গোয়ালে ফিরে আসুক গোয়ালির গান

গোয়ালে ফিরে আসুক গোয়ালির গান

শিক্ষা
Spread the love


মনোমিতা চক্রবর্তী

‘আরে শোনো সবে ভক্তি ভরে করি নিবেদন
বলি ঘরে দু’চার কথা শোনো দিয়া মন।
গোবর ফেলাইতে মাগো, যেবা করে ঘিন ঘিন
তার পালের গোরু–বাছুর টেকে আড়াই দিন।’

যাঁরা পুরোনো দিনের, তাঁদের কারও কারও এই গানের কথা মনে থাকতে পারে। এই গান ‘গোয়ালির গান’ নামে পরিচিত ছিল। বিকেলের দিকে কিংবা সন্ধ্যার দিকে গোয়ালে বসে এই গান গাওয়ার চল ছিল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গোয়ালে গোরু বাঁধা অবস্থায়, তেল প্রদীপ জ্বালিয়ে গোয়ালিরা গান গাইতেন। তা কখনও প্রার্থনামূলক, কখনও নীতিকথামূলক কখনও বা তাতে কৃষিজীবনের কথা, আবার তাতে কখনও ভালোবাসার স্মৃতিচারণ হত। কতই না স্মৃতি তাতে জড়িয়ে থাকত।

‘দুপুরবেলা করে যেবা গোবরও ফেলায়
ধনুষ্টংকার রোগ ধরে গোরু মারা যায়।
সকালবেলা করে মাগো গোবরও ফেলায়
তার পালে গোরক্ষনাথ বারো মাস রয়।’

এখানে গোরক্ষনাথকে সন্তুষ্ট করে তাঁর আশীর্বাদ পাওয়ার কথা গানের মাধ্যমে পেশ করা হয়েছে। গোয়ালির গানে গোরু এভাবে ছত্রে ছত্রে ধরা পড়ত। গোয়ালির এই গানগুলো গ্রামীণ মানুষের বিনোদনেরও মাধ্যম যেমন ছিল তেমনি যিনি গোয়ালে বসে গান গাইতেন তাঁরও রুটিরুজির মাধ্যম ছিল। গান শেষ করার পর গৃহকর্ত্রীরা দক্ষিণাস্বরপ তাঁকে ধান অথবা চালের সঙ্গে কিছু কাঁচা সবজি ও টাকা দিতেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ এই গান প্রায় অবলুপ্তির পথে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন আর এই গানের কথা জানে না। সন্ধ্যায় গোয়ালে বসে কেউ এই গান না গাওয়ায় এর কথাগুলি মনে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর এই গানকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে বর্তে রাখতে সেভাবে কোনও উদ্যোগও হয়তো নেওয়া হয়নি।

ভাদর কাটানি উত্তরের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। ভাদ্র মাস শুরু হওয়ার আগে অর্থাৎ শ্রাবণ মাস শেষ হওয়ার আগেই স্বামীর মঙ্গলকামনায় রাজবংশী সম্প্রদায়ভুক্ত নববধূরা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে চলে আসতেন। এই উৎসব পালনের জন্য তাঁদের মধ্যে রীতিমতো সাজোসাজো রব পড়ে যেত। গোয়ালির গানের মতো এই উৎসবও এখন ফিকে। রাজবংশীদের মধ্যেই এখন সেভাবে আর এই উৎসব পালনের ব্যস্ততা দেখা যায় না।

বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাঙালির অবমাননা বর্তমানে অন্যতম চর্চিত বিষয়। স্রেফ বাংলা ভাষায় কথা বলার ‘অপরাধ’–এ যেভাবে বাঙালিদের অন্য রাজ্যে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে তা কোনওমতেই মেনে নেওয়া যায় না। হয়তো এই প্রেক্ষিতেই আমাদের আরও বেশি করে নিজেদের শিকড়কে শক্তপোক্ত করাটা প্রয়োজন। আর শিকড় শক্তপোক্ত করতে হলে নিজেদের ঐতিহ্যকে কোনওমতেই হারিয়ে দিতে দেওয়া চলবে না। আর তাই গোয়ালির গান হোক বা ভাদর কাটানি, তাদের ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখাটাই আমাদের মূল লক্ষ্য হোক। ৫জি স্পিড ইন্টারনেট বা চটুল রিলস যেন সেই লক্ষ্যে কখনোই আমাদের সামনে কোনও বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।

‘মামা ভাগনা গোরু যেবা বেচায়া খায়
জনমে জনমে গিরি হাভাতিয়া হয়।
মামা ভাগনা গোরু যেবা যার ঘরে রয়
ধনে বংশে গোরুর পাল বৃদ্ধি হয়া যায়।’

উত্তরের গ্রামাঞ্চলের গোয়ালগুলি থেকে আবারও এই গান শোনা যাবে। হয়তো এই মুহূর্তে এটা স্বপ্ন বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের ভালো রাখতে হলে সেইমতো ব্যবস্থা নিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করাটা আমাদেরই দায়িত্ব।
লেখক শিক্ষক ও সাহিত্যিক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *