- অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
“নমস্কার বন্ধুরা, কেমন আছেন? আমি মাধবী আপনাদের স্বাগত জানাই প্রবাসের জার্নাল চ্যানেলে…”
হাসিখুশি গোলগাল লাবণ্যময়ী মুখখানা ভাসে হাতের মোবাইল স্ক্রিনে। হেডফোনের মধ্যে এক সুরেলা গলা ভারী মধুর ভঙ্গিমায় হেঁশেলের খুঁটিনাটি বর্ণনার ফাঁকেফাঁকেই সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া শহরের তাপমাত্রা জীবনযাপন বাজারঘাট হালকা করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। একের পর এক ছোট্ট ছোট্ট ভিডিওয় নিপুণ হাতে বাজার-দোকান, মাছ কাটা, রান্না করা, ডাস্টিং বা বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়া, পড়ানো নানা কিছু শেখানোর সঙ্গেই বাগানে লংকা ফলানো, হাজার সামাজিকতা, উৎসব পালন, ঘর সাজানো, নিজের স্কিন কেয়ার, পুজোআচ্চা যাবতীয় কিছু সামলানোর খুঁটিনাটি। এইগুলোই এই দুনিয়ার ভাষায় “কনটেন্ট”। যার দর্শক লক্ষ লক্ষ এবং সারা পৃথিবীব্যাপী তা ছড়িয়ে। এক নিটোল গৃহস্থালির গল্প, এক প্রবাসী মেয়ের দূরদেশে গিয়ে নিজের একাকিত্ব আর একঘেয়ে সাংসারিক কাজের জগৎটুকু, মন কেমন আর উচ্ছ্বাসটুকু ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ। বিদেশে উঁচু পদে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীটির চেয়ে এই কনটেন্টের জোরেই তার উপার্জন বা খ্যাতি কিছু কম নয় বলে শোনা যায়। সে ভাগ করে নিচ্ছে আসলে তার প্রতিদিনের শ্রম, গৃহশ্রম বলে যা আসলে কোনও শ্রমের তালিকাভুক্তই নয় আদপে কোথাও। তাকেই সারা পৃথিবীর সামনে সবার কাছে পৌঁছিয়ে দিয়ে এই যে অর্থ উপার্জনের পথ, এ এক নতুন আলোচনার পরিসর খুলে দেয়। কত উচ্চশিক্ষিত গৃহবধূকে আজীবন সংসারে সবটুকু দিয়েও হীনম্মন্যতার সুরে বলতে শুনি, “আমি কিছু করি না, জাস্ট হাউসওয়াইফ”। তাহলে এই কাজগুলো আসলে ততটাও তুচ্ছ নয়, কী বলেন দর্শক বন্ধুরা?
আচ্ছা বিদেশের গেরস্থালি ছেড়ে দিলাম, সে দেশগুলিতে পুরুষদের ঘরের কাজে যথেষ্টই অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে আশপাশের শহর গ্রাম মফসসলের জীবনে বেঁচে থাকা, ঘর গেরস্থালির কাজে রাতদিন পেষাই হয়ে চলা মেয়েদের জীবনের নিত্যকার কাজগুলোকে সারাজীবন দুর ছাই করে চলা সমাজ কেন উন্মুখ হয়ে ভিডিওয় “কনটেন্ট” হিসেবে দেখে? শুধুই কি অন্যের সংসারে উঁকি মারার “ভয়ারিস্টিক প্লেজার” পেতে? নাকি এই ছবিগুলো একদলের জন্য কোথাও একটা অনাবিষ্কৃত জগৎ আর অন্যদলের কাছে নিজের সঙ্গে একাত্মতার পৃথিবী?
তাই লক্ষ ‘ভিউয়ারে’র একজন হয়ে চুপিসারে সেই সাধারণ মেয়েটির সংসারশ্রমটা দেখে নিয়েই ঘরের মেয়ে বা মা-কে বলাই যায়, “সারাদিন বাড়ি বসে কী করলে! বাইরে তো বেরোতে হয় না রোজগার করতে, কী বুঝবে!”
সামাজিক মাধ্যমে মেয়েদের অর্থ উপার্জনের নানা কীর্তিকলাপের সবটুকুই অবশ্য সমর্থনযোগ্য নয়, বরং কিছু বিষয় অত্যন্ত ন্যক্কারজনকও বটে। তবে সমাজের সব স্তরে বাস্তব দুনিয়াতেও এত কলুষ ছড়িয়ে যে এই মুহূর্তে সেই অংশটুকু বাদ দিয়েই না হয় আলোচনা করি। পিছল পথ জেনেশুনেই যারা পার হয়, তারা সে পথের কাদা বা পা হড়কে গিয়ে চোটজখম মেনে নিতে নিশ্চয় প্রস্তুত থাকে।
রান্না করা বা ঘরসংসারে নিপুণভাবে সৌন্দর্য বজায় রাখার যে শ্রম সম্পূর্ণভাবে মেয়েদের জন্যই সমাজে স্থিরীকৃত বলে ধরে নেওয়া হয়, তাকেও বিপণনযোগ্য করে তোলার এই ভাবনা প্রথম কি মেয়েদের মাথাতেই এসেছিল নাকি এও আরেকটি কৌশল তাকে শোষণের, এ প্রশ্নটিও মাথাচাড়া দেয়। সমীক্ষায় নেমে পুরোনো ছাত্রী সুস্মিতাকে পেয়ে যাই “কনটেন্ট ক্রিয়েটরের” ভূমিকায়। বিয়ের পর বেঙ্গালুরু প্রবাসী মেয়ে ছোট বাচ্চা আর ঘরকন্নার কাজ সামলানো নিয়ে ভিডিও বানায়। বাড়ির পুরুষটি সাহায্য করেন। বেসরকারি সাধারণ চাকরিতে পরিবারে কিছু অতিরিক্ত উপার্জন এনে দিতে পেরে সুস্মিতা আত্মবিশ্বাস পায়। “ম্যাম আমি তো পড়া শেষ করিনি, অত ভালো ইংরেজি জানি না। চাকরি পাওয়া সম্ভব না। যদি টাকা জমিয়ে কিছু করতে পারি! সবাই তো বলত পরের বাড়ি রেঁধে খেতে হবে, তাই-ই খাচ্ছি, অন্যভাবে। বাড়িটা নিজের মনে হয় এখন ম্যাম।”
ছোটবেলার বন্ধুর বোন মিলি জানায়, “আমি তো সারাজীবন ঘরের এইসব ফালতু কাজগুলোই করলাম। আর শুনলাম কিছুই পারি না। কুকুর, বেড়াল ভালোবাসি। অনেকগুলো আছে। তাই বর বলল এইসব ভিডিও করে টাকা রোজগার করছে অনেকে, তুমিও চেষ্টা করো। আমার ইচ্ছে করে না এসব করতে। কত টাকা পাই তাও জানি না। সব আমার বাড়ির লোকেই সামলায়!’’
আবার সত্তরোর্ধ্ব স্বামী-স্ত্রীর জনপ্রিয় চ্যানেলটিতে ভারী মধুর স্মৃতিচারণ, পুরোনো রান্নাবান্না, খুনশুটি, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে গল্পগুজবের মুহূর্ত। সারাজীবন পাড়াপ্রতিবেশীদের নানা পরামর্শ দেওয়া, ঘরের কাজে সাহায্য করা, পুজোআচ্চায় হাত বাড়ানো মাসিমা কখনও ভাবেননি তাঁর এই কাজগুলোর কোনও অর্থমূল্যও কখনও হতে পারে। আজ তাঁর মিলিয়ন অনুগামীর সুবাদে যা উপার্জন করেন জীবনে কখনও ভাবেননি। “এই বয়সে এত পরিশ্রম করেন?” “কোনও পরিশ্রম মনে হয় না গো। কত্তা তো সারাজীবন বাইরে চাকরি করলেন। এর চেয়ে কত বেশি কাজ করেছি। তিনি অবশ্য মানেন সেটা, বলেন আমি না থাকলে ছেলেমেয়ে মানুষ হত না।” অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর পেনশনের চেয়ে তিনগুণ আয় তাঁর এখন, গর্বিত মাসিমা জানান। “এটা ওই মৌখিক স্বীকৃতির চেয়ে বেশি আনন্দের, সত্যিই মানতে হবে। সবাই এখন সেলেব্রিটির চোখে দেখে গো, এই ঘরের কাজের জন্যই!”
তাহলে গৃহশ্রমের মূল্য শুধুই বাজারনির্ভর? অবচেতনে এই মান্যতা সমাজ আসলে দিচ্ছে যে কাজগুলি, ততটা সহজ বা সাধারণ নয়! নিছক ঘরোয়া কাজের ভিডিও দেখার আগ্রহ বা বর্ধিত দর্শককুল কি সেকথাই বলে না? মেয়েদের কি তাহলে ঘুরপথে নিজের কাজের শ্রমের মূল্য এভাবে আদায় করতে হবে?
কেন্দ্রীয় সরকারকৃত একটি সমীক্ষার পরিসংখ্যান বলে পুরুষদের মধ্যে মাত্র উনত্রিশ শতাংশ যেখানে পারিশ্রমিক-বিহীন গৃহকর্মে সময় ব্যয় করে থাকেন, একই বয়সের মহিলাদের বিরানব্বই শতাংশ সেই ধরনের কাজে সময় ব্যয় করেন। মল্লিকাদি, কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছিলেন সেই কবে,
“আপনি বলুন মার্কস শ্রম কাকে বলে! / গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে/মেয়েগুলি শুধু ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে?”
আবারও একটা আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে নারীর জন্য নির্ধারিত শ্রমের সংজ্ঞা না হয় নতুন করে নির্মাণের পক্ষে দাঁড়াই আমরা! যতক্ষণ এই গৃহশ্রম শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য নির্ধারিত থাকবে তা এভাবেই তাচ্ছিল্যের ও অস্বীকৃত রয়ে যাবে। তাই বোধয় এই কাজগুলিরও এবার আবশ্যিকভাবে লিঙ্গনিরপেক্ষ হওয়া খুব প্রয়োজন। বহু উন্নত দেশেই রীতিমতো বিদ্যালয় স্তর থেকে পাঠক্রমভুক্ত করে শেখানো হয় রান্না বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ, স্কিল ডেভেলপমেন্টের অঙ্গ হিসেবেই। প্রয়োজনে হাতেকলমে থাকুক না এক-দুটি ঘরের কাজের অংশ পাঠক্রমভুক্ত হয়ে। ভাষাশিক্ষা যেমন বাধ্যতামূলক, হাতেকলমে নিজের কাজগুলি শেখা কেন নয়? নয়তো ঘরে ঘরে অধিকাংশ বাড়িতেই পুত্রসন্তানটি জানবে এসব কাজ মেয়েদের। মেয়েরা জানবে এগুলো তো শিখতেই হবে। আর সমাজ বানাবে গৃহলক্ষ্মী তকমার আড়ালে গৃহশ্রমকে ঢেকে রাখার রঙিন মোড়ক। লিঙ্গনির্বিশেষে বাধ্যতামূলকভাবে সব কাজ শিখতে হলে হয়তো একদিন ঘরের কাজ যেমন আলাদা করে মেয়েদের কাজ হবে না, সে কাজে ব্যস্ত মেয়েটিকেও সহকর্মী বলে মনে হবে।
The publish গৃহলক্ষ্মী অথবা গৃহশ্রমিক? appeared first on Uttarbanga Sambad.