কুম্ভ নিয়ে হরিবংশের কাহিনী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয় 

কুম্ভ নিয়ে হরিবংশের কাহিনী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয় 

শিক্ষা
Spread the love


নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

সংস্কৃত ভাষায় ঘট একটা ক্রিয়াপদ, সেই ক্রিয়াপদ থেকেই ঘটনা, ঘটছে, ঘটমান, ঘটানো, পূর্বঘটিত- এইসব অনন্ত প্রক্রিয়াবাচক শব্দ তৈরি হচ্ছে, অথচ যেই বলবেন-ওরকম ঘটের মতন বসে আছিস কেন-তখন কিন্তু ঘট বলতে একটা স্থির, নিশ্চল নড়েচড়ে না এমন একটা বস্তুর সঙ্গে তুলনা করে বসি আমরা। আমি এটাও বুঝেছি যে, আমিই প্রথম এই ঘটের দ্বৈরথে আকুল হয়ে উঠিনি। এক প্রাচীন মানুষ বহুকাল আগে একটি শ্লোক লিখে বলেছিলেন- ঘটে চলেছে, নিরন্তর ঘটে চলেছে বলেই তাকে ঘট বলি আমরা, কিন্তু কিছুই যদি না ঘটে তাহলে কিন্তু ঘট হয়ে যাবে তুমি-ঘটতীতি ঘটো জ্ঞেয়ো নাঘটন্ ঘটতামিয়াৎ।

অমৃত যখন উঠেছিল, সেই ঘট নিয়ে যাবার সময় বিভিন্ন জায়গায় চলকে চলকে যে অমৃত পড়েছিল তার থেকে যে মেলা হয়, তার নাম কুম্ভমেলা। কুম্ভ অর্থাৎ কলস, কুম্ভ মানে ঘট। কুম্ভ বলতে আমার ধারণা, সমস্ত শরীরের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত অংশ হল মাথা। সেই মস্তিষ্কেই অমৃতের স্থান।

কুম্ভ এবং কুম্ভমেলা। পুণ্যের লোভে কুম্ভমেলায় যান অনেকে। আর যাঁদের কাছে কুম্ভমেলা মানে মহামিলন, তাঁদেরও পা পড়ে সেখানে। কুম্ভমেলা আজও বিরাটত্ব, মাহাত্ম্য নিয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়। এই মাহাত্ম্যের অন্যতম কারণ বহু মানুষ সেখানে উপস্থিত হন।

মহাজন যে পথে করেন গমন, সেই পথই আমাদের পথ হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। মহাজন কথাটির একটি গভীর অর্থ রয়েছে, যে পথ দিয়ে বহু মানুষ গিয়েছেন। মহাজন সমাগম হয় বলেই এত বিখ্যাত। সমুদ্রমন্থনের ফলে যে অমৃত উঠেছিল, সেই অমৃতের কিছুটা বেশি মাত্রায় পড়েছিল প্রয়াগে। প্রয়াগকে তাই পুষ্কর অর্থাৎ ব্রহ্মার স্থান বলে মনে করা হয়। সারা ভারতে একমাত্র পুষ্করে ব্রহ্মার আরাধনা হয়।

কুম্ভ আসলে ঘট। কলস পুরাকালে যেভাবে ব্যবহার হয়েছে, সেখান থেকেই কুম্ভের বিষয়টি এসেছে। সমুদ্রমন্থনে অমৃতকলস হাতে নিয়ে উঠেছিলেন দেববৈদ্য ধন্বন্তরি।

বেদ হচ্ছে অখিল ধর্মের মূল। তাই আমরা ঋগবেদের মধ্যে সবকিছুর আদি অনুসন্ধান করি। কিন্তু বেদে কুম্ভের কথা আমরা পাই না। যেটা পাই তা হল সোমের কথা। সোমপান করার সঙ্গে অমৃতপানের কথা বলা হয়েছে। সোমরস কিন্তু সাধারণ মদ্য নয়। সোমরস নিয়ে বহু দেশি-বিদেশি পণ্ডিত গবেষণা করেছেন। তাঁরা দেখেছেন সোমরসকে আমরা যেভাবে সাধারণ মদ্যের সঙ্গে সহজ তুলনা করে ফেলি, আসলে কিন্তু তা নয়। সোম আসলে ‘ফ্লোরেসেন্ট মাশরুম’। কীরকম দেখতে এই সোম? অসম্ভব উজ্জ্বল তার চেহারা। রাত্রিবেলায় তার থেকে আলো বেরোয়। একমাত্র হিমালয়ের পাদদেশেই হত। গবেষক তার ছবি সহ উপস্থাপনা করেছিলেন সেমিনারে।

সোমই বেদে অমৃত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বেদে বলা হয়েছে, পুরুষ মানুষ যেমন শত আচ্ছন্ন পথে একজন তরুণীর সঙ্গে মিলিত হয়, তেমনি সোমের ধারা শতছিদ্র পথে কলসিতে এসে জমা হচ্ছে। সোমরস ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে কলসে রাখা হচ্ছে। এভাবেই সোম এবং অমৃতের একটা যোগ পাওয়া যায় বেদে। সোমরস কলসের মধ্যে রাখা হচ্ছে, কারণ এই রস সেখানেই সবচেয়ে ভালো থাকে।

আমার ধারণা, সমুদ্রমন্থনের সমুদ্র আসলে এই কলস। মন্থনের ফলে উঠে আসা অমৃত মূলত চারটি জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যত্রও পড়েছে ছিটেফোঁটা।

দেবতা ও অসুরের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। আজও চলছে। মহাভারতেও দেবাসুর দ্বন্দ্বের কথা আমরা পেয়ে থাকি। মনে রাখতে হবে, এই দৈত্য ও দানব কিন্তু একই পিতার সন্তান। শুধুমাত্র মাতা আলাদা। রাবণকে যদি দৈত্য বলি, তাহলে বলতে হয় তরুণ বয়সে বহু তরুণী তাঁকে দেখে মূর্ছা যেতেন। ফলে, দেবতা এবং আমাদের দেখা প্যান্ডেলের অসুরের শারীরিক মিল দেখে দুয়ে দুয়ে চার না করে ফেলাটাই উচিত। আসলে দেবতা ও অসুরের মধ্যে যুদ্ধটা কিন্তু অধিকারের লড়াই। একটা সময় অসুররা দেবতাদের প্রায় পরাস্ত করে ফেলেছিলেন। এই সূত্র ধরেই দেবতারা উপস্থিত হন ব্রহ্মা, নারায়ণ, মহেশ্বরের কাছে। নারায়ণ অত্যন্ত চতুর। তিনি আপাতভাবে অসুরদের সঙ্গে মিলে সমুদ্রমন্থনের পরামর্শ দেন। সেই মন্থনে উঠে আসে অমৃত। বহু পুরাণেই এই মন্থনের উল্লেখ আছে উনিশ-বিশ করে। সকলেই বলেছেন, কুম্ভে বা কলসে অমৃতের কথা। কলস রূপ উদধি, জলধি, জলনিধি অর্থাৎ সাগরের কথা। কলস রূপ সাগরকে মন্থন করো।

মন্থন থেকে বিভিন্ন বস্তু উঠে এল। দেববৈদ্য ধন্বন্তরির হাতে উঠে এল অমৃতকলস। ওঠামাত্রই চারপাশে কোলাহল উঠল। মন্থন থেকে যা যা উঠেছে তার উৎকৃষ্ট জিনিসগুলি দেবতারা ভোগ করলেন। অসুরেরা ধৈর্যের সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেন। কিন্তু অমৃত যখন উঠল, তখন কিন্তু অসুরেরা উল্লম্ফন শুরু করলেন। কারণ, তাঁদের অমৃত চাই।

‘অমৃতার্থে মহান্নাদো মমেদম্ ইতি জল্পতা।’ আমাদের চাই অমৃত। কুম্ভমেলাতেও যে এত কোটি কোটি মানুষ গিয়ে পৌঁছোন, তাঁরাও পুণ্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে জলে ডুব দিতে চান। সবার আগে এই যে পুণ্য অর্জনের চেষ্টা, তা কিন্তু সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা অমৃত নিয়ে কাড়াকাড়ির সঙ্গে তুলনীয়।

সেই অমৃত নিয়ে তৈরি হল ছল। অনেক পুরাণ মতে অসুররাই প্রথম অমৃতকলস পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দেবতাদের কিছুটা ভাগ দিয়ে তারপর তাঁরা অমৃতকলসের দখল নিতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ঘটনা হল, মহাভারত ও পুরাণকারেরা বলেছেন, স্বয়ং বিষ্ণুই এই ভেদাভেদটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। এই যে শাশ্বতিক একটা ভাবনা, তা আজও রয়ে গিয়েছে। অমৃত ও লক্ষ্মী নিয়েই যত বিবাদ। লক্ষ্মীর দিকে অসুরকুলের নজর ছিল, কিন্তু তাঁকে গ্রহণ করলেন স্বয়ং বিষ্ণু। মন্থনে উঠে আসা ঐরাবত হাতি নিলেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র। পারিজাত থেকে উচ্চৈঃশ্রবা ঘোড়া, সব নিলেন দেবতারা। এই যে অমৃত নিয়ে বিবাদ, তা নাকি চলেছিল ১২ বছর ধরে।

আবার এও বলা হয়েছে, বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে দেবতাদের অমৃত পান করালেও অসুরদের ফাঁকি দিয়েছিলেন। বলা হয়, ইন্দ্র বিষ্ণুর হাত থেকে অমৃত কলস নিয়ে পালিয়ে যান এবং রাখতে দেন তাঁর পুত্র জয়ন্তকে।

গরুড়ের সঙ্গেও অমৃতের একটা যোগ রয়েছে। তিনি যখন অমৃত নিয়ে যাচ্ছেন, তখন হাজার হাজার দেবতা তাঁকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। এভাবে জ্যোতিষশাস্ত্রেও একটা অদ্ভুত বিষয় শুরু হয়েছে। জ্যোতিষশাস্ত্রে কুম্ভ যোগের ভাবনার কথা বলা হয়েছে। সূর্য, চন্দ্র, বৃহস্পতি, শনি তাঁরা দৃষ্টি দিয়ে রক্ষা করছেন। এভাবেই জ্যোতিষশাস্ত্রে বলা হয়েছে, ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের শেষার্ধ, শতভিষা নক্ষত্র পূর্ণভাবে এবং পূর্ব ভাদ্রপদের যে প্রথম পদ-এই নিয়ে কুম্ভরাশির গঠন হয়। যে রাশিতে যে বছর সূর্য, চন্দ্র এবং বৃহস্পতির মিলন ঘটবে, সেই বছর সেই রাশিতে এই অমৃত কুম্ভপাত অর্থাৎ অমৃতকুম্ভ পৃথিবীর উপর উলটে পড়বে। এটাই হচ্ছে কুম্ভ যোগ। জ্যোতিষশাস্ত্রের মত এমনটাই। একেই বলা হয় পুষ্কর যোগ। পুষ্কর মাহাত্ম্যের সঙ্গেই অমৃত যোগ মিলেমিশে একাকার। আর এই কারণেই দেশ-বিদেশের সাধুসন্তের এত আগমন।

মহাভারতের ঠিক পরে পরেই লেখা হয়েছিল হরিবংশ। মহাভারতে যেসব কথা বলা হয়নি, তার অনেক কথাই এখানে বলা হয়েছে। হরিবংশে বলা হয়েছে, মন্দার পর্বতকে দিয়ে যে সমুদ্রমন্থন করা হয়েছিল, সেই সময় হাজার হাজার ওষধি ছিল সমুদ্রের মধ্যে। সেই ওষধি উঠে এসেছিল মন্থনের ফলে। আয়ুর্বেদের কাজে পরবর্তী সময়ে এই ওষধির ব্যবহার দেখি আমরা। এই কাজটির মূল হোতা ছিলেন দেববৈদ্য ধন্বন্তরি।

আমার মতে, এটাই সমুদ্রমন্থনের এবং মহাকুম্ভে জলে স্নান করে পুণ্যের যে লোভ-তার সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হরিবংশের কাহিনীতেই রয়েছে।

ঈশ্বর-কুম্ভকারের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এই কুম্ভখানি-কুম্ভ মানেও ঘট, কুম্ভ মানেও কলস। সেই কুম্ভকার আমার মস্তক-স্বরূপ ঘটখানি গড়ে সেটা উলটো করে আমার-আপনার ধড়ের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। উলটো করে জুড়েছেন এইজন্যই যাতে বুদ্ধির অমৃতটুকু চলকে বেরোয়। কোন কালে কতবার ঈশ্বর কত স্থানে তাঁর অমৃতকুম্ভ উলটে ফেলেছিলেন, সেটা নিয়ে কত পুরাণ, কত কথা, কত সাধু সমাগম, মানুষের মেলা-ওরে! দেবতায় উলটে পড়েছে, ছিটেফোঁটা যা পাই-তা এত জায়গায় কুম্ভমেলা হয়।

আর মানুষের মস্তক-ঘট থকে চলকে পড়া বুদ্ধিটুকুই কিন্তু সেই অমৃত, যা দিয়ে জগৎ চলে। ঘট তাই দেবতার স্থান, মানুষের চরম বুদ্ধ্যাধার, পূর্ণঘটের এত মূল্য এইখানেই।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *