গন্ধর্বরাজ

গন্ধর্বরাজ

ভিডিও/VIDEO
Spread the love


  • সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

 

মহাসমুদ্রকে কি মাপা যায়? উত্তমকুমারও ঠিক সেইরকম এক মহাসাগর যাঁকে শব্দসংখ্যায় কী লেখার পাতায় ধরা যায় না! তবু…

উত্তমকুমারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যে কবে থেকে তা আমার নিজেরও মনে নেই! এই সম্পর্কের সুতো আমার বাবা সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। শুনছি, বাবার গোড়ার দিকের সিনেমা ‘জীবনতৃষ্ণা’র নব্য নায়ক উত্তমকুমার দুগ্ধপোষ্য শিশু আমাকে কোলে নিয়ে নবীন লেখক আশুতোষ ও নতুন পরিচালক অসিত সেনের সঙ্গে প্রিমিয়ার শো-তে অন্ধকার হলে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখেছিলেন! সেই থেকে শুরু। বয়সে ছ’বছরের বড় সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উত্তমকুমারের ‘দাদা’, উত্তমকুমার তাঁর ছোটভাই ‘উত্তম’ এবং উভয়তই ‘তুমি’। এই দাদা-ভাই সম্পর্ক পারস্পরিক পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে আজীবন ছিল।

    স্বভাবতই বাবার সুবাদে হেমন্ত কাকুর মতোই উত্তমকুমারও আমার পিতৃপ্রতিম! ডাকতামও ‘কাকু’ বলে! বাবার সমবয়সি ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আমি বরাবরই ‘বাবার মতো’ ভাবলেও এবং সেই চোখে দেখলেও, ছ’বছরের ছোট বাবার এই অনুজপ্রতিম ভাই উত্তমকুমারকে আমি কখনও সেই আসনে বসাতে পারিনি! ‘কাকু’ বললেও আপামর নারীর মতো তিনিও আমার সারা জীবনের ক্রাশ– আমার হার্টথ্রব– সেই আমার কুঁড়িফোটা চোদ্দো বছর বয়স থেকে! জানি, সামাজিক সম্পর্কের নিরিখে আমার এই উত্তম-প্রেম চূড়ান্ত অসামাজিক, অবৈধ ও নিষিদ্ধ হলেও তাঁর অসামান্য ক্যারিশমা, গ্ল্যামার এবং সর্বোপরি অভিনয়ের চুম্বক সম্মোহনে আমি নিরুপায়! আমার এই গোপন কথা তিনি স্বয়ং জানতেন! জানতেন আমার বেণু আন্টি সুপ্রিয়া দেবীও! তিনি তো হেসে কুটিপাটি হয়ে আদর করে আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকি দিয়ে উত্তমকাকুকে বলে দিয়েছিলেন! আর উত্তমকুমার তাঁর কন্যাসমা ‘মেরা বুলবুলের’ এই কীর্তিতে লজ্জায় বড়ই অপ্রতিভ হতেন! হ্যাঁ, তিনি আমাকে আমার ডাকনামে ‘মেরা বুলবুল’ বলে ডাকতেন। এক রাতে তাঁদের ‘ময়রা স্ট্রিট’-এর বাড়ির পার্টিতে ঘুমিয়ে পড়ায় তিনি নিজে কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁদের বিশাল বেডরুমের বিরাট খাটে শুইয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন- ‘মেরা বুলবুল সো রহা হ্যায়/শোর অউর গুল না মচাও’– যেটি তাঁর ওই রাতের স্বাক্ষরযুক্ত অটোগ্রাফ হিসেবে আমার পরম সম্পদ হয়ে আছে! বয়স তখন আমার কুঁড়িফোটা সদ্য চোদ্দো! তখন থেকেই তাঁর ‘মেরা বুলবুল’ তাঁর জন্য ফিদা! যা আজও এতটুকু কমেনি, বরং বেড়েছে!

          এবার খুব সংক্ষেপে দুটি উত্তম-ঘটনা বলি… এক পয়লা বৈশাখের ঝকঝকে সকালে সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে আমাদের প্রতাপাদিত্য রোডের ‘লালবাড়ি’তে তিনি এসেছিলেন বাবার বৃহৎ কলেবর উপন্যাসের বিখ্যাত বই ‘কাল, তুমি আলেয়া’র ফিল্ম রাইট ‘কেড়ে’ নিতে! কারণ সাহিত্যিক কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না! স্বয়ং উত্তমকুমারকে তিনি বহুবার ফিরিয়েছেন– ‘এই জটিল দার্শনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস সিনেমা হয় না’ বারবার বলে। কিন্তু তিনিও ছায়াছবির একচ্ছত্র সম্রাট উত্তমকুমার! রীতিমতো হুমকি দিয়ে সেই পয়লা বৈশাখের ছুটির সকালে প্রখর দিনের আলোয় সকলের চোখের ওপর দিয়ে ঢুকলেন সাহিত্যিকের বাড়িতে! আর যায় কোথায়! মুহূর্তে তুমুল ‘গুরুগুরু’ গর্জনে সমুদ্রের ঢেউ হয়ে দরজায় আছড়ে পড়ল বিশাল জনতা! তাদের ধাক্কায় থরথরিয়ে উঠল পুরোনো বাড়ি! সাহিত্যিক তখন আকুল হয়ে অনুরোধ করছেন, ‘উত্তম! আজ তুমি যাও, পরে এ নিয়ে তোমার বাড়িতে কথা হবে!’ আর উত্তমকুমার তখন আরও গ্যাঁট হয়ে সোফায় বসে মিটিমিটি হাসছেন, তাঁর ভুবন ভোলানো মারাত্মক হাসি- ‘‘আর কোনও কথা হবে না! তুমি আজই আমাকে ‘কাল, তুমি আলেয়া’র ফিল্ম রাইট দেবে। নয়তো আমি এখান থেকে নড়ব না।’’ তারপর সকাতরে- ‘তাহলে লেখো কেন এমন বই যা আমাকে সমানে হন্ট করে মারছে! খেতে দিচ্ছে না, ঘুমোতে দিচ্ছে না, এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে দিচ্ছে না!’… বাড়ি ভাঙার ভয়ে নয়! নিখাদ শিল্পীর এই আগ্রাসী ক্ষুধার কাছে হার মেনে শেষে সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সেই দিনই দিয়েছিলেন তাঁর ‘কাল, তুমি আলেয়ার ফিল্ম রাইট।’

  পরের ঘটনা আমার বিয়ের দিন। –‘রাতে মেয়েজামাই নিয়ে আমরা কিন্তু লাস্ট ব্যাচে একসঙ্গে বসে খাব দাদা! আমার আর বেণুর জন্যে  অপেক্ষা কোরো!’ বলেছিলেন উত্তমকুমার। সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে ইচ্ছে করেই এলেনও বেশি রাতে–১২টা নাগাদ! কিন্তু অত রাতেও যেন মাটি ফুঁড়ে পিলপিল করে মানুষ উঠে আসতে লাগল! গুরুকে দেখার উচ্ছ্বাসে তাদের প্রবল ধাক্কাধাক্কিতে মুহূর্তে মড়মড় করে ভেঙে পড়ল প্যান্ডেল! হুড়মুড়িয়ে ভক্তরা ঢুকতে লাগল বাঁধভাঙা স্রোতের মতো! ভীতসন্ত্রস্ত উত্তমকুমার বেণু আন্টিকে নিয়ে দৌড়ে এককোণে লুকিয়ে বাবাকে কাতর স্বরে বললেন, ‘শিগগির আমাদের এখান থেকে বেরোনোর ব্যবস্থা করো দাদা! নয়তো সব পণ্ড হয়ে যাবে!’ বিয়ে হচ্ছিল বসুশ্রী সিনেমা হলের পেছনে বিরাট জায়গার ওপর প্যান্ডেল বেঁধে; ভবানীপুর থানা এলাকায়। তখন বাবা ভবানীপুর থানার ওসি-কে ফোন করে থানা থেকে মস্ত বড় কালো কয়েদি-ভ্যান আনিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে তাঁদের তাতে উঠিয়ে পাচার করে দেওয়া হল! বিয়েবাড়ির সামনের গেটে তাঁদের ধবধবে সাদা অ্যাম্বাসাডরটা আটকে রেখেছে ভক্তবৃন্দ! ‘গুরু’ বেরিয়ে এলেই ধরবে! তখন পুলিশের কালো রাক্ষুসে কয়েদি-ভ্যানে করে  ফেরত চলেছেন ভাইঝির বিয়েতে খেতে আসা অভুক্ত উত্তম-সুপ্রিয়া। যেতে যেতে প্রিজন ভ্যানের জালের জানলার ফাঁক দিয়ে কাতর স্বরে বাবাকে ডেকে বলছেন, ‘দাদা, আমাদের কিন্তু খাওয়া হয়নি! বাড়িতেও কিছু নেই!’ বাবা তাঁদের গাড়ির ড্রাইভার ন্যাপাদার হাতে তার প্যাকেট আর উত্তমকাকু-বেণু আন্টির জন্যে ছ’বাটির দুই বিরাট স্পেশাল টিফিন-ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন…

           এবার বলছি আমার নিজের চোখে দেখা অভিনেতা উত্তমকুমারের ডেডিকেশনের একটি ঘটনা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘নগর দর্পণে’ সিনেমার শুটিং চলছে; খুবই অন্তরঙ্গ বেডরুম সিন। স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় উত্তমকুমার ও কাবেরী বসু। শট দিলেন। এক শটে ‘ওকে’ করলেন পরিচালক দিলীপ মুখার্জি। অতি জটিল দৃশ্যের তেমনি কঠিন শট! ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য নিজের মেকআপ রুমে যেতে যেতে উত্তমকুমার সাহিত্যিককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী দাদা, কেমন?’ সাহিত্যিক দাদার সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল, ‘ভালোই তো!’ …ব্যাস, মাথায় উঠল বিশ্রাম! প্রখর ইঙ্গিতজ্ঞ জাত অভিনেতা ফের সেট-এ ঢুকে ডিরেক্টর দিলীপ মুখার্জিকে হাঁক দিলেন, ‘হয়নি! আবার শটটা নে!’ এই করে পরপর ১৯ কি ২১তম শট দিয়ে থামলেন! এবার আর পরিচালকের ‘ওকে’ বা ‘প্যাকআপ’-বলার অপেক্ষা না করে প্রবল আত্মবিশ্বাসে আর পরিতৃপ্তিতে সেট ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ঘামে জবজবে মুখে কাহিনীকারের সামনে এসে চুপচাপ দাঁড়ালেন শুধু! তাঁকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিলেন আশুতোষ! অসীম তৃপ্তিতে তখন দুজনেরই চোখে জল!

এবার আসি উত্তম-চরিতের অন্তিম দৃশ্যে– ১৯৮০, ২৪শে জুলাই নয়, ২৫শে জুলাইয়ের পাঁশুটে কান্নাভেজা সকাল! দাবানল হয়ে মর্মান্তিক খবরটা রাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল! ঘরে ঘরে কান্নার করুণ রোল! আকাশে শোক, বাতাসে শোক, প্রকৃতির কান্নাভেজা বৃষ্টির মাটি থেকে শোকের ভাপ উঠছে! তারই মধ্যে আমরা বাপ-মেয়ে চললাম অন্তিম উত্তম-দর্শনে। ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, কপালে শ্বেতচন্দনের অলকাতিলকা, গলায় শুভ্র জুঁইয়ের গোড়ে মালা, দুধসাদা বরফ-শয্যায় শুয়েছিলেন তিনি!

আমার সাহিত্যিক বাবার থরথরে কাঁপা হাত তাঁর অভিনেতা ছোট ভাইয়ের হিমঠান্ডা কপালে; প্রবল আক্ষেপ নিবিড় বেদনায় ক্রোধ হয়ে বেরোচ্ছিল- ‘আমার থেকে ছ’বছরের ছোট হয়ে ও এইভাবে আগে চলে গেল! এইভাবে আমার থেকে ‘বড়’ হয়ে গেল!’….আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন ১৯২০, ৭ই সেপ্টেম্বর আর অনুজ উত্তমকুমার ১৯২৬, ৩রা সেপ্টেম্বর। তাই প্রত্যেক বছর নিজের জন্মদিনে আমাদের নেমন্তন্ন করার সময় হেসে হেসে বাবাকে বলতেন, ‘আমার জন্মদিন তোমার থেকে চারদিন আগে! দাদা, আমি কিন্তু তোমার চেয়ে চারদিনের বড়!….’

আর তাঁর বড় আদরের ‘মেরা বুলবুল’? সে তখন তার প্রাণপ্রিয় উত্তমপুরুষ গন্ধর্বরাজের  হিমশীতল দুটি পায়ের পাতায় মুখ গুঁজে নিঃশব্দ প্রার্থনায় নিষ্ঠুর বিধাতা ও শোকসন্তপ্ত বিশাল জনতার দরবারে মাথা খুঁড়ে চিৎকার করে মরছে—এঁকে এভাবে শুয়ে থাকতে দিও না! এঁকে ওঠাও! এঁকে তোলো! এঁকে জাগাও! আর তার জন্যে যত পারো ‘শোর অউর গুল মচাও!’

    তার সেই প্রার্থনার চিৎকার সেদিনও কেউ শোনেনি, আজও না! ‌‌তবে না উঠেও দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে তিনি প্রমাণ করে চলেছেন তাঁর লয় নেই, তাঁর ক্ষয় নেই! তিনি মিথ্যে করে দিয়েছেন বিখ্যাত প্রবাদ- ‘দেহপট সনে নট সকলি হারায়’….

একামেবাদ্বিতীয়ম উত্তমপুরুষ সদর্পে আজও ঘোষণা করে চলেছেন – ‘দেহপট সনে নট সকলি হারায় না!’ হারাননি গন্ধর্বরাজ উত্তমকুমার!



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *