কল্যাণময় দাস
পৃথিবীর তামাম সংবাদমাধ্যমে সবসময় ছোট-বড় নানা রকম হিংসার ছবি দেখা যায়। দেখতে দেখতে মনে হয়, মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই বোধহয় হিংস্র। পাড়া-মহল্লার বাঁশ-বাখারির ডাং থেকে শুরু করে নিউক্লিয়ার বম্ব- হিংসার অস্ত্রের চিত্রটা ভয়ানক। কোথাও জমি দখলের জন্য সন্ত্রাস তো কোথাও দেশ দখলের জন্য যুদ্ধ। কোথাও মেয়ে দখল তো কোথাও পুরুষ দখল। চারদিকে জল-জঙ্গল-জমি দখলের দবদবা।
ক্রনি-ক্যাপিটালিজমে আর রাজনীতির ‘দাদা’ ইজমের কলার তুলে এগোচ্ছে রাষ্ট্র। কোথায় যাবে নাগরিক! কীভাবে এর থেকে নিস্তার পাবে পৃথিবী? কারও কাছে এর বিজ্ঞানসম্মত উত্তর নেই, নেই দর্শনগত উত্তরও। থাকলেই বা শুনছে কে?
আমাদের সামনে কোন ‘ক্ষুধাহরণের সুধাক্ষরণের উদাহরণ’ নেই, শুধু চারপাশে ‘সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ।’ একে অন্যকে ঘেন্না করতে শেখাচ্ছে অদৃশ্য শয়তানরা। আমরা সেই ঘেন্না বহন করে নিয়ে চলেছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। এর শেষ নেই। আচ্ছা বলুন তো, ঘৃণাই যদি শেষ আশ্রয় হবে আমাদের, তবে এত কবি, এত কবিতা, এত প্রাবন্ধিক, এত প্রবন্ধ, এত ঔপন্যাসিক, এত উপন্যাস, এত গীতিকার, এত গান– এসবের কী দরকার?
মানুষ এখন সম্পদের কাছে, ক্ষমতার কাছে, লোভের কাছে এতটাই নতজানু, এতটাই কশেরুকাহীন যে, লোভ, পাপ, অন্যায়, অবিচার ইত্যাদি শব্দগুলো তাদের ডিকশনারি থেকে বাদ হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে এই যে অন্ধ হিংসা, তার ভেতর জন্ম নিচ্ছে নিজেকেই খুন করার প্রক্রিয়া। জন্ম নিচ্ছে ভাষা থেকে শুরু করে সমগ্র অস্তিত্ব বিপন্ন করার অভিপ্রায়। জন্ম নিচ্ছে একটা প্রবল বর্ণময় সৃজন-ঐশ্বর্যে ভরা ভাষাগোষ্ঠীকে শেষ করে দেওয়ার চিন্তন।
এই অবস্থার মধ্যে মানবিক সমাজ ব্যবস্থা প্রত্যাশা করেন- এমন মানুষ কিছু আছেন। হয়তো তাঁরা সংখ্যায় কম। কিন্তু আছেন। তবে তাঁরা একঘরে। যাঁরা প্রত্যাশা করেন ‘শত ফুল বিকশিত হোক/ যত আগাছা নির্মূল হোক।’ তাঁদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অন্ধকারে। যাঁরা বিশ্বাস করেন ‘মানুষ মানুষের জন্যে/ জীবন জীবনের জন্য…’, তাঁরা রাজনীতির রক্তচোখের সামনে।
অস্ত্রনির্ভর বাণিজ্য আর ভূ-রাজনীতির আধিপত্য আজ শুধু রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অলিগলিতে টুকরো টুকরো ক্ষমতাপ্রিয় প্রভুভক্তদের মধ্যেও। হিংস্রতা এখন একটা দাবাং পলিসি। যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই এই দাবাং দৈত্যরা দাঁড়িয়ে আছে। দেশে-বিদেশে চরমতম নাশকতা থেকে শুরু করে একদম পারিবারিক স্তরে ঠারেঠোরে হিংসা এবং অবিশ্বস্ততা এতটাই প্রমত্ত যে, এ থেকে মানুষের নিস্তার পাওয়ার সুযোগ খুব কম। এসবের অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
তবে একটা বিষয় একদম নিশ্চিত যে, ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে যে আগুন, প্রবেশ করেছে যে চোরাগোপ্তা ফুসলানি, অনুপ্রবেশ করেছে যেসব ভেদবুদ্ধি, ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি, তাতে ক্রমশ অস্থিরতা বাড়বে বই কমবে না।
কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হল, হচ্ছে। শুধুমাত্র হাহাকার ছাড়া আমাদের মতো লিখিয়েদের আর কী-ই বা করার আছে! সমস্ত আশার বাণীকে যেখানে থেকে থেকে মনে হয় অসার বাণী। কেননা, আমরা এতবার ঠকেছি রাষ্ট্রযন্ত্রের ঠোক্করে, এতবার ছিন্নমূল হয়ে ছন্নছাড়া হয়েছি যে, কোথাও আশার আলো দেখি না। তবু কি আমাদের সচেতনতা ফিরেছে? কয়েক কোটি টাকার প্রশ্ন সেটা। মাঝে মাঝে মনে হয় ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে’ নিজেদের বিপন্ন করে তোলার এই যে অন্ধকার বাসনা- এর থেকে কি মানুষের রেহাই নেই!
(লেখক নাট্যশিল্পী। কোচবিহারের বাসিন্দা)