কুট্টুস-স্কুবিডু ভালো থাকুক, আমরাও থাকি নিরাপদ

কুট্টুস-স্কুবিডু ভালো থাকুক, আমরাও থাকি নিরাপদ

শিক্ষা
Spread the love


 

  • রঙ্গন রায়

খুব ছোটবেলায় একটা সিনেমা দেখেছিলাম, নাম ছিল ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ মাইলো অ্যান্ড অটিস’। জাপানি ছবি। মাইলো নামের একটি লাল বিড়াল আর অটিস নামের এক পাগ কুকুরের চমৎকার সারভাইভাল গল্প। গল্পটা বলি৷ ছোট্ট মাইলো একদিন তার মালিকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একখানা কাঠের বাক্সে ঢুকেছিল খেলাচ্ছলে, তারপর ঘটনাচক্রে বাক্স সহকারেই নদীতে ভেসে যায়। আর সেই বাড়িরই কুকুর, মাইলোর বন্ধু অটিস, তাকে বাঁচানোর জন্য প্রাণের তোয়াক্কা না করেই নদীর কিনারা ধরে রওনা দেয়। যাত্রাপথে তাদের কত কত যে অ্যাডভেঞ্চার! শিশুমনের জন্য আদর্শ এক ছবি। সেদিন প্রথম আমার বিড়াল ও কুকুরের প্রতি প্রীতি জন্মেছিল। সিনেমার উদ্দেশ্যও ছিল তাই, পশুপ্রেমকে শিশুদের মধ্যে জাগিয়ে তোলা। তাই পরিচালক মাসানোরি হাতা এবং কন ইচিকাওয়া অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করেননি। করেছিলেন লাইভ অ্যাকশন।

যাঁরা নয়ের দশকে জন্মেছেন, তাঁরা সবাই জানেন, আমাদের ছোটবেলায় সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ছিল না। ছিল কার্টুন নেটওয়ার্ক। তাতে হত ‘স্কুবিডু’ নামক একটি গ্রেট ডেন কুকুরের মজাদার কাণ্ডকারখানা। বা টম অ্যান্ড জেরির কথাই ধরুন। তাতেও ছিল বুলডগ স্পাইক। আবার যেদিন প্রথম হাতে পেলাম হার্জ প্রণীত টিনটিন, তাতেও টিনটিনের সর্বক্ষণের সঙ্গী কুট্টুস নামের ফক্সটেরিয়ার আমাদের সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিল। যে না থাকলে তো কতবারই টিনটিনের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হত! অরণ্যদেবের ডেভিল-ই বলুন, বা একটু বড় হয়ে পড়া জ্যাক লন্ডনের ‘কল অফ দ্য ওয়াইল্ড’-এর স্লেজ টানা ‘বাক’— কুকুরের সঙ্গে আমাদের প্রাণ কিন্তু সবসময়ই জুড়ে ছিল। তাদের প্রতি ভালোবাসাও ছোটবেলাতেই, এভাবেই তৈরি হয়ে যায়। আমাদের শেখানো হয়, কুকুরই মানুষের প্রকৃত বন্ধু। সেই আদিমকালের গুহাবাসী জীবন থেকে সে মানুষের কাছাকাছি থাকে। শিকার থেকে শুরু করে সর্বত্র সাহায্য করে। ভরসা জোগায়। তাহলে আজ হঠাৎ সুপ্রিম কোর্টের এমন রায়দানে আমরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গেলাম কেন? হলাম, কারণ কিছু ভিডিও সোশ্যাল মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায়।

একটি শিশু তার বাড়ি থেকে বের হতেই হিংস্র পথকুকুর, যেগুলি নিরীহ বলেই আমাদের ধারণা, তাকে আঁচড়ে কামড়ে নৃশংসভাবে হত্যা করছে– এই ভয়াবহ দৃশ্য চাক্ষুষ করলে আপনার অস্বস্তি হতে বাধ্য। তাছাড়া রাস্তায় প্রায়ই আমরা পথচলতিরাও আক্রান্ত হই তাদের দ্বারা। অনেকেরই কুকুরের প্রতি ফোবিয়া আছে। জলাতঙ্কের মতো ভয়ংকরতম রোগ একবার হয়ে গেলে, আজও তার ঠিকমতো নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। কাজেই কুকুর নিয়ে আমাদের প্রেমের চেয়েও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন।

আমি একজন সাধারণ নাগরিক। কুকুরের প্রতি আমার অবস্থানটি শুনে হয়তো আপনিও আমার সঙ্গে একমত হবেন। আমি কুকুরকে ভালোবাসি। কিন্তু গভীর রাতে একা একা বাড়ি ফেরার পথে যখন এক দঙ্গল কুকুর রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ রব তোলে, তখন আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায় বৈকি!

এমন অনেকবারই হয়েছে, কুকুর দেখলে মাথা ধরে আদর করে দিয়েছি, দোকান থেকে কিনে খাইয়েছি বিস্কুট। দোকানে খাচ্ছি, সেসময় একটা কুকুর এসে মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকলে আমরা দয়াপরবশ হয়ে, নিজেরই ভাগ থেকে সেটির মুখে খাবার তুলে দিই। কিন্তু সেই ‘আমি’ই যখন রাত্রিবেলা মোটর সাইকেল চালিয়ে ফিরি, আর পেছনে কুকুর তাড়া করে, তখন কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে যায়, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। ঘটেও অনেকের। এমন নজির অনেক আছে।

তবে আগের তুলনায় ইদানীংকালে রাস্তার কুকুরের হিংস্রতা অনেকটাই বেশি বেড়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মনে হয়েছে, মানুষের প্রতি তাদের বিশ্বাস উঠে গিয়েছে যেন৷ যেভাবে জোরে জোরে সবাই গাড়ি চালায় এবং পিষে দিয়ে চলে যায় তাদের, আহত করে, বিকলাঙ্গ করে, হোটেলের কাছে ঘুরঘুর করলে ছিটিয়ে দেয় গরম জল– তার ফলেই তারা এমনটা হয়ে উঠছে সম্ভবত! আক্রমণ করার একটা বিজ্ঞানসম্মত কারণও আছে। কী কারণ? মানুষ ভয় পেলেই তার শরীর থেকে অ্যাড্রিনালিন ও কর্টিসেল হরমোন ক্ষরণ হয়। এতে ঘামের গন্ধ বদলে যায় আমাদের, শরীরের উষ্ণতা ও শ্বাসপ্রশ্বাসের গতিও বাড়ে, মাংসপেশি টানটান হয়ে যায়; কুকুর সেটা খুব দ্রুতই বুঝতে পারে৷ কারণ তাদের ঘ্রাণশক্তি মানুষের থেকে প্রায় ৪০ গুণ বেশি। কুকুরগুলি ভাবে, রিফ্লেক্সের দরুন মানুষটি হয়তো তার ক্ষতিই করে ফেলবে। তাই সে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

তবে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় পূর্বে দিয়েছিল, যার ফলে বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংগঠন ক্ষিপ্ত প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তার সংশোধন করে নয়া ফরমান জারি করেছে আদালত। যা আমার মতো সাধারণ মানুষের অনেকাংশে সঠিক বলে মনে হয়৷ কেন?

সুপ্রিম কোর্ট ২২ অগাস্ট পথকুকুরের বন্ধ্যাকরণের প্রতি জোর দিয়েছে। যদিও সব কুকুরকে ধরে ধরে নির্বীজকরণ করালে একদিন কুকুরই থাকবে না৷ বিষয়টি নিয়ে তাই আরও সংশোধনের প্রয়োজন থেকে যাচ্ছে। এছাড়া রাস্তা থেকে তাদের নির্দিষ্ট আশ্রয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে, সেখানে সঠিক পদ্ধতিতে প্রতিষেধক দিয়ে, ট্রিটমেন্ট করে, তারপর ফের যেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানেই ফিরিয়ে দিতে বলেছে আদালত। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের কথাও রয়েছে। যেমন, যে সমস্ত কুকুর র‌্যাবিজ আক্রান্ত বা আগ্রাসী, হিংস্র স্বভাবের, তাদের আশ্রয় শিবিরেই রেখে দিতে হবে। রাস্তায় ফেরানো যাবে না। তাছাড়া, রাস্তার ধারে প্রকাশ্যে কুকুরকে খাওয়ানোরও অনুমতি দেয়নি আদালত।

মাঝেমধ্যেই দেখবেন, পশুপ্রেমী সংগঠন থেকে রাস্তায় রাস্তায় একগাদা ভাত–ঝোল মেশানো খাবার দিয়ে যায়। যা খুবই মহৎকর্ম সন্দেহ নেই। কিন্তু কুকুরগুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এমনভাবে খায়, যাতে গোটা রাস্তাঘাটই অপরিষ্কার হয়ে যায়। ভাত পচে গন্ধও ছড়ায়। তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় খাওয়ালে কিন্তু এই ব্যাপারটা হবে না। সুস্থ একটি সমাজ গড়ে উঠবে। কারণ পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর সমানভাবে বেঁচে থাকার, সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার আছে। মানুষকে তাই সচেতন হতে হবে। প্রেম যেন অন্ধ না হয়। আপনার ভালোবাসা যেন অন্য মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হয়, এটা সর্বাগ্রে লক্ষণীয়।

এই রায়ের প্রেক্ষাপটে আরেকটি জিনিসও মনে হয় যে, যাঁরা বাড়িতে কুকুর পোষেন, তাঁরা যখন তাদের বাইরে ঘোরাতে বের করেন, অবশ্যই পোষ্যদের বর্জ্যগুলি রাস্তায় ফেলা বন্ধ করা উচিত। সবাই যদি এক এক ধাপ অগ্রসর হই, ভালোবাসা তাতে কমে না। কুকুর সেই শিকারের যুগ থেকে মানুষের বন্ধু। তাকে ভালোওবাসুন। কিন্তু সচেতনতা বজায় রেখে। যেন আর কোনও শিশুর মৃত্যু না ঘটে। যেন কুকুরও মানুষের প্রতি বিশ্বাস না হারায়। যেন আপনারই বিপদে সত্যিই ‘অটিস’-এর মতো মিষ্টি কুকুরটি ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণের ভয় না করে। তবেই তো ভারসাম্য। সহাবস্থান!

(লেখক ভাষাকর্মী)   



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *