দগ্ধ দিন, বসে আছি স্টেশনে শিয়ালদাগামী ট্রেনের অপেক্ষায়। পাশে এসে বসলেন এক বয়স্ক ভিখিরি। সাদা জামা, ময়লা ধুতি। হাতে ছোট, সস্তা অর্গান। গান শুরু করলেন চারপাশটা দেখে নিয়ে। ‘জানি জুঁই মালতী হায়, কত গন্ধ যে ছড়ায়’। সম্ভবত বয়সের কারণে লোকটি গাইছেন কম, বাজাচ্ছেন বেশি। গান শেষে লোকটি চা দোকানির থেকে একটি চা চেয়ে সুরুৎ শব্দে গলা ভেজালেন, ভাসাভাসা কথায় বোঝা যায়, দুজনের অলিখিত বোঝাপড়া আছে। আমিও চলে যাব, ট্রেন এসে পড়েছে, যেতে হবে নানা কাজে-অকাজে, ফিরতে হবে স্থায়ী ঠিকানায়। এই যে সাধারণ জীবন, শম্বুকগতির চলাচল, তার মাঝে হঠাৎ ধরা দেয় আঁধার রাতের একলা পাগল, তারপর হারিয়ে যায়, জীবন আসলে এমন, আবর্তন আর আবর্তন, অনবনমনে হেঁটে চলা, শুরুও নেই শেষও নেই। শুধু কখনো-কখনো রেখা খেলে যায় দিকচক্রবালে, জানিয়ে যায়, ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক’।
কিন্তু কিছুই কি ভেসে যায়? পুরোনোকে নস্যাৎ করে আমরা কি আনন্দমুখর নতুনে প্রবেশ করতে পারি? ব্যক্তিগত দুঃখগুলি কি বছরের শেষ দিনে, স্রেফ ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে যাচ্ছে বলে মুক্তি দেয়? ফিরে আসে না উৎসবমুখরতা, আলোর আতিশয্য চলে গেলে? শেলী তো বলেইছেন আমাদের যত আনন্দগান আসলে তা বেদনানিবিড়। মনে পড়ে কালীকৃষ্ণ গুহর কবিতা :
সময় যায়
বটপাতায়
কী আছে আর
বেদনাভার
বুঝি না মন
কী নির্জন
দিনের শেষ
স্খলিত বেশ
যা আছে দূর
রাতদুপুর
আসে না ফের
শৈশবের
হিমশীতল
প্রকৃত জল
প্রকৃত মেঘ
স্থির আবেগ
আসে যা তা
জটিলতা
পিপাসা আর
অন্ধকার
কবিতাটির নাম দিনযাপন, (২)। দুটি করে লাইনে একটি করে স্তবক, প্রতিটি স্তবক যেন রাত্রি আর দিন, আসছে আর যাচ্ছে। প্রতিটি দিনই যে বেদনার মধ্যে দিয়ে পথ হাঁটা, আরও কিছু জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়া, আরও আরও নিঃসঙ্গতা, সেই পরম সত্যকেই হয়তো এভাবে ছোট ছোট আঁচড়ে ধরেছেন কালীকৃষ্ণ গুহ। শেষে পড়ে আছে : পিপাসা আর অন্ধকার। কিন্তু তারপরেও মানুষ অপেক্ষা করে। হোক না ছিটকাপড়ের জামা, সামান্য এগরোল, এক বিকেলের গ্যাসবেলুন, মানুষ অপেক্ষা করে। সুদিনের। ক্ষণস্থায়ী সুদিনের। জীবনানন্দ দাশের কবিতা সেই অপেক্ষাকে চিহ্নিত করেছে-
তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে
অন্ধকার হ’তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে
যে অনবনমনে চলেছে আজো- তার হৃদয়ের
ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার
বলয়ের নিজ গুণ র’য়ে গেছে ব’লে মনে হয়।
(১৯৪৬-’৪৭)
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকি, বারবার ফিরে আসি। কেন সে অনবনমনে চলে? কারণ সে ছিল অ্যাপ। সে ক্রমে মাথা তুলেছে। শ্রমে, অপমানে, দেশ ছাড়ার দুঃখে তার মাথা হেঁট হয়ে যায়। কেন এল, চেতনার বলয়ের নিজস্ব গুণ? চেতনার বলয় কী? স্ট্রিম অফ কনসাশনেস? একটা সমষ্টিগত শুভচিন্তা, যা সমাজের ঠাসবুনোটটা শেষমেশ ভাঙতে দেয় না? প্রাণ-প্রতিবেশমুখী করে এলআইসি এজেন্ট, সুদখোর, চিটফান্ড করা লোককেও? এই যে আমরা মরে যাইনি, ছাই ঘেঁটে, দু’হাতে পাপের দাগ নিয়েও ফিরে এসেছি তা আসলে আমার ফেরা নয়, জীবনের চক্রাকার আবর্তন। অন্ধ দুর্দশা থেকে স্নিগ্ধ আঁধারে যাত্রা মানে রাত্রির গর্ভ ফেটে ভোরের ইশারা। ‘সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো’।
আদতে কেউ ভালো নেই। কেউ ভালো থাকে না। কেউ কখনও ভালো থাকেনি। প্যালেস্তাইনে যে পিতা কবর দিচ্ছে শিশুকে, হাতে হাতকড়া পরে যাকে মার্কিন মুলুক থেকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে বাড়িতে, বাংলাদেশে-ভারতে যে সংখ্যালঘুর দিন কাটছে অনিরাপদ, স্লিপিং পিলেও ঘুম আসে না যে কর্পোরেটের- তারা কেউ ভালো নেই। ভালো নেই বলেই বিরস দিন বিরল কাজ শুনতে শুনতে নিউটাউনে অফিস থেকে ঝাঁপ দেয় প্রযুক্তি কর্মী। কিন্তু তবু। একটা ‘তবু’ আছে।
তবু দেখা হয়ে যায় গাইয়ে ভিখিরির সঙ্গে। আমমুকুলের ঘ্রাণ তাড়া করে, আমরা ফিরতে চাই শৈশবে। হঠাৎ কালবৈশাখী অবাক করে হাজির হয়, যেন ছোটমামা না বলে চলে এসেছে। আসে নতুন বছর। ক্ষয়ে যাবে তা অচিরেই। ক্ষইয়ে দেবেন নেতারা। যাঁরা চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিয়েছেন। কে টাকা দিল? বাবা দর্জি, মা রাঁধুনির জোগাড়ে, সোনার বালা বেচে টাকা দিয়েছে চাকরি কিনতে। কেন টাকা দেওয়া। কারণ ওরা বুঝেছিল কখনও সমান-সমান লড়াই হবে না। জলের অতল থেকে উঠে আসতে ঘুষ দিতে হবে। তারপর যে-ই একটু অবস্থা ফিরল, যেন যম এল নিতে। কীভাবে শোধ হবে ইএমআই? কী বলব শ্বশুরবাড়িতে, আমি যোগ্য না অযোগ্য? মুখ দেখাব কীভাবে?
মানুষ জানে না। সে যেন সিসিফাস। পাথর বয়ে বেড়ানোই তার নিয়তি। সে শুধু আঁকড়ে ধরতে চেয়ে ক্রমশ তলিয়ে যায় আরও আরও আরও। একটা সমষ্টিগত সদিচ্ছা তাকে ভালোর দিকে নিয়ে যায়, সে হাসে। হাসতে চায়, হাসি মুছে যেতে থাকে।
এবার, এই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সে কি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে? সে কি মর্গে শান্তি খুঁজবে? বেহায়া জীব। বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, দেশ ছাড়তে হচ্ছে, সে যাওয়ার সময় নিয়ে যায় একগোছা চাবি। কেন নেয়? ফেরার বিশ্বাসে। অঞ্জন দত্তর কাঞ্চন গানের সেই নেপালি ছেলেটির মতো সে জানে সে ফিরবেই, আর ক’টা টাকা জমানোর অপেক্ষা শুধু। সে কাঁদে, সে ভেঙে পড়ে, তারাভরা আকাশের নীচে সে এত একা, এত অসহায়, বন্ধুহীন, তবু সে জানে দিন এমন যাচ্ছে ঠিকই, দিন এমন যাবে না চিরকাল।
এটুকুই, এই বিশ্বাসটুকু নিয়েই বাঁচা। অনবনমনে বাঁচা। তারপর একদিন খবর হয়, সমুদ্রে ভাসমান ট্রলারের তেল ফুরিয়ে গিয়েছে, মাঝসমুদ্রেই ডুবে মরতে হল এই রোহিঙ্গা রিফিউজিদের। মরতে হবেই, ভবিতব্য। তবু মৃত্যুর আগেও সে ভীষণভাবে বাঁচতে চেয়েছিল, ভেবেছিল ভিটেয় ফিরবে, অলৌকিক হবে। হয় অলৌকিক, আবার হয়ও না। মাঝখানে সময় যায়। বটপাতায়। রোদের তেজ বাড়ে, আসে হালখাতার দিন। যার চাকরি গেল সে কী করবে? যার ভিটেমাটি গেছে, যাকে গাছে বেঁধে পেটাল সংখ্যাগরিষ্ঠ? সে ঋত্বিক ঘটকের নাগরিকের মতো ঝুঁকি মাথায় বাঁচবে। সে বলবে, যা আসে আসুক, আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না। আমরা ঠান্ডাভাত খাব একথালায়। আমরা ভোর হওয়ার অপেক্ষা করব। আমরা না হয় আরেকটু নীচু তারে বাঁধব জীবন। আহারে জীবন! হলুদ পাতা খসিয়ে হাসবে বটবৃক্ষ, কে যে চালায় এসব পুতুলনাচ! মোবাইল ফোন অন করলেই টেক্সট মেসেজ : শুভ নববর্ষ।