আরএসএসের সদর দপ্তরে গিয়ে সংগঠনের ঢালাও প্রশংসা করে এলেন নরেন্দ্র মোদি। এককালে নিজে সংঘের প্রচারক ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে এহেন সংঘ প্রশস্তি নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। মোদি বলেছেন, আরএসএস ভারতের অমর সংস্কৃতির আধুনিক অক্ষয় বটবৃক্ষ। শতবর্ষ প্রাচীন আরএসএসের মূল্যায়নে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, রাষ্ট্রীয় চেতনার সংস্কারের জন্য যে বিচারধারার বীজ ১০০ বছর আগে বপন করা হয়েছিল, সেটি এখন মহীরুহের মতো দুনিয়ার সামনে চলে এসেছে।
সংঘ প্রশস্তিতে আকুল মোদির ভাষায়, সংঘরূপী অক্ষয়বট ভারতীয় সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় চেতনাকে নিরন্তর শক্তি জোগাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন কারও মুখে এ কথা শুনে সংঘের নেতা-কর্মীদের যারপরনাই উল্লসিত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ মোদির আগে একসময় বিজেপির আরেক নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রীর আসনে থাকলেও তাঁর মুখে এমন সংঘ প্রশস্তি কখনও শোনা যায়নি। যদিও তিনি দীর্ঘদিন সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে সংঘ প্রশস্তি থেকে দূরে থাকতেন। বরং তত্কালীন আরএসএস প্রধান কেএস সুদর্শনের সঙ্গে বাজপেয়ীর বিরোধ প্রায়ই খবরের শিরোনাম হত। মোদি গোড়ায় বাজপেয়ীর পথে হাঁটার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই পথে অবিচল থাকতে পারলেন না। আরএসএসকে চটিয়ে তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রিত্ব বজায় রাখা কঠিন বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি।
বাজপেয়ী জমানায় দেশে সংঘ পরিবারের তত্পরতা বেড়েছিল ঠিকই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের আপাদমস্তক আরএসএসের চিন্তাধারা এখনকার মতো জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। মোদি জমানায় সরকারের যাবতীয় কাজকর্মে আরএসএসের চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটছে। দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করা ছাড়া সংঘের বাকি প্রায় সমস্ত ইচ্ছাই গত ১১ বছরে একটু একটু করে পূরণ হচ্ছে।
অযোধ্যায় রাম মন্দির হয়ে গিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কিত সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার হয়েছে। জওহরলাল নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক ঘরানার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে, হিন্দুত্বভিত্তিক রাজনীতির অভিমুখ নির্ধারণে সংঘের সুপ্ত বাসনার ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন এখন স্পষ্ট। দেশভাগ ও স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, তার বদলে ধর্মকে রাজনীতির জিয়নকাঠি হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে একটু একটু করে।
মোদি জমানায় এটাই সংঘ পরিবারের বড় সাফল্য। যেটুকু অ্যাজেন্ডা বাকি আছে, এক দেশ-এক ভোট ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে সেটুকু করে ফেলতে মরিয়া মোদি সরকার। প্রশ্ন ওঠে, সবই যখন ঠিকমতো চলছে, তখন মোদির হঠাৎ নাগপুর যাওয়ার প্রয়োজন কী পড়ল? আসলে মোদি সরকার এবং বিজেপির সাফল্যের জয়গাথায় আরএসএসের কীর্তি খানিকটা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। মোদি যে আরএসএসের থেকে বড় নন, সেটা তাঁকে এবং বিজেপির সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে গত লোকসভা ভোটে টের পাইয়ে দিয়েছিল সংঘ পরিবার।
বিজেপির আর আরএসএসের প্রয়োজন নেই বলে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার হামবড়া ভাব মন্তব্য সংঘকর্তাদের মনে ধাক্কা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। লোকসভা ভোটে হোঁচট খাওয়ায় বিজেপির কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আরএসএস পাশে না থাকলে শুধু মোদি জাদুতে ভোট বৈতরণি পার করা সম্ভব নয়। তারপর ভুল স্বীকার করতেই হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, দিল্লিতে সংঘের বরাভয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে বিজেপি।
বিজেপি নেতারা বুঝে গিয়েছেন, নাগপুর সন্তুষ্ট থাকলে নির্বাচনি জয় অনেকটা আসান হয়ে যায়। সামনে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাডু ইত্যাদি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের আগে তাই আরএসএসের সঙ্গে সমীকরণ মসৃণ রাখা এখন নরেন্দ্র মোদির প্রধান কাজ। তাছাড়া সংঘের শীর্ষ নেতৃত্বের আশীর্বাদ থাকলে বিজেপি সভাপতি পদে নাড্ডার উত্তরসূরি বাছাইও সহজতর হবে। গেরুয়া রাজনীতির সমীকরণে পাল্লা ভারী রাখতে মোদি ও বিজেপি নেতৃত্বের এখন সংঘ ভজনা ছাড়া অন্য উপায় নেই।