চিরভুবনময়

চিরভুবনময়

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


                                                       মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

       যে বয়সে মানুষ রঙিন পিচকারির দোল খেলতে যাবে বলে ভোরে ঘুম ভেঙে তাড়াহুড়ো করে খোঁজে পুরোনো ঘুচিমুচি জামা, আর খানিকটা বেলা উঠলেই ছটফটে হাতে রং গুলে নিয়ে প্লাস্টিকের পিচকারি হাতে দৌড় দেয় জলরঙে উপুড়ঝুপুড় বালতি নিয়ে। ঢনঢন বেচারা এক পুরোনো বালতিও আনন্দে ছলকে ওঠে।

        সব্বাইকে রঙিন ভূত বানাবে ভেবে প্রত্যেকবার যে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ায় অথচ রং ছুড়বার আগেই সামনে দিয়ে হুস হাস  সাইকেল বেরিয়ে যায় বলে হাতের রং ঘাসপাতা আর মাটিতে গড়ায়। মাটি অবশ্য নিজে অনেক রং পরে নিয়েছে আগেই। রং দেওয়ার বা তাকেও মাখাবার জুতমতো কাউকে  হাতের কাছে না পেয়ে এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে  চুপিচুপি সেই ছোটকালের বয়স নিজের গায়েই খানিক রং ঢেলে নেয়; জন্ম ইস্তক সেই অবুঝ হুল্লোড়ের দিনগুলি  কেটেছে আমার দক্ষিণবঙ্গে। আর তিথির পর তিথির ঘাট পেরিয়ে মস্ত চাঁদির থালাখানা দোলপূর্ণিমার ঘাটে এসে লাগলে ঘুম ভাঙা মেঘের গায় অচেনা কার উড়ুনি দেখে দেখে বোবা সেই গানের উত্তরীয়র দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকার বয়সে এসে আমার দিন কাটে উত্তরবঙ্গে।

      মাথায় সান্দাকফুর বিজন মুকুটখানা আর পায়ে সমুদ্রফেনার ঘুঙুর ছমছমিয়ে রূপসি এই বঙ্গের উপর দিয়ে গঙ্গা তো কবেই বয়ে গেছে বিপুল তরঙ্গে। রাঢ়, বরেন্দ্র এইসব নানা অঞ্চলে ভাগ হলেও গঙ্গার ওধার থেকে শুরু হয় দক্ষিণের আর এধারে মালদার পরে পরেই আমাদের উত্তরবঙ্গের।

      পাতা ঝরিয়ে নতুন কুঁড়ি ও কুসুমে পুরোনো এই দুনিয়াকে সাজিয়ে তুলতে হাওয়া মাটি জল চেষ্টার কসুর করে না। একখানা একলা ঘাসও মাথা উঁচু করে দেখে খুলে যাচ্ছে কোঁকড়ানো বীজপত্রের অবাক ঠোঁট।

            পাতাপোতার মঞ্জরি ও ফুলের কেয়ারির সাজগোজে রূপের বাহার দিয়ে এসে পড়ে বসন্ত মস্তান। রুখুসুখু হাওয়ায়‌ রাঢ় ভূমি শিমুল পলাশের অবাধ্য পাপড়ি আর রাঙা মাটির ঝুরো আবির ওড়ায় তো, সে রঙে ঠোঁট ডুবিয়ে কুসুম পাতা, আঁকড় ফুল আর আম মুকুলের  কুহকিনী সৌরভ লাজলজ্জা ভুলে বাতাসের ডালপালা বেড় দিয়ে বলেই ফেলে আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী… ধুলোর আংরাখা গায়ে ঝরা পাতার হাওয়া তখন রাস্তা না গুলিয়ে করে কী?

           দেখেছি ফুলের আস্তিন গুটিয়ে বসন্ত দক্ষিণ বাংলায় একটু আগেভাগেই এন্ট্রি নেয়। কলকাতার রাস্তায় ভাঙা আ্যসফল্টে সার সার ধুলোটের ডালপালা গুলমোহর, কাঞ্চন, ফুরুস আর কাগজ ফুলের মেঘে মেঘে ডুব দেয়। দূরপাল্লার ট্রেন থেকে নেমেই জারুলের মভ রঙা আকাশে শান্ত হয় চোখের আরাম। সবাই অবিশ্যি সেসব না দেখেই ছুটে যায় জরুরি গন্তব্যে যেন মুহূর্তেই হারিয়ে ফেলবে চার দেওয়ালের ঠিকানা। দক্ষিণের গ‌‌‌রামের বাড়িতেও দেখে এলাম বোল থেকে বেশ কুশি আমের গুটি ধরে গেছে আর উত্তরবঙ্গে ফিরে এসে দেখি শিশু সূর্যের দিকে খেলাচ্ছলে সবেই উঁকি দিচ্ছে মুকুলরা।

 কাঁঠালের কচি পাতা ধরেছে মাত্রই। তার আড়ালে এখনও ফুলের কুঁড়িই ধরেনি।

            আসলে বাঁকুড়া পুরুলিয়া ছাড়া দক্ষিণবঙ্গে বিশেষ করে শহর কলকাতায় শীত আসে গড়িমসি করে আর শীতের পোশাক গায় পরতে না পরতে ফাজিল চড়ুইয়ের মতন সে ফুড়ুৎ করে পেইলে যায়।

            উদাসী হাওয়ায় মুকুল ঝরিয়ে যে বাতাস বাউলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, দক্ষিণবঙ্গে তার দেখা মেলার আগেই সে উধাও। বরং তার বদলে সেখানে লু-এর মতো চোখমুখ জ্বলে যাওয়া এক গরম ঝাপটা ঝলসে দেয় পরবাসী প্রাণের দেহাতি মুখ। হয়তো উষ্ণায়নও খানিকটা দায়ী তার জন্য। কিছু যুগ আগেও নিশ্চয়ই অলস দ্বিপ্রহরে ঝরা মুকুল কুড়িয়ে নেওয়ার মতো হাওয়ার কিছু অবকাশ ছিল তন্দ্রাহারা বৌ-কথা-কও পাখির বিফল ব্যথার ডাকে সারা হতে হতে দোলের পূর্ণিমায় গান হয়ে ভেসে যেত যে বাতাস।

          উত্তরবঙ্গে কিন্তু বসন্ত আসার পথে এখনও মন কেমনিয়া এক হুহু হাওয়া দেয়। যে বাতাস ধুলো আর পাতা কুটোর শুকনো সুবাস উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মুখে নিরুপায় আর ফাঁকা লাগে বুক। স্থানীয় মানুষ এই হাওয়াকে বলে ঝাঁওল। শিমুল ফুলের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে পাশের পথচারীকে বলে বুড়ির মাথার চুল উড়ছে দেখো আরে শেয়ালকাঁটা বীজের আঁশ যে গো। গ্রীষ্মকালটা তবে ভালোই যাবে!

           ঋতু এত রং ছড়ায় বলে মানুষও তো রাঙিয়ে নেয় পরস্পরকে। দুয়ার এঁটে আঁক কষেন যিনি গানের আবির উড়িয়ে সবাই মিলে তার শিকল ধরে নাড়া দেয়। সরস্বতীপুজোর বাসন্তী রং শাড়ির আঁচল হোলি বরাবর উড়তে থাকে। দক্ষিণে অবশ্য একদিনেই রং খেলা। জলরং দিয়ে শুরু করে, বাদুড়ে রঙের পর্ব সমাধা করে আবিরখেলায় শেষ। বড়দের পায়ে আবির ছুঁয়ে মিষ্টি খাওয়ার চল এখনও আছে কোথাও। উত্তরবঙ্গে দোল উৎসব আবার একদিনেই ফুরোয় না দোলের প্রথম দিন আবির খেলা আর পরদিন হোলিতে গোলা রং খেলার চল এখানে।

       বিশ্ব উষ্ণায়নের লালচে হাঁ অবশ্য গিলে খাচ্ছে বসন্ত দিন। নিখোঁজ অরণ্য, খুন হওয়া নদী, আর দ্গদগে ঘা ভর্তি সবুজ পশমের মাঠে এখন উড়ে বেড়ায় দুঃখী পলিথিন আর গোঁয়ার থার্মোকল।

আবহাওয়ার তারতম্য ও ঋতুবৈচিত্র্য নষ্ট করে আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে কেবল রাগি এক গরম হাওয়া। নিরুত্তাপ রং আর ভার্চুয়াল কাঞ্চনে বিকশিত আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার ফাল্গুন।

       আর বিশ্বায়নের বাজারহাটকে বাণিজ্যে লক্ষ্মী নয় শুধু প্রেমেরও বসতি মেনে আমাদের বসন্ত উৎসবের মধ্যে কনভেয়ার বেল্টে চড়ে ঢুকে পড়ছে হাগ ডে, রোজ ডে, টেডি আর ভ্যালেন্টাইন্স।

        তবু সব কিছু তো ভালোবাসাকে ভেবেই। বসন্তকালীন পদ্ম, অশোক, আম্র, নবমল্লিকা ও রক্তোৎপল কন্দর্পের এই পঞ্চশর তো জানে প্রেমের অমোঘ শক্তি। ভালোবাসাই তো পারে মানুষ মানুষীর মধ্যে দেশ-কাল-ধর্ম জাতপাত সব বেড়া ভেঙে অনন্য সেই সাঁকো গড়ে দিতে যা পেরিয়ে যাবে বলেই সভ্যতা হেঁটেছে এতটা দূর। বনে নাকি মনে কখন যে বেজে ওঠে সেই বাঁশি, যা শুনে সব ভাসিয়ে বাঁধনে পড়ে অবাধ্য পরান। উত্তর-দক্ষিণে ফারাক যাই থাক বসন্তের ফাঁদ পাতা আছে চিরভুবনময়। …কে কোথা ধরা পড়ে সেই জানে…

The put up চিরভুবনময় appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *