- পরাগ মিত্র
‘দেল নামাবো যে উঠোন কোথায়!’ বক্তা বয়স সতেরোর রায়ান। বছর পাঁচেক দেলপাট উচ্চারণভেদে বেলপাট, বাণপাট কাঁধে চৈত্রের রোদে মাগন সন্ধানী। গিজগিজে অ্যাপার্টমেন্টে ঠাসা শহরে উঠোনের মতো উলুশঙ্খে দেবতা বরণের জেঠিমা–দিদিমারাও উবে গেলেন। সপাটে গেট টানে কঠিন চিবুকের দারোয়ান- ‘অন্দর জানা মানা হ্যায়’। গাঁয়ে কদর থাকলেও শহর লাগোয়া নিস্পৃহতার দিঘল ছায়া। তবু কেন ফি বছর রাস্তায়? ‘ঠাকুর আমার রক্তে’, ভাঙা দেউলের দীর্ঘশ্বাস মানিকগঞ্জের জয়ের গলায়। পিতামহ নৃপেন ঋষির উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দায়ভার পিতা ধীরেন ঋষি হয়ে আজ তার কাঁধে।
গাজন সগাঁ জন’ বা ‘গর্জন’ দুইয়ের সমার্থ হতে পারে। রূপভেদ থাকলেও বারকোদালি থেকে ছাতুবাবুর বাজার চৈত্র সংক্রান্তির চড়কই মুখ্য। বাকিরা ‘হুজুগে গাজন’। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শিব আরাধনার নাচগান চড়কের উৎস কি না তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যিনি শিবের তাণ্ডবে হাজার হাতে মৃদঙ্গ বাজানো বাণরাজা কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে শিবতুষ্টির জন্য নিজের রক্ত উৎসর্গ করার প্রথা থেকেই চড়ক। শারীরিক যন্ত্রণায় দেবমন জয়ের প্রয়াস পাশুপাত সম্প্রদায়ের মতোই ধর্মপুরাণের লাউসেনও উদাহরণ। রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুরকেও চড়কের প্রবর্তক হিসেবে মান্যতা দেওয়ার সঙ্গে ‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না’র সবক শেখাতে খাজনা খেলাপিদের পিঠে বড়শি গেঁথে ঘোরানোর নির্মমতার গর্ভে চড়কের জন্ম বলেও দাবি। অনেকে দেবতার উদ্দেশ্যে চৈত্রের ফুটিফাটা মাটি বৃষ্টি সিঞ্চিত করার আর্তিতেই চড়কের আরাধনা বলে অনুমান করেন।
হুতোমের কথায়, ‘‘… পাঠশালা বন্দ হয়ে গিয়েছে ছেলেরা গাজনতলাই বাড়ি করে তুলেচে আহার নাই নিদ্রা নাই ঢাকের পেচোনে পেচোনে রপ্টে রপ্টে ব্যাড়াচ্ছে কখন ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চিৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে…”। অনার্যের প্রাণণাথ শিব চড়কের আরাধ্য দেবতা। শ্মশান মশানে ছাইভস্ম মেখে বিচরণ করা শিব গাঞ্জার চিরল পাতায় মজে সশিষ্য নাচেন। শিবের শিষ্যত্বে জাত, ধর্ম, উঁচুনীচু বাছবিচার নেই। চড়কেও ব্রাহ্মণ্যবাদ না থাকলেও ‘ক্লাস ডিভিশন’ স্পষ্ট। মহেন্দ্রনাথ দত্ত’র পর্যবেক্ষণ “… উচ্চবর্ণের লোকেরা কখনও চড়কগাছে ঝোলে না বা পিঠে কাঁটা ফোঁড়ে না”। নীহাররঞ্জন রায়ের “মূলতঃ অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ও অব্রাহ্মণ্য” চড়কের অচ্ছেদ্য অংশ ভূতপ্রেত। শিবের সঙ্গে চলা “চব্বিশ কুটি বাণবর্ষা”র মতোই “সত্যযুগের মড়া আওল যুগের মাটি”র আবশ্যিকতা দুর্গা শুনিয়েছিল অপুকে।
‘সংবাদ প্রভাকর’ রামকমল মজুমদারের চিঠি, শ্রীরামপুরের পাদ্রিদের মিনিটস, ১৮১৯-এর ক্যালকাটা জার্নাল থেকে জানা যায় পুণ্যের সঙ্গে বড় চড়কের আয়োজন জমিদারদের স্ট্যাটাসের অন্যতম সিম্বল ছিল। উনিশ শতকে চড়কের শারীরিক নির্যাতনের প্রথার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। ‘রিফরমার’ চড়ক বন্ধের দাবি জানায়। ‘সমাচার দর্পণ’ বাণ, বড়শি ফোঁড়া বাদে পুজো বজায়ের চিঠি আসে। ‘বেঙ্গল হেরল্ড’ সন্ন্যাসীদের মত্ত আচরণ, দুর্ঘটনা, “হরকরা” শাস্ত্রীয় যোগহীন বলে সমালোচনা করেন। ‘ক্যালকাটা মিশনারি কনফারেন্স’ চড়কঘোরা বন্ধের জন্য লাটসাহেবকে অনুরোধ করে। ‘বঙ্গদর্শন’ আপত্তি জানায়। চিন্তাশীল ও শিক্ষিত লোকের বিরক্তির জন্য চড়কের বিরুদ্ধে বিলেতে চিঠি লিখলেন সেসিল বিডেন।
প্রতিস্বরও ছিল। কালী পুরোহিতস্য স্বাক্ষরের এক পুরোহিত ‘সমাচার দর্পণে’ লিখলেন ‘পার্বণ উপলক্ষে বচ্ছরভর একদিন আহ্লাদ করা অনুচিত নয়, বরং অনুচিত অন্যের রুচিকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্ধ নিন্দা করা’। ১৮৩৯–এ চৌরঙ্গিতে চড়কের শোভাযাত্রা বন্ধের নির্দেশ আসে। ‘বাণ ফোঁড়া’ ‘সঙ’ ছাড়া চড়ককেই অনুমতির দেওয়ার নির্দেশের সঙ্গে গ্রেপ্তারি, নিষেধাজ্ঞার পরিসর বাড়লেও ১৮৬৮-র ১৩ই এপ্রিল, নয় ঘণ্টা চড়কের কথা লিখল ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’।
১৮৭০-এ ছাতুবাবুর মাঠে আসা রামদুলালের চড়কের চড়কিপাক নিয়ে দুই শতাব্দী পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন “হুড়মুড়িয়ে এসে পড়লো বর্গীর মতন বৃষ্টি/ একজন মানুষ শূন্যে ঝুলছে”…ডাবগ্রামের চড়কের বালা অর্থাৎ মূল সন্ন্যাসী অমূল্য সরকারের কথায়, ‘সবাই সন্ন্যাসী হতে পারে না। ডাক আসলে পাগল হয়ে ছুটে আসবে।’ মৎস্যমুখ পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের বালার বড়িতেই ঠাঁই। চুল, দাড়ি, নখ কাটা, সাবানে না। স্নান সেরে পুজোর পর নিরামিষ গ্রহণ। তারপর একই লাল শালু জড়িয়ে হাঁক ‘‘দেবের দেব মহাদেব…”
শান্তিজল ছিটিয়ে গৃহস্থের উঠোনে সন্ন্যাসীরা ‘দেলপাট’, ‘পাটঠাকুর’, ‘বাণপাট” বা ‘বেলপাট’ নামান। বেলকাঠ বা নিমকাঠে তৈরি বেলপাটে শিবের মূর্তি, ত্রিশূল, শঙ্খ, চক্র। চৈত্রে মূলত সোম, শনি, অমাবস্যায় পুজো শুরু। ধুতরা, জবা, অপরাজিতাই ফুল । গৃহিণীদের তেল, সিঁদুর দিয়ে বেলকাঠ পুজোর শেষে শিব, পার্বতী, কালী, নন্দী, ভৃঙ্গি সাজা সন্ন্যাসীদের নাচ শুরু। বাণকাঠ থেকে ফুল উঠোনে পড়লে সৌভাগ্যের প্রতীক।
সংক্রান্তির আগের দিন নীলষষ্ঠীর উপোস। রাত হাজরার। শিব তপস্যার চূড়ান্ত মাহেন্দ্রক্ষণ। সে রাতে মেয়েরা চুল ছাড়লে আত্মা তাকে ধরে। ‘ভর ওঠা’ সন্ন্যাসী শ্মশান থেকে মানুষের খুলি সংগ্রহ করে। পার্বতীকে ঘরে রেখে শিব কালী, নন্দী, ভৃঙ্গীর সঙ্গে খুলি নিয়ে যায় ‘শ্মশান নিমন্ত্রণে’। কালীর সঙ্গে বারো ভূতের পূজো। উপাচারে ভাং পাতা, নিম পাতা, চালভাজা, ডালভাজা, ধুতরোর বীজ, পাতা ইত্যাদি। মালসা ভাসানোর সময় ‘বালা’কে অন্যান্যরা ধরে রাখেন, পাছে ভূত টানে। অন্ধকারে মড়ার খুলি হাতে সন্ন্যাসীদের উন্মত্ত ছোটাছুটি…
পরের দিন চড়ক। চড়ক গাছের শীর্ষবিন্দুর ‘বাণ’এর নজর। জিভে লোহার শলাকা ফুটিয়ে বাণ-সন্ন্যাস, পিঠে বেত ফুঁড়ে বেত-সন্ন্যাস, মুখোশ পরে অস্ত্র নিয়ে নাচ, চড়কগাছকে কেন্দ্র করে পিঠে বড়শি গেঁথে চক্রাকারে ঘোরা, বাতাসা ছুড়ে দেওয়া… । একবার বড়শি নিলে অন্তত পরপর তিন বছর নিতেই হবে। বৈশাখে কাদোখেলা মৎস্যমুখ শেষে মণিবন্ধের লাল শালু ছিঁড়লে আসে ঘরে ফেরার দিন।
লোকসংস্কৃতি ফোকাসের কেন্দ্রে এলেও জাতে ওঠার প্রশ্নে চড়ক উচ্চম্মন্যতার হেজিমনি ভাঙতে পেরেছে? আচারের মান্যতা কমে আসা আবহে ঘরে লিকুইড সিঁদুর। গুড়ো সিঁদুরও সন্ন্যাসীদের রাখতে হয়। দানে আসে পেঁয়াজ, রসুনও। ‘অনেকেই ভাবে চড়কের আয়ে আমাদের সারাবছরের হাঁড়ি চড়ে। আমরা তো সকলেরই মঙ্গল কামনা করি’ গলা ধরে আসে রমেশের।
বিজলি বাতি এলেও চড়কমেলা মডার্ন নয়। বছরভর নানান মেলা, খেলা উৎসবে সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার নিনাদে কান পাতা দায়। চড়কের শুভেচ্ছাবার্তার ব্যানারে নেতা-মন্ত্রীর মুখ কেউ দেখেছে? এক মাসের ব্রতের দিন এখন পাঁচদিনেও অনেক জায়গায় ঠেকেছে। ক্ষীণ হচ্ছে দল। দল ভাঙানোর কোপাকুপি নেই। নিউ ইয়ারের গটগটে বাংলায় ‘পয়লা বোশেখ’ মলিন। এই প্রজন্মের ক’জন চড়ক দেখেছে? পদ্ধতি প্রকরণের সমালোচনা শুধু চড়কের, আর কারও নেই? সাব অল্টার্ন চড়ক পর্যটনের অভিমুখ হলে বিশুদ্ধবাদী আভিজাত্যের জাতকুলে ব্ল্যাক স্পট পড়ে? নিভু সন্ধ্যায় নাটাই ব্রতের মতো চড়কও ধূসর আবছায়ায়। প্রচারের ব্লিসকিৎজে অর্ধেক ভারতকে গঙ্গাস্নান করিয়ে ট্যাঁক ভরাল উত্তরপ্রদেশ। আমরা মেতে হাইপের সমালোচনায়।