুব স্বাভাবিক ছিল। আমার মনেই হয়েছিল বিয়েটা ওর টিকবে না। সত্যি বলতে ওর মতো মেয়ের পক্ষে বাঁধন শব্দটা একেবারে বেমামান। ওর বিয়ের পরে ভেতরে ভেতরে আমিও যে কোন হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরতাম, সে শুধু আমি জানি। আমি সরে আসার যে চেষ্টা করিনি তা নয়। শালিনী আমাকে কিছুতেই ছাড়েনি। আঁকড়ে রেখেছিল খুব। বিয়ের দুই বছরের মাথায় গিয়ে জানলাম স্বামীর পক্ষ থেকে ডিভোর্স ফাইল হয়েছে। হয়তো এটাই চেয়েছিল শালিনী। বাবার কথাও থাকল। নিজের মতো জীবনও বেছে নেওয়া গেল। আমাদের কথা হত, সব সময় কথা হত। আমার থেকে থেকেই মনে হত আমি কী ভুল করছি। নিজের ভালো লাগার জন্য শালিনীকে অতীত ভুলতে দিচ্ছি না। ও তো সত্যি ভালোবাসত আমাকে। নাচ নিয়ে স্বপ্ন ছিল কত, জেলা স্তরে অনেক পুরস্কারও জিতেছিল। কিন্তু ওর বাবা নাচ পছন্দ করত না। একই সঙ্গে দুটো স্বপ্ন ভেঙে নতুন জীবনের স্বপ্নে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া যায় না আমিও বুঝতাম। ও কখনও আমাকে ব্লেম করেনি ওর এই স্বপ্ন ভাঙার জন্য। শুধু বলত, একদিন সব ভেঙে বেরিয়ে যাব। নিজের মতো বাঁচব।
কথা বলতাম আমরা। রাতের পর রাত কথা বলতাম জীবন নিয়ে। ওর নাচ নিয়ে, আমার এলোমেলো অস্থির জীবন ও স্বপ্ন নিয়ে। আমার হীনম্মন্যতার ওপার থেকে কী করে যে ও আমাকে এতটা জড়িয়ে রেখেছিল বিয়ের পরেও। ওর স্বামী বেশিরভাগ সময়ে বাইরে থাকত ব্যবসার কাজে। আমরা দেখা করতাম। নাচের অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। সাহিত্য সভায় যেতাম। সিনেমা, ভালো খাবার কিছুই বাদ ছিল না। ঠিক যেন আগের মতো। কলেজ জীবনের মতো। মা মারা যাওয়ার পরে একমাত্র ওই আমাকে ভরসা, শক্তি দিয়েছিল। আমি বহুবার বলেছি, আমি তোর সংসারের ক্ষতি করছি শালিনী। ভুলে যা আমাকে। না, ও আজও আমাকে ভোলেনি। খুব সঙ্গে সঙ্গে থাকে। বিয়ে আর করবে না ঠিক করেছে। পাশেই একটা স্কুলে চাকরি করে। ডান্স টিচার। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা ঠিক কথাই বলত। শালিনীর মতো মেয়ে হয় না। চাইলেই তো আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারত ও। স্বামীর সঙ্গে সুখের সংসার করত। কী বোকামোটাই না করেছে ভেবে নিজের ওপর হাসি। হাসি, নিজের ওপর করুণা করেও। আমি নিজেও কি কম বোকা নই? নাহলে সাতপাঁচ না ভেবেই ওর সঙ্গে সম্পর্কে আসতাম…। যদিও ভালোবাসায় কারই বা জোর খাটে। কলেজে এত ছেলে থাকতে ওর কিন্তু আমাকেই পছন্দ হয়েছিল।
বাবার সঙ্গে খুব ভালো দোস্তি হয়ে উঠেছিল শালিনীর। মা মারা যাওয়ার পরে বাবা ধীরে ধীরে আরও বুড়িয়ে যায়। মাঝের বছর তিন, যে সময়টা আমিও বেকার, কখনও ছোটখাটো চাকরি করে চালাচ্ছি, আবার ছেড়ে দিচ্ছি। ভীষণ ডিস্টার্বড থাকতাম। বাবাকে সময় দিতে পারতাম না। বাবার একাকিত্বে ও ফোন করে গল্প করত বাবার সঙ্গে। তারপর যখন ডিভোর্স হয়ে চলে এল বাপের বাড়ি। তখন থেকে আবার প্রায় আসা-যাওয়া শুরু করে আমাদের বাড়ি। বাবার খেয়াল রাখত। শালিনীর বাবা মেয়েকে অনেক করে বুঝিয়েছিল পরে, সে চাইলে আমাকেই বিয়ে করে নিতে পারে। মেয়ের পাগলামি ও জিদের সামনে নত হতে বাধ্য হয়। ওর বাবা নিজে দাঁড়িয়ে আমাদের বিয়ে দেবে বলেছিল। শালিনী অনড়। বিয়ে ও আর করবে না। সত্যিই আর কোনওদিন আমাকে বিয়ে করার কথা বলেনি ও। একবারও না। আর আমিও বলে উঠতে পারিনি কিছুই। এইভাবে বছর তিন পেরিয়ে গেছে, বুঝতেও পারিনি। বাবা মারা যাওয়ার পরে বাড়িটা এখন খাঁখাঁ করে। এই শুনসান বাড়ির প্রত্যেকটা কামরায় মায়ের স্মৃতি লেগে আছে। বাবার গানের কণ্ঠ লেগে আছে। আমি আমার বই পড়ার ঘরে সারারাত জেগে থাকি। লেখালেখি করে চলে যাচ্ছে একরকম। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। ভালো লাগত না। শালিনী বলেছে, যা ভালো লাগে করো। একটাই তো জীবন। লেখালেখির ব্যাপারটা আগে তেমন কেউ জানত না। শুধু মা-বাবা আর শালিনী জানত। মায়ের চলে যাওয়ার পরে আমি আরও বেশি লেখার দিকে ঝুঁকে গিয়েছিলাম। তারপর শালিনীর সঙ্গে বিচ্ছেদ। বাবার শোকগ্রস্ত মুখ। আমার বেকারত্ব। সব মিলিয়ে কবিতা লেখার আদর্শ পরিবেশ পেয়ে গিয়েছিলাম হাতের মুঠোয়৷ দিনরাত লিখতাম আর পাঠিয়ে দিতাম পত্র-পত্রিকায়। তারপর ছাপাও হতে শুরু করল।
তিন
আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমার দুই প্রেমিকার নামে উৎসর্গ করেছিলাম। শালিনী আর অবশ্যই মাকে। বঙ্গ সাহিত্য পরিষদ থেকে আমাকে যুবকবি সম্মান তুলে দেওয়া হয়। মা দেখে যেতে পারেনি। বাবাও তখন একেবারেই অসুস্থ। একমাত্র শালিনী সঙ্গে ছিল। কিন্তু ও ভিড়ে, প্রকাশ্যে আমার সঙ্গে খুব বেশি থাকে না কখনও। আড়ালেই যত্নে রেখেছে আমাকে। কী যে অভিমান ওর। একবার সাহস করে বলতে চেয়েছিলাম, আমরা চাইলে তো একসঙ্গে থাকতে পারি এবার… কিন্তু ও তার আগেই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল স্পষ্ট ভাষায়, বিয়ে ও আর করবে না। সঙ্গেই তো আছে। আজীবন সঙ্গে থাকবে। বিয়েই একমাত্র সঙ্গে থাকার ছাড়পত্র? এতদিন সে সঙ্গে থাকেনি? সেটা সঙ্গে থাকা নয়? আমার মাথা গুলিয়ে যায়। আমি বেশি ভারী কথা নিতে পারি না। জটিলভাবে ভাবতে পারি না। দ্বিধাগ্রস্ত জীবন আমার৷ কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সে বিচার করতে পারি না। জীবনটা নিয়ে আশ্চর্যরকম একটা ছেলেখেলা করেছি সব সময়। বাবা সব সময় বলত পুরুষ মানুষের যেভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করবে সেভাবেই বাঁচবে। কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি যে অন্যের মতো করে অন্যরা যা করছে তাই করেই বাঁচতে হবে। নিজের কাছে ভালো থাকাটাই দিনের শেষে ঘুমের শান্তি এনে দেয়। কিন্তু আমি কিছুতেই ঘুমাতে পারি না। যতক্ষণ লিখি ভালো থাকি। যখন লিখি না পাগল পাগল লাগে৷ ঘুম না আসার থেকে বড় অসুখ পৃথিবীতে নেই।
শুধুমাত্র শালিনী আমাকে ঘুমপাড়াতে পারে। ওর কাছে কী যে ম্যাজিক আছে। মায়ের মতো গন্ধ ওর গায়ে। বুকে মাথা রাখলেই ঘুম এসে যায়। সমাজের নীতি নিয়মকে তোয়াক্কা না করেই ও আমার সঙ্গে একপ্রকার লিভ ইন সম্পর্কেই আছে। কিন্তু সব সময় ও আসে না। যেদিন আমার খুব কষ্ট হয় শুধু সেই সেই রাতগুলোতেই ও আমার কাছে আসে। শুধু শর্ত একটাই আমি কখনও ওকে বলতে পারব না আসার কথা৷ আসবে ওই। নিজের ইচ্ছেতে। আমি সে শর্ত কখনও ভাঙিনি। পাড়ায় সকলের সঙ্গেই আমাদের পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল, বাবা-মায়ের সুবাদে আমাকেও সকলেই ভালোবাসে৷ শালিনীকেও সকলে চেনে। বাড়িতে আসা-যাওয়া ছিলই ওর। এখনও যে আসে, সেকথাও সকলে জানে। কিন্তু পাড়ায় কখনও আমাদের নিয়ে কোনও কটু মন্তব্য শুনিনি। হয়তো শালিনী মেয়েটাই এমন। ওর ব্যক্তিত্বটাই এমন। পাড়ায় সবার সঙ্গেই দেখা হলে কথা বলে ও। লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করার ব্যাপার নেই৷ হয়তো পাড়ার সকলেই আমাদের সম্পর্কটা বোঝে হয়তো মায়া করে আমার ওপর, মা-বাপ মরা একা মানুষ। বিশেষ বেরোই না বাড়ি থেকে৷ কেউ কথা বলতে এলে তাহলেই বলি৷ এমন অসামাজিক মানুষের সঙ্গে পাড়ায় মানুষ একসঙ্গে আছে এতেই অবাক হই। তাছাড়া কবি মানুষ ভেবে বাড়তি সম্মান দেয় কি না জানি না তবে মানুষের একটা কৌতূহল রয়েছেই আমাকে নিয়ে।
নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপি দিয়ে এসেছি প্রকাশককে। হয়তো এই বইমেলাতেই প্রকাশিত হবে। বাড়িতে মাঝে মাঝে কিছু তরুণ কবি ও পত্রিকার সম্পাদকরা আসে। ওইটুকু সময় আমার খুব ভালো লাগে। কথা যে বলি খুব একটা তা নয়৷ কিন্তু তরুণদের লেখার মধ্যে যে তাপ রয়েছে, যে সবুজ রয়েছে তা আমাকে ভালো রাখে। বইপাড়ায় যাই যখন দু’-একজন ধরে বেঁধে নিয়ে চলে যায় তাদের বাড়ি। এই তো সেদিন, সজল সেনগুপ্ত, লিপি প্রকাশনার কর্ণধার। জোর করে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে অহেতুক বৌদিকে ব্যতিব্যস্ত করে দিল। হঠাৎ এভাবে রান্নার ঝামেলা কেউ করায়? আমি বললাম বৌদিকে। যদিও তিনি তো আরেক রসিক মানুষ। আরও এক কদম এগিয়ে বলেন শোনো ভাই, আমার তো বরাবর কবিদের প্রতি একটু দুর্বলতা আছে, নেহাত চেয়েছিলাম কবিবর, কিন্তু কে জানত লেখালেখি ছেড়ে তিনি প্রকাশক হয়ে বসবেন, কবির বদলে জুটিল ব্যবসায়ী। আমি এমনিতে কম কথাই বলি, তবু লঘু মশকরা করে বললাম- সবাই কবি হয়ে গেলে বইটা ছাপবে কে? আর প্রকাশকের বৌয়ের হাতের রান্নাই বা কজন কবি খেয়েছে শুনি৷ সজলদা হাসতে হাসতে বলেন, ওই জন্যই তো বলি- বই আর বৌ এই দুটো জিনিস আমি কখনোই হাতছাড়া করি না। নেভার। এইভাবে হাসিখুশি দিন কেটে যায় কিছু সকলের মাঝে। কেউ বই উপহার দেয়, লাইব্রেরি থেকে কিছু বই এনে পড়ি। মিথ্যে বলব না, উপার্জন খুব সীমিত। বাংলা বাজারে টুকটাক কবিতা, ফিচার, গদ্য লিখে, বেশ কিছু বইয়ের রয়্যালটি বাবদ যা পাই, তাই দিয়ে একার চলে যায়। বাবা-মায়ের বাড়িটা অবশ্য একটা সম্পত্তিই বটে। সেদিক থেকে আমার সম্পত্তির হিসেব করেই অনেকে ভেবে নিতেই পারেন যে এই দিয়েই আমি বসে বসে খাচ্ছি।
খাওয়ার কথায় মনে পড়ল, যেদিন লক্ষ্মীর মা আসতে পারে না, শালিনী এসে রান্না করে দিয়ে যায়৷ শর্তে এটাও বলা ছিল যে যেদিন শীতলাপিসি আসবে না, সেদিন আমাকে জানাতে হবে। আমি নিজে যেন রান্না করে না খাই। আমি শুধু লিখব, কবির আঙুল আগুনে পুড়ুক সে চায় না। আমিও মনে মনে হাসি ওর এই কথা শুনে। বলি- কবির আঙুল পুড়লে ক্ষতি নেই, বুকটা যে পুড়ে খাক হয়ে যায় প্রত্যেকটা দিন তার বেলা? ওমনি আমার পাঞ্জাবির কলারটা টেনে ধরে ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এনে বলে ও, আমি আছি তো… আগুন নিভানোর জন্য কবি। এমন কথার পরে কবিতা মাথায় ওঠে আমার৷ ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিয়ে বলি- তো নিভাস না কেন? কেন জ্বালিয়ে রেখেছিস আমার বুকের ভিতর এই অসহ্য আগুনটাকে। শুধু নিভাবি বলিস, নিভাস না। শালিনী কানের কাছে ঠোঁট এনে বলে- নিভাব তো, আগে আগুনের শিখাটা উঁচু হোক আরও। তারপর হয় একসঙ্গে জ্বলেপুড়ে মরব নয়তো একদিন নিভিয়ে দেব নিজেদেরই।
চার
সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দোতলার ঘরের সামনের দেওয়ালে বিরাট মাপের জীবনানন্দের ছবি ঝোলানো আছে। কলেজ লাইফেই মানুষটার কবিতা পড়ে একপ্রকার হিপনোটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম। কী লেখা! কী শব্দের প্রয়োগ। চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা… শালিনীকে খুব শোনাতাম লাইনটা। বইমেলায় গিয়ে কবিতা নিয়ে সেই হুল্লোড়ের দিনগুলো কিছুতেই ভোলার নয়। নেশা করে বন্ধুদের সঙ্গে চূড়ান্ত বাওয়ালি করতাম বইমেলায় লিটিল ম্যাগাজিন চত্বরে। আড়ালে গাঁজাও টেনেছি বহুবার। সেই গাঁজার ধোঁয়ায় চিন্তাভাবনা সব পাকিয়ে উঠত মাথার ভিতর। কী একটা যেন বোধ কাজ করে উঠত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইমেলায় কেটে যেত। বন্ধুদের মধ্যে আমি একাই ছিলাম জীবনানন্দের পাগল ফ্যান। লোকটার লেখার মধ্যে এত ক্রাইসিস বুনে রেখেছিল, অথচ ওপরে ওপরে কী সহজ কথাই না বলে গেছে জীবনের।
সেবার বইমেলা থেকেই একটা বড় ক্যানভাস কাপড়ে আঁকা ছবি কিনে এনেছিলাম। তখন থেকেই ওটা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সামনের দেওয়ালে অক্ষতভাবে ঝুলে রয়েছে। বাবা ইয়ার্কি করে বলেছিল, আমরা বাপু ঘরে রবি ঠাকুরের ছবি টাঙাতে দেখেছি মানুষকে, কিন্তু বুঝতে পারছি আমাদের যুগ ফুরাইল। এখন মানুষ ঘরে জীবনানন্দ ঠাকুরের ছবি লাগায়। আমি বাবাকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম- বাবা, জীবনানন্দ দাশ, ঠাকুর নয়। বাবা হেসেছিল আমার কথায়, তারপর ছবিটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল- ঠাকুর হোক আর দাশ, যাকে একবার কবিতায় পায়, তার কাছে রবি ঠাকুরও যা, জীবনানন্দও তাই। দেখিস বাবা, গুরুদের পথে হাঁটা শুরু করে দিস না আবার। একটু এই বুড়ো বাপটার কথাও মনে রাখিস। আমি ভাবতাম বাবা স্বভাবমতোই ইয়ার্কি করছে। আমি সেদিন বুঝিনি বাবার কথা৷ কিন্তু পরে বুঝেছিলাম বাবা কী বলতে চেয়েছিল। কবিতা একবার যাকে পেয়ে বসে আর তার মুক্তির পথ নেই। শুধুই অক্ষরের জালে জড়িয়ে যাওয়া। ছবির মানুষটাকে দেখলেই আমি কেমন সাহস পাই মনে। ভয়ও পাই। ভয়টা এক অনন্ত শূন্যের। শূন্য থেকে শুরু করার মতো সাহস যেমন ফিরে পাই। তেমন সব হারিয়ে শূন্য হয়ে যাওয়ার ভয়টাও তাড়া করে বেড়ায় সারাক্ষণ। এই কথাগুলো আমি কাউকেই বলতে পারি না। এমনকি শালিনীকেও না।
একটা প্রবল ব্যাধি আমার মধ্যে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে লোকটা, আমি টের পাচ্ছি। এ কেমন ব্যাধি, ক্রমশ পায়ের তলায় মাটির বদলে ঝুরো বালি এসে জড়ো হচ্ছে। এ ইচ্ছে বেঁচে থাকার ইচ্ছে নাকি মরে যাওয়ার বাসনা তা বুঝতে পারি না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারি, একটা উন্মাদ মানুষ আমাকে তার সঙ্গে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আজও টেনে টেনে নিয়ে যায় কোন অতল অন্ধকারের নেশায়। কেমন বিস্ফারিত চোখ নিয়ে কবিতা লিখে গেছে যে মানুষ, অথচ কোথাও টেকেনি। বিন্দুমাত্র স্থির হতে পারেনি। মাটি নয় ঝুরো বালির মতো জীবন কিন্তু আজ কবিতার প্রত্যেক প্রান্তরে লেগে আছে। কে মোছে তাকে? কার হিম্মত। এখনের সাহিত্যের মতো তো নয় যে ফেসবুকে দলগতভাবে উপেক্ষা করে, রিপোর্ট করে আটকে দেবে, নীরব থাকতে থাকতে যে কবিকে বুকে পাথর মেরে মেরে অকেজো করে দেবে। এসব এই জমানার কবিদের সঙ্গেই সম্ভব। এক মুহূর্ত থেমে থাকেনি যে মানুষ, সে অমন বোকার মতো ট্রামের সামনে থমকে গেল কেন? জীবনটা বড় আশ্চর্য একটা ব্যাপার মি. জীবনানন্দ, এমন নামের সঙ্গে পরিহাস বাংলা সাহিত্যে আর কোনও কবির জীবনে ঘটেছে কি না জানি না।
আমি আজকাল মানুষটার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না। যত গোপন দরজাগুলো খুলে যাচ্ছে, ততই ঘর ফাঁকা হয়ে উঠছে। ততই অরণ্য গজিয়ে উঠছে দেওয়ালের চারধারে। সবসময় মনের মধ্যে কয়েকটা শিয়াল আমাকে আড়াল থেকে দেখছে। সেই সব শিয়ালরা রাতের স্বপ্নে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এ কেমন পাগলের প্রলোভন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। এই ইঙ্গিত আমি কিছুতেই ধরতে পারছি না। আমাকে ঘুমোতে দেয় না এরা। আমার ভাবনার ভিতর ক্রমশ মৃতপাখির ডানা বিস্তার আমি লক্ষ করছি। আমিও অবিচল তাকিয়ে থাকি ভোরের অস্ফুট আলোর দিকে। কিছুতেই নদীর জলে প্রতিবিম্বে নিজের মুখ দেখি না। দেখি, ব্যস্ত শহরের ভিতর দিয়ে আমি ছুটে বেড়াচ্ছি, সাদা কাগজ উড়ে চলে যাচ্ছে পাক খেতে খেতে। আমি কিছুতেই মুঠোয় ধরতে পারছি না। দেখি, বাংলা বাজারের সমস্ত কবি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কেউ কথা বলছে না। কবিরা নিমেষে শিয়াল হয়ে উঠছে, শিয়ালগুলো কবি। শুধু এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। আর আমি পিছিয়ে যাচ্ছি৷ আমি পিছিয়ে আসতে আসতে একটা অদৃশ্য দেওয়ালে গিয়ে ঠেকছি। ঝোপজঙ্গল আর বিষাক্ত সরীসৃপের জীবন আমার। আমচকাই আমি ছিটকে গিয়ে পড়ছি শহর কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তায় আর বেল বাজাতে বাজাতে আমার বুকের ওপর দিয়ে সব সময় একটা ট্রাম চলে যাচ্ছে… আমি আটকাতে পারছি না।
পাঁচ
কালো রং কিনে এনেছিলাম। কী যে হল হঠাৎ। যে মানুষের কবিতায় আমি নেশামগ্ন হয়ে থাকতাম আজকাল তাকে আমি সহ্যই করতে পারি না। আমার তীব্র রাগ হয় ওমন চোখের দিকে তাকালে। এমন হয়, তীব্র ভালোবাসার মানুষের প্রতি একসময় তুচ্ছ কারণেও রাগ হয়। মারাত্মক একটা তিরিক্ষি মেজাজ কাজ করে। ঘরে এসেই আমি সবার আগে ওই অবাক করা একটা মুখাবয়ব দেখে বইপড়ার ঘরে ঢুকি, এত আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসে ওর মুখ থেকে। আমি আলো পছন্দ করি না। দোতলার ঘরে, মানে আমার বইঘরের জানলা আমি কখনও খুলি না তাই। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে ওই জানলা দুটো ওইভাবেই বন্ধ করা। জানলা দুটো হঠাৎ করে খুলে দিলে কেউ আমি যেন তীব্র আলোয় অন্ধ হয়ে যাব। মায়ের হাতে নকশা করা কাঁথাস্টিচের একটা আর্টপিস দেওয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখেছি। ওটা দেখলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে৷ আমার সারাবাড়িতে কোনও দেওয়ালে বা কোথাও আমি মা আর বাবার ছবি টাঙিয়ে রাখিনি। ছবি টাঙানো হয় মৃত মানুষের স্মৃতিতে। কিন্তু আমার মা আর বাপি এই পুরো বাড়িজুড়ে ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে আছে। শুধু জানি না কেন, এত জীবনবোধের পরেও কিছুদিন হল আমার খুব মরতে ইচ্ছে করে, আমার চেতনায় মিশে যাচ্ছে অজস্র শব্দ, লাইন, এমনকি চুপ করে থাকা। গ্রামবাংলার ব্যর্থ মাটি। ঘরের মধ্যে আচমকা ধানখেত ঢুকে পড়ে। ধানসিড়ি নদীর জল এসে পা ছুঁয়ে যায়। আমি কিছুতেই এই দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।
শালিনীকে বলেছি সব। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ও বলেছে আজ রাতে আসব। ঘুম পাড়িয়ে দেব। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাস। ঘুমোচ্ছিস না ঠিকমতো বুঝেছি। কী এত ভাবিস বল তো? আমার কাছ থেকে কিছু আড়াল করছিস? শুধু লিখলেই তো হল না। শরীরটার খেয়াল রাখতে হবে তো। নাকি আমাকে এখানে পাকাপাকি এনে রাখার মতলব হু? হাসতে হাসতেই বুকের ঠিক মাঝখানটায় মাথাটা চেপে ধরে শালিনী। সারারাত এমন গভীর সমুদ্রের ভিতর ডুবে থাকতে আমার ভালো লাগে। আমার ঘুম আসে। কিন্তু যখনই মনে পড়ে যায় ধুসর পাণ্ডুলিপির এক একটা কবিতা আমি ভেতর থেকে কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠি। সমস্ত দৃশ্য ধূসর হয়ে ওঠে। আমি কী লিখেছি এমন? এক লাইন সত্যও লিখে উঠতে পারিনি। যা সমস্ত প্রচলিত ধারার ছক ভেঙে দিতে পারে? কিছু না। এত বছর লিখেও একজন সিনিয়ার আমার কোনও লেখা বা কাজ নিয়ে একটা শব্দ ব্যয় করে না। কেন যে করে না সে আমি জানি, উনিও জানতেন হয়তো। এখানেই তো পোড়া। শুধুমাত্র উপেক্ষা করেই একজন জ্যান্ত কবিকে হিমশীতলভাবে খুন করে ফেলা যায়। এই উপেক্ষা আর অপমানের আগুনে কলিজাটা পুড়তে পুড়তে শব্দের অক্ষরের টেরাকোটা হয়ে ওঠে আমাদের ভিতরে। তা অত সহজে ভাঙে না। থেকেই যায়। একটা দাগ বা আঁচড় হয়ে থাকলেও থেকে যায় কোনও না কোনও কাগজে। এই তো হঠাৎ একদিন এক প্রকাশক এসে বলল, আপনি তো জীবনানন্দের বেশ কিছু কবিতা নিয়ে আলোচনা লিখেছেন। আমরা চাইছি আপনি এবার জীবনানন্দের লেখা নয়, শুধু ওর যাপনটা নিয়ে লিখুন। আমি তো খুশিমনে সেই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম। যদিও তাকে জানিয়েই দিয়েছিলাম কাজটা এতই কঠিন যে আমাকে সময় দেওয়া হোক। তারপর থেকে জীবনানন্দ বিষয়ক অনেক বই পড়তে পড়তে ভিতরটা কেমন গুলিয়ে ওঠা শুরু করেছে। কবিকে কাছ থেকে জানতে নেই। জানতে নেই। না। কিছুতেই জানতে নেই।
আমি এ কোন জীবনানন্দকে দেখে ফেললাম। অক্ষরের গালিচার নীচেই একজন কবির ব্যর্থ ব্যক্তিজীবনের কফিন চাপা পড়ে থাকে। যা খুঁড়ে তুলে আনতে নেই। আমি এমন ভুল কেন করলাম? তারপর থেকে ওই বিশাল ছবির দিকে আমার তাকাতে ভালো লাগে না। হিংসেও হয়। কিছুই লিখতে পারিনি৷ এত বড় সাগরপ্রমাণ মানুষের যাপন নিয়ে লেখার যোগ্যই নই আমি৷ তবু কাজটা ভালোবেসে করতে চাই। কিন্তু কবি আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। আসতে যেতে ওই মায়া চাহনি আমি উপেক্ষা করতে পারছি না কিছুতেই। এভাবে চললে আমি পাগল হয়ে যাব। শালিনী কেন বুঝতে চাইছে না। ও এত নরমাল কী করে থাকে?
দ্বিতীয় পর্ব
এক
আজ বাজার থেকে ফেরার সময় তাই কালো রং কিনে এনেছি। কালো রঙের একটা রেখা নাকি আমার চোখের নীচেও ফুটে উঠেছে। রাস্তায় পরিচিত কেউ দেখা হলেই একই কথা বলে। একটু বিশ্রাম নাও। রাত করে বেশি লেখালেখি কোরো না। কিন্তু আমি যে কোন জ্বালায় মরছি তা আমি জানি। আয়নার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকি। নিজেকের মুখের বদলে ওই ছবির মানুষটার মুখ দেখতে পাই। স্থির স্ফীত দুটো চোখ, তার নীচে গাঢ় কালো রঙের একটা শূন্যতার চিহ্ন। কেন যে বাংলায় একটা শূন্যতা চিহ্ন তৈরি করে যায়নি কেউ। বিস্ময় চিহ্ন থাকতে পারলে একটা শূন্যতা চিহ্নও থাকা দরকার ছিল। কালো রংটা একটা পাত্রে ঢেলে রেখেছি। যাপনের মধ্যে যখন ভ্রম ও কল্পনা ঢুকে পড়ে, আর কে যে সত্যি তা কিছুতেই বুঝতে পারা যায় না। সে জীবন নরকের জীবন, অন্ধকার খুপরির জীবন।
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে জীবনানন্দের ছবিটার মুখে মোটা ফ্ল্যাট ব্রাশে কালো রং চালিয়ে দিলাম। নেহ। অজস্র কাটাকুটি করে একটা বড় জিজ্ঞাসাচিহ্ন এঁকে দিয়েছি। হিজিবিজি লিখে বাতিল করে দিলাম এই ছবি। এর দিকে আমার আর চোখ যাবে না। কবি আর আমার গোপন অক্ষমতার দিকে তাকিয়ে থাকবে না। আমার যাপন কেন কবিমতো নয় ভেবে আমার অজস্র রাত কেটেছে। এখনও কাটে, আমি কি সত্যি হিংসে করছি কবিকে। ওই চোখ দুটো অনেক গাঢ় করে কালো করে দিয়েছি। সারা ঘরময় কালো রঙের ফোঁটা পড়ে আছে, যেন রক্তের ফোঁটা। আমি কি খুন করলাম কবিকে। নিজের ভিতরের জীবিত জীবনের আনন্দকে। আজ ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়েছি তাই। তাও ঘুম আসছে না। ঘুমের ওষুধেও কী জল মেশায় আজকাল? কী জানি। ওষুধ নিলেই মনে হয়, বাইরের জগৎটা একটা সার্কাস। পাড়ার সমস্ত দেওয়াল পেচ্ছাপে ভরে গেছে। একটা গানও সুরে গায়নি রবীন্দ্রনাথ। বৃদ্ধ গল্পকারটি নেহাতই ঢ্যামনা। কালো রং করেও শান্তি হয়নি আমার মনে, জানলার কাছে খবরের কাগজ লাগানো ছিল, সেখানেও অবশিষ্ট রংটুকু লেপে দিয়েছি। আর গীতবিতানের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আঠা দিয়ে জীবনানন্দের মুখে সাঁটিয়ে দিয়ে আমি হেসে উঠেছি। বলেছি চুপ থাক এবার। বেশ হয়েছে শালা। আর তাকাবি আমার অসহায়তার দিকে। কবিরা সব দেখে ফেলে না? জানি তো, তাই জন্যই চোখ দুটো কালো রং দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। একদিন আমি আমার চোখেও গাঢ় অন্ধকার ঢেলে দেব।
দুই
শালিনীর সঙ্গে আমার যে শর্তগুলো আছে, তার মধ্যে এটাও ছিল যে আমি কখনও ওর বাড়িতে আসব না। ওর পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা করব না। ওর বাড়ির থেকে আসা ফোন রিসিভ করব না। আমি যাইনি কখনও ওর বাড়ি। সে শর্ত আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে এসেছি এত দিন। ওর বাড়ি থেকেও কখনও যোগাযোগ করেনি কেউ। যদিও ওর বাড়িতে সকলেই জানত যে ও আমার সঙ্গে কেমন সম্পর্কে রয়েছে। কিছুদিন আগে স্কুল থেকে বাচ্চাদের নিয়ে নাচের ওয়ার্কশপে গেছে শালিনী। পাঁচদিনের জন্য৷ ওডিশায়। আর আজকেই শীতলা পিসিও আসেনি। শর্ত অনুযায়ী আমার ওকে জানানোর কথা ছিল, আবার আমার রান্না করে খাওয়াও মানা। শালিনীকে ফোন করে রোজের মতোই খেয়ে নেওয়ার খবরটুকু দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে এসেছি। মিথ্যে বলাটা শর্ত ভঙ্গের আওতায় পড়ে না। অকারণ বাইরে থাকা মানুষটাকে ব্যতিব্যস্ত করে কী লাভ। হাত পুড়িয়ে তো খাইনি।
আজ আমি সারাটা দিন বাইরে বাইরে। কিছুতেই মন ঘরমুখী হচ্ছে না সকাল থেকে। শালিনীর কথা মনে পড়ছে। কিন্তু জানি না কেন ওই ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না আজ। বুড়ি ঝিলের সামনে বসেছিলাম কতক্ষণ। একটা লেখা মাথায় এসে ধরা দিয়েও ছলনা করে ফিরে গেছে। শালিনীও এমন করে। কাছে এসে, কাছে টেনেও কিছুতেই ধরা দেয় না। ঝিলের জলের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, সত্যি যেন ধানসিড়ি নদীর তীর। পাখির ডাক। বুড়ি ঝিলের গায়েই একটা বেশ পুরোনো হিজলগাছ। ঝিলের পাড় ধরে প্রচুর ভাঁটফুল ফুটে আছে। এখানেও মানুষটা আমার পিছু ছাড়েনি আজ। ভাঁটফুলের সঙ্গে আমার শুধুই নৃশংসতার স্মৃতি। জীবনানন্দ যেভাবে ভাঁটফুলকে দেখেছেন আমি দেখিনি সেভাবে। আমি ভাঁটফুলের কুঁড়ির ভিতর থেকে পুংকেশরগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঝিলের জলে ফেলে দিতাম। আর পুংকেশরগুলো চরকির মতো ঘুরতে থাকত, নাকি যন্ত্রণায় পাগলের মতো দৌড়ে বেড়াত আমি জানি না। আমার কবিতাযাপনের ভিতর এই নারকীয় শৈশবস্মৃতি আমি লুকিয়ে রেখেছি। কেউ জানে না। আমি ঝিলের গায়ে পাথর ছুড়ে মারতেই মাথা ঘুরে যায়। হুঁশ ফেরে। বাড়িতে তো ফিরতেই হবে। রাতে ভিডিও কলে শালিনী একবার দেখা করে। ঘুমিয়ে পড়তে বলে।
আজ বাজার থেকে ফেরার পথে আবার দুটো গোল্ড ফিশ এনেছিলাম। কাচের বোলে রাখলাম। ক’দিন বাঁচে দেখি। আর রাতের খাবার। পেপারে মোড়ানো রুটি আর সবজি। আজ কিছু পুরোনো পত্রপত্রিকা বিক্রি করে ২৪৮ টাকা হাতে এসেছে। দুটো সংখ্যায় শালিনীকে নিয়ে দুটো কবিতা লেখা ছিল। আজ ২৪৮ টাকার থেকে শালিনীর জন্য একটা বই কিনেছি। কতদিন বই কিনিনি বলে একদম ভালো লাগছিল না। অস্থির করছিল ভিতরটা। ফিরে এসেই দেখা করবে শালিনী। বইটা নেবে কি না জানি না। হয়তো বলেই বসবে এই শর্তগুলো মনে আছে তোর? আমাকে কিছু কিনে দিবি না কখনও। যা দেওয়ার আমি দেব।
তিন
স্বপ্নের পরিমাণটা দীর্ঘ হচ্ছে আজকাল। একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। আমি এগিয়ে যাচ্ছি একটা অনন্ত লাইন ধরে। শেষ নেই। আমার পিছন দিক থেকে একটা দেওয়াল আমাকে ক্রমাগত তাড়া করে চলেছে। কাঁধ ঝুঁকে যাওয়া একটা বছর পঞ্চাশের লোক আমাকে কেমন ইশারা করে ডাকে। আমি তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারছি না কিছুতেই। কিছুক্ষণ পরেই ভিড় আমাকে টেনে তুলছে। আমার বুকের ওপর অজস্র বইচাপা পরে আছে। হঠাৎ দেখি লোকটা ট্রামলাইনের মাঝে শুয়ে পড়েছে। আর আমি তীব্র গতিতে ছুটে আসা ট্রামটাকে থামতে বলছি, কিন্তু ট্রাম থামছে না। লোকটা আবার বিস্ফোরিত চোখের চাহনিতে মৃদু হাসছে। ওর চোখের পলক পড়ে না। জীবিত মানুষের চোখ না মৃত আমি ঠাওর করতে পারি না। আমি চোখ বন্ধ করে নিতেই বুঝতে পারি লোকটা চাপা পড়েছে। আমার জামায় ইঙ্কের দাগ ছিটকে এসে লাগল কোথা থেকে। আমার ব্যাগটা কাগজের দলা পাকানো বলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কি খুঁজছি? শালিনীর দেওয়া পেন থেকে গলগলিয়ে এমন কালো রং চুইয়ে পড়ছে কেন। আমার দুই হাত ডুবে যাচ্ছে কালো পাঁকের ভিতর। স্বপ্নের ভিতর রক্তের এমন চোরাস্রোত বয়ে যায় কোন ঠান্ডা নদীর দিকে আমি জানি না।
কীসের হইচই এত? বইপাড়া থেকে লোক ছুটে আসছে এদিকে। সবাই একই দেখতে। এক পোশাক। এক সুরে চিৎকার করছে ওরা। ভিড় থেকে ঠেলে আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি ট্রামের চাকায় আমার গলা পেঁচিয়ে গেছে। আমি হাজার চেষ্টা করেও বেরিয়ে আসতে পারছি না চাকার নীচ থেকে। শালিনীর গলার আওয়াজ শুনতে পারছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। কিছুটা দূরেই বছর পঞ্চাশের লোকটি ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে পরের রাস্তায়। আমার চোখে কালো রং দিয়ে কে যেন ঘষে দিয়েছে। আমি কিছু স্পষ্ট দেখতে পারছি না আর। চোখের সামনে একটা বন্ধ জানলা। তাতে কালো রং করা। এলোপাতাড়ি নিউজ পেপার ছিঁড়ে জুড়ে জুড়ে আড়াল করে দেওয়া বাতাসের ভিতর থেকে একটা ব্যর্থতার পচা গন্ধ ভেসে আসছে। তার ওই পারে একজন বৃদ্ধ দম্পতি। তাদের হাতে একটি বাঁধানো ছবি। বিস্ফারিত চোখ, মৃদু হাসি। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে। চোখ বুজে আসছে আবার।
চার
হাসপাতালের করিডর ধরে দৌড়াচ্ছি। হাসপাতালে জায়গা না পাওয়া রুগিরা করিডর ধরেই শুয়ে আছে। স্ট্রেচারটা ধরে রয়েছে দুইপাশ থেকে আরও দুজন। লোকটা কি মরে যাবে? বাঁচবে না মনে হয়। ডাক্তার কোথায়? ডাক্তারকে ডাকুন, ইমার্জেন্সিতে কে আছেন? ভিড় জড়ো হয়ে যাচ্ছে। লোকটার আয়ুর ভিতর একটা আশ্চর্য প্রদীপ না নিভে জ্বলছে কোনওমতে। যে কোনও সময় শিখা উঁচু হয়ে নিভে যেতে পারে। আমার জামার মধ্যে রক্তের দাগ লেগে আছে। সঙ্গে রয়েছে অচেনা দুজন। তারাও এক মুহূর্ত দেরি না করে আমার সঙ্গে চলে এসেছে লোকটাকে নিয়ে। এই তো এইমাত্র ডাক্তার এসেছে, এগিয়ে এসে দেখছে। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত দলা পাকিয়ে আসা একটা মানুষের ভাঙা জীবন জুড়তে নিয়ে এসেছি মনে হচ্ছে। ফোন আসছে শালিনীর। এক্সকিউজ মি, বলে ফোনটা রিসিভ করেই বললাম- শোন, আমি হাসপাতালে এসেছি। একজনের ভীষণ সিরিয়াস একটা ইনজুরি নিয়ে। লাইফ রিস্ক আছেই। কেউ এগিয়ে আসছিল না। আমি আর দুজন মিলে নিয়ে আসলাম। পুলিশ আসবে। কথা বলবে। দেরি হবে আমার। জানি না এখানে পরিস্থিতি কী হয়। তুই আমার ঘরে বস। আমি জানি না এখান থেকে কখন বেরোতে পারব।
বইপাড়ার সামনে ট্রামের লাইনে একজন কাটা পড়েছে আজ। তাকে নিয়েই হাসপাতালে ছুটে এসেছি আসলে। না না তোকে আসতে হবে না। আমি একাই ফিরে আসব সবদিক বুঝে। না লোকটাকে তো চিনি না। সঙ্গে যারা এসেছে তাদেরকেও চিনি না। আমি কেন যে চলে এলাম লোকটাকে বাঁচানোর জন্য, আমি নিজেও জানি না রে শালিনী। রাস্তার লোকটিও দেওয়ালের ছবির লোকটার মতোই মরতে বসেছে দেখে হয়তো। আমার স্বপ্নটা এবার আমার বাস্তবের জীবনেও আমার পিছু নিতে শুরু করেছে। তোর দেওয়া শার্টে রক্তের দাগ লেগে গেছে। একদমে কথাগুলো বলতে বলতেই ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিলেন, পেশেন্ট আর বেঁচে নেই। দেওয়ালের ছবিটাও তো প্রায় মৃতই। এই ভরদুপুরে এত লোকের মাঝে দাঁড়িয়ে একটা আস্ত ট্রাম চোখে পড়ল না আপনার? মৃত ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলেই ফেললাম।
এমন বিচ্ছিরিভাবে আমি ছবিটার মুখে কালো রং দিয়ে হিজিবিজি করেছি, যে শালিনী এসেই ভীষণ বকাবকি করছে আজ। এত সুন্দর একটা ছবি আমি কেন খারাপ করেছি সেই কারণটা জানতে চায় ও। কী বলব ওকে? আমি এই মানুষটাকে এখন সহ্য করতে পারছি না? এই মানুষটাও তো আমার লেখায় চুপ করে থাকে, একটাও কথা বলে না। নিজের বেলাতেও শুরুর দিকে কতই না অবজ্ঞা, উপেক্ষা সহ্য করতে হয়েছে মানুষটাকে। তাতে আরও বেশি করে মনে হয় আমরা বরাবর যোগ্য কবির কাজকর্মে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব থাকি। হাসপাতালের লোকটি আমার কেউ না। আমার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবির লোকটিও আমার কেউ না। দুজনেই ট্রামের লোহার চাকায় জড়িয়ে মড়িয়ে মরেছে। হাসপাতালের লোকটিকে জানি না কেন ঘরের দেওয়ালের ছবিটির মতো লাগছে। একটা প্রাণবন্ত ছবিকে আমি লাশকাটা ঘরে শোয়ানো ট্রামে কাটা পড়া কবির ঠান্ডা লাশ বানিয়ে দিয়েছি। আমার চোখ বসে কালো হয়ে গেছে৷ সেলাইয়ের দাগ মনে পড়ছে।
আমি বাড়ি চলে এসেছি হাসপাতাল থেকে তারপর৷ কত লেখা বাকি পড়ে আছে। আমি কিছুই লিখতে পারছি না অথচ লেখার আগাম নিয়ে বসে আছি। আমার ভিতরের এই অস্থিরতা কমাতেই হবে আমাকে। একটু ঘুম চাই। কিন্তু আমাকে ঘুম পাড়াতে পারে একজনই। কিন্তু শালিনীকে নিজ থেকে আসার কথা বলা যায় না। কিন্তু আজ ওর আসা উচিত ছিল। ঘুমের ওষুধ খেয়ে অল্প ঘুম আসছিল ঠিকই। কিন্তু তারপরেই যেই মনে পড়ে গেল শর্ত, কবির জীবন তো শর্ত ভাঙার জীবন। শর্ত ভাঙার মাধ্যমে আমরা বুঝিয়ে দিতে পারি, পুরুষ কখনওই শর্তসাপেক্ষে বাঁচে না। জীবন তো চাকার মতো গড়িয়ে চলে। ঘাতক ট্রামটিকে এরপরেও পথে নামতে হবে। তার চালক রোজ মনে মনে কামনা করে গাড়িতে ওঠে, কে কার মৃত্যু রেখার নাকবরাবর সার্কাসের খেল দেখিয়ে বেরিয়ে যায়। আমারও খুব ইচ্ছে করে জানো… নতুন করে বাঁচি। ভোরের জানলা খুলে দিয়ে পাখিদের ফিরে ফিরে ডাক দিই। আমার প্রিয় পাখিটি যখন আমার রুক্ষ জীবনের ডালে এসে বসে আমি শালিনীর কথাই ভাবি।
পাঁচ
আজকাল একা থাকতে ভালোই লাগে৷ সকাল হলেই একটা নতুন কিছু উন্মাদনা ঘিরে ধরে আমাকে। এরমধ্যে শালিনী একটানা বেশ কিছুদিন আমার কাছে ছিল। শর্তে এমন নিয়ম ছিল না কখনোই। তবু ছিল। শালিনী এতটা সময় যে আমাকে দেবে আমি কখনও ভাবিনি। আমাদের ভালোবাসার সংজ্ঞা দেওয়াটাও বেশ কঠিন। ভালোবাসায় তো শর্ত থাকে না শুনেছি। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বেশ কিছু শর্তের কাছে বাঁধা আছে। ও হয়তো ভেবেছে আমাকে একভাবে সময় দিলে আমার একাকিত্বের মনখারাপটা, এই পাগলামিগুলো দূর হবে। বেশ ক’টা দিন মনেও হয়নি যে আমরা আলাদা থাকি না। যেন কয়েকদিনের সংসার সংসার খেলে নিলাম ওর সঙ্গে। ওকে কী করে বোঝাই যে আমার সমস্যাটা একাকিত্ব নয়, শালিনীকে ছেড়ে থাকাও নয়।। এর বাইরে কিছু একটা। আমি কেন কিছুতেই খুশি থাকতে পারি না। কেন সবসময় আমার ভিতরে একটা তোলপাড় চলে। আর ওই ছবির মানুষটা, মরেও যে শান্তি দেয়নি কাউকে, সে আমাকে কীভাবে ভালো থাকতে দেবে? তবু তো আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি একরকম।
শালিনী আমাকে কেন এত আগলে রাখে আমি জানি না। ভয় পায়? আমি হারিয়ে যাব? এই সমস্ত মনখারাপের মধ্যেও ঘরভর্তি মনপছন্দের খাবার মজুত রেখেছি, ফ্রিজে চার ক্যান বিয়ার৷ আগে ড্রিংকস রাখতাম না। এখন রাখি। শালিনী অভ্যাস করিয়েছে এসব। বলেছে নিজেকে আনন্দে রাখো। কেন যে আমার পিছনে এত বাজে খরচ করে। ভালো থাকতে থাকতে ভালো থাকাটাও একটা অভ্যাস হয়ে যায়। শুনেছি একা মানুষের কাছে প্রিয় কিছু খাবারের স্টক থাকা দরকার সবসময়৷ এতে মুড ডাউন হয় না কখনও। আমিও কম চালাক নই৷ ডিপ্রেশনের সঙ্গে ডিল করতে শিখেছি বেশ। এমনকি ঠকাতেও। একটা ভয় আর উৎকণ্ঠা আমাকে অদ্ভুতভাবে পেয়ে বসেছিল। কতদিন পর ভালো আছি। শালিনীকে সবটা বলার পরে ও আমাকে ডঃ মুখার্জির কাছে নিয়ে যায়। নামকরা সাইকোলজিস্ট। উনি তো দেখেই এক গাল হেসে বলেছিলেন, আপনি তো পোয়েট? রাইট? আমি ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার আবারও হাসতে হাসতে আমাকে জবাব দিয়েছিল, আরে মশাই বাঙালি হয়ে কবিকে চিনব না এমন হয়? আপনার লেখা বই আমার ওয়াইফ পড়ে। তা লেখক মানুষ একটু ওভারথিংকিং তো করবেই, সেটা তার কবিতার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভালোই। কিন্তু আপনার কেসটা বিওন্ড দ্যাট। হ্যালুসিনেট করছেন। শালিনী আমাকে ম্যাটারটা জানিয়েছে। আপনার অসুবিধেটা যদি একটু খুলে বলেন আমাকে। আমি ডাক্তারের হাস্যমুখ চেহারা দেখেই অনেকটাই ভয় কাটিয়ে ফেলেছি তখন। বললাম ডাক্তারকে। সমস্যাটা তো আমার নয় ডাক্তার, সমস্যাটা হল গিয়ে জীবনানন্দ দাশের।
আপনি কবি জীবনানন্দ দাশের কথা বলছেন? হ্যাঁ, কবি জীবনানন্দ দাশ। একটা ছবি আমার ঘরে লাগানো আছে দেওয়ালে। ছবিটা সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর আপনি নিশ্চয়ই দীর্ঘ সময় ঘরে একাই থাকেন? হ্যাঁ। আমি একাই, আমার ফ্যামিলিতে বর্তমানে। আচ্ছা, কুণালবাবু, আপনি কখনও এমন কি দেখেছেন যে ছবি থেকে মানুষটা জলজ্যান্ত মানুষে পরিণত হয়ে আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে? বা আপনার সঙ্গে কথা বলেছে? বা আপনাকে আঘাত করার চেষ্টা করেছে এমন কিছু? না, এমন না। আমি এমন একটা স্টেট অফ মাইন্ডে চলে যাই মাঝে মাঝে যেখানে আমার রিয়েলিটি আর ইম্যাজিনেশনকে আমি আলাদা করতে পারি না ডাক্তার। সবটাই রিয়েলিটি মনে হয়। এমনকি আমরা, মানে আমি আর জীবনানন্দ পরস্পরের দেহে ঢুকে যাই। রোল প্লে’র মতো। তখন আমি নিজেই জীবনানন্দ হয়ে উঠি। আমার সবসময় ফিল হয় যে মানুষটা আমাকে ভালো রাখতে চায় না। আমাকে আরও খারাপ থাকার জন্য প্রোভোক করে। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি ডাক্তার?
ডাক্তার মুখার্জি আবার হেসে বলেন, আপনারা পাগল না হলে পাঠকরা কাদের লেখা ভালোবাসবে। লেখকমাত্রই পাগল ও ফিট এন্ড ফাইন। কবিদের একটু মানসিক অস্থিরতা থাকেই। কিন্তু তবু আমি আপনার কেসটা নিয়ে আরেকটু স্টাডি করে আপনাকে জানাব। ততদিন এই ওষুধগুলো নিয়ম করে খেতে থাকুন। শালিনী দেবী আপনি, একটু দেখে নিন। শালিনী ডাক্তার আর পেশেন্টের মাঝখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে বসেই থাকে বেশিরভাগ ভিজিটে। আমি শুধু অবাক হয়ে দেখি একটা লোক এত হাসতে পারে? হাসি ছাড়া তার মুখে কথাই নেই। আমিও হেসেই জবাব দিই। আপনার ওয়াইফকে আবার বলে বসবেন না যে আমার ট্রিটমেন্ট করছেন। কবি যে সত্যিসত্যি পাগল একথা শুনে কিন্তু ভারী দুঃখ পাবেন তিনি। ধীরে ধীরে ডাক্তার মুখার্জির সঙ্গে একটা হাসিখুশির থেরাপি সেশন চালু হয়ে গেল বলা যায়। শালিনী দোতলার ঘর থেকে জীবনানন্দের ছবিটা নামিয়ে স্টোর রুমে ঢুকিয়ে রেখেছে। আমি কেন পারলাম না এটা করতে। হায় কবি, শেষে স্টোর রুমে তোমার স্থান হল। মনে মনে কিন্তু বলেছি বেশ হল। ভিতরটা পুড়িয়ে মারছিল। ঘরে একটাও দড়ি জাতীয় কিছু অবশিষ্ট রাখেনি শালিনী। পয়জন ধরনের কিছুও নেই যা খেলে বিপদ ঘটতে পারে। জানলাটা যদিও বন্ধই থাকে এখনও। খুলতে চেয়েছে, কিছুতেই দিইনি। ছবিটা আঁকা শুরু করেছি আবার। দেওয়ালে একটা নতুন গ্রাফিতি করেছি, যদিও কবিতার লাইনগুলো জীবনানন্দের লাইন। সাদা কালোয়। এলোমেলো।
‘আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।’
ছয়
ঝিলের ধারে বসে কেটে গেছে কয়েকটা দিন। ভালোই লাগে৷ ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশ দেখি। মাথার ওপর দিয়ে পাখির ঝাঁক উড়ে যায়। রূপসী বাংলার একটা রেফারেন্স পেয়েছি এখানে। বেশ কিছুদিন হল আমি স্বপ্ন দেখি না। ঘুমিয়ে পড়ি শুলেই। ডাক্তার মুখার্জি আপনার ওষুধে তো জাদু আছে। জানি না ডাক্তার মুখার্জির ওষুধ নাকি শালিনীর কাছে থাকা কোনটা আমাকে সমস্ত অবসাদ ভুলিয়ে দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কী যেন একটা কানে ভেসে আসে এরপরেও, যেন কেউ কানের খুব কাছে এসে ধীরে-ধীরে কথা বলে। ডাক্তার মুখার্জি তোমাকে ধীরে-ধীরে সাধারণ মানুষ বানিয়ে দিচ্ছে কুণাল। কিছুই তো লিখতে পারো না। এত খুশি মনে? মনে নেই? শালিনীর বিচ্ছেদ? ভুলে গেছ বাবার ভাঙা গলার গান? সারাদিন বিষণ্ণ হয়ে জানলার কাছে বসে থাকা? মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না যে সন্তান তার জীবনে এত আনন্দ কেন? ডাক্তার মুখার্জি তোমার ভিতরের কবিকে মেরে ফেলছে গোপনে। খুন করে দিচ্ছে। উনি হিংসে করেন তোমাকে। ওঁর স্ত্রী রাতের বিছানাতেও তোমার বই মাথার কাছে নিয়ে ঘুমান। কী ভাবছ? তোমার দুঃখ নেই? দুঃখের বোধ কোথায় হারিয়ে ফেলেছ? শব্দটা আরও জোরালো হয়ে আসে।
আমি চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখি কেউ নেই। ঝিল পাড়ের একলা দুপুরের গোপন বাতাস ছাড়া আর কেউ নেই এখানে। কিন্তু এই গলা আমার চেনা। আবারও কণ্ঠটা কানে ভেসে আসে, এবার তোমাকেই বেছে নিতে হবে। মানুষ হবে না পাগল। আমি উন্মাদ হয়েছিলাম। বিনয় তো পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। তুমি? যতই ভালো থাকার চেষ্টা করো, কারুবাসনা তোমাকেও নষ্ট করে দেবে। করবেই। এরচেয়ে ভালো ডাক্তারের ওষুধ খাও কবি। আমি চিৎকার করে উঠি, চুপ করো, চুপ করো। জলের মধ্যে একটা পাথর ছুড়ে মেরে উঠে আসি। শালিনীকে ফোন করে বলি, আজ রাতে তোকে আসতেই হবে।
ডাক্তার দেখানোর কথা উঠলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় আজকাল। লিখতে লিখতে এমনিতেই মাথা ছিঁড়ে যায় যেন। শালিনীর কাছে একটা গোটা রাত কাটাইনি কত দিন হয়ে গেল। আজ ঘুমের ওষুধ খাব না। বাথরুম থেকে জলের ফোঁটা পড়ার এমন বিকট শব্দে লেখা যায়? কবে থেকে একটা চাকরি খুঁজছি, কিন্তু সিভি পুড়িয়ে ফেলা আমি সারাটা রাস্তা ভাবতে ভাবতে যাই। জল খেতে ইচ্ছে করছে। ডাক্তার মুখার্জির মনের ওষুধ খাওয়ার পরে আমার আর লিখতে ইচ্ছে করে না, সত্যি তো। আমার সমস্ত দুঃখ বোধ নষ্ট করে দিচ্ছে আপনার ওষুধ মিঃ মুখার্জি৷ আমার একলা ঘরের মধ্যে হঠাৎ করেই ডাক্তার মুখার্জির গলা ভেসে আসে, কানের কাছে এসে কথাগুলো মাথা ছিঁড়ে দিতে থাকে, ওষুধ আপনার দুঃখবোধ নষ্ট করছে ঠিকই, সে আপনার কারুবাসনার চেয়ে ভালো। আপনাকে তো নষ্ট করছে না। ক’টাদিন দুঃখটুঃখ ভুলে থাকুন। ক্রিয়েটিভি পালিয়ে যাবে না আপনাকে ছেড়ে। আমি উঠে চলে এসেছি শালিনী, আমি শেষবার ওঁর ওখানে কাউন্সেলিং সেশনে গিয়ে ফেরত চলে এসেছি। কে যায় অমন ডাক্তারের কাছে। লিখব না আমি? কবির মন দুঃখে কাঁদবেই। আমার চোখের জল ওষুধ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার এই ফন্দি আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আমি জানি তুই আমার ওপর খুব রাগ করবি এসব শুনে। কাল গঙ্গার ঘাটে বসবি? বিকেল বেলা? সেই কলেজ কেটে যেভাবে বসতাম। মেসেজ করলাম ফোনে। ভেবেছিলাম ভালো রেস্তোরাঁতে যাব। কতদিন যাই না। কিন্তু পকেট একদম খালি পড়ে আছে। একটু কথা বলা দরকার তোর সঙ্গে। আজকাল আবার দমবন্ধ লাগে। মাথাটা এত ভারী হয়ে গেছে, মনে হয় সোজা হয়ে দাঁড়ালেই মাথার ভারে নুইয়ে পড়ব। পায়ে হেঁটে অল্প পথ ঘুরে আসব। যাবি?
সাত
গত তিনদিন ধরে শালিনীর সঙ্গে কথা বলিনি। শালিনী আজ নিজেই এসেছে। ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে কেন এমন করছিস বল তো? আমি কি তোকে ভালো রাখতে পারছি না? আমি জবাবে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলেছি, যখন তোর সঙ্গে থাকি তোর কি একবারও মনে হয় আমি ভালো নেই? না মনে হয় না। কিন্তু এটাও মনে হয় যে আমি তোর সঙ্গে না থাকলেই তুই এই সব পাগলামিগুলো করিস। কী করা যাবে, পাগলের সঙ্গে প্রেম করার কুফল তো সহ্য করতেই হবে একটু। কথা বলতে বলতেই শালিনী জানলাগুলো খুলতে শুরু করে। আর বলতে থাকে, জানলা খুললেই সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই আমার কথাটা একবার শুনে দেখ বাবু। না, জানলাগুলো খুলিস না, শালিনী। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এত আলো। চোখে লাগে। উঠে গিয়ে জানলাগুলো বন্ধ করে দিলাম আবার। শালিনী মাথা নীচু করে মাটিতে বসে পড়েছে। আমি বললাম, আজ রাতটা থাকবি? আমার শরীরটা কী আগের চেয়ে ফ্যাকাশে হয়েছে? আচ্ছা আমি অন্ধকারে থাকতে থাকতে আমি সাদা হয়ে গেছি? বললি না থাকবি কি না? শালিনী বলল, হ্যাঁ থাকব। আজ শেষবারের মতো তোর কাছে থাকব। তুই খুব অচেনা হয়ে গেছিস। এই কুণালকে আমি চিনি না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। আমি ক্লান্ত কুণাল। আর পারছি না এই জীবনটা নিয়ে চলতে। আচ্ছা, শালিনী, আমার আঙুলগুলো কেমন বাঁকা মনে হয় না আজকাল। আমি আর আগের মতো কিছুই ধরে রাখতে পারি না। সামনে আয়ে, একি আমি তোকেও ধরতে পারছি না কেন? আমি তোকে ছুঁতে পারছি না শালিনী। ওই মানুষটা আমাকে বাঁচতে দেবে না শালিনী। আমাকে বাঁচা। আমাকে বের করে আন। আমার হাত ধর। আমি তোকে আঁকড়ে ধরতে পারছি না। জানলা খুলিস না। বন্ধ কর। বন্ধ করে দে।
শালিনী চলে গেছে আজ সকাল হতেই। আজ ডাক্তার দেখানোর ডেট ছিল যাইনি। বলেছিল শেষবার। সকাল থেকে একটা লেখা নিয়ে বসে আছি। হচ্ছেই না। জীবনানন্দের দাহ দেখে আসার পর থেকে কেমন যেন গুলিয়ে গেছে সবটা। ওই যে ওই লোকটা, যাকে কলেজস্ট্রিট থেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বাঁচল না তো। ওই লোকটাও বেমালুম কাটা পড়ে গেল ট্রামের নীচে। শালিনী বলেছে, যাওয়ার আগে বলে গেছে, আমি কোনওদিন ভালো থাকব না আর। কোনওদিন কাউকে ভালো রাখতে পারব না। আর সে চেষ্টাও যেন না করি। আর কোনওদিন যেন ওর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা না করি। এই শেষ সুযোগটাও আমি হারালাম। একদিন আমিও ট্রামের নীচেই কাটা পড়ব ঠিক, দেখিস। কী যে এত ভাবি দিনরাত। আমি জানি তুই আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব বলেছিস, যাতে আমি ডাক্তারের কাছে যাই। যাতে আমি ওপরের ঘরে জানলা খুলে আলো বাতাসে থাকি। এত ভালোবাসতে নেই কাউকে। এত কিছুর পরেও দেখ কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না। আমিও পারছি না কিছুতেই, ওই ছবিটার থেকে কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারলাম না। কেন যে শালিনীর জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেলাম, কেন ওকে শান্তিতে থাকতে দিলাম না কোনওদিন, এসব ভেবেছি আজ সকাল থেকে। কিন্তু আমি পাগল নই শালিনী। কাল সারারাত মেয়েটা কেঁদেছে আমাকে জড়িয়ে। দু’-হাত জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে আঙুলে। বলেছে ওর পুরোনো কলেজের সেই বন্ধুটাকে ফিরিয়ে দিতে। তাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। একসঙ্গে থাকবে। আর দূরে দূরে রাখবে না। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করা যায় না নাকি আমাকে। দেখতো কী ছেলেমানুষি শুরু করেছিস। আমি কী ছোট্ট বাচ্চা নাকি? যে আমাকে চোখে চোখে রাখবি।
আসলে আমি যা লিখতে চাই আমি তা লিখতে পারছি না, কিছুতেই পারছি না। দেখ না, একটা লোক মরে গিয়েও মানুষের কাছে অমর হয়ে রইল। আর জ্যান্ত মানুষটা চলন্ত ট্রামের সামনে দাঁড়িয়েও খেয়ালই করল না যে জীবনটা সত্যি আনন্দময়। আর আমি জীবন আর মরণের মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা এক অখ্যাত লোক। শালিনী কেমন যেন কাঠ হয়ে আছে আমার শরীর। আর হাতের মুঠো আলগা হয়ে যাচ্ছে খুব। আমি আদর করতে চেয়েও ওকে বলেছি কালরাতে, ঘুমোতে নেই আমার। আমি ঘুমোই না এখন আর। জেগে বসে থাকি সারারাত। ঘুমোলেই একটা ট্রাম এগিয়ে আসে আমার দিকে। তারপর আমি লোকটাটাকে কিছুতেই ওখান থেকে টেনে তুলে আনতে পারি না। লোকটা ট্রামের চাকার নীচে জড়িয়ে যায়। লোকটা আমার হাত ধরে বলে বাঁচাও, কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দেবে। আমি অসহায়ের মতো চোখ বুজে নিই তারপরে… বন্ধ জানলার সামনে অন্ধকার, তার উলটোদিকে এক বৃদ্ধ দম্পতির হাসির শব্দ শুনতে পাই।