গৌতম সরকার
কার্ড, আইডি, পাসওয়ার্ড, ওটিপি…। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে হয়তো আবার গাইতেন, ‘এর বাইরে জগৎ আছে, তোমরা মানো না…।’ এককদম এগিয়ে ব্যঙ্গ করতেন, ‘তোমরা নিজেই জানো না…।’ আমি-আপনি অবশ্য মেনেই নিয়েছি পাসওয়ার্ড, ওটিপি, হাজার রকমের কার্ড ছাড়া আমাদের জীবন বৃথা। তার বাইরে কিছু থাকলে জানতেও চাই না।
কিন্তু মেনে নিলেও যে স্বস্তি নেই! ভোটার কার্ড আছে শুনে মুখ বেঁকায় নির্বাচন কমিশন। আরে ধুর, ওটা তো পরিচয়ই নয়! তাহলে এত বছর ওই কার্ড দেখে ভোট দিতে দিলেন কেন? খবরদার, প্রশ্ন করতে নেই। বেশি চাপাচাপি করলে ভিনদেশি তকমা জুটে যেতে পারে। চাই কী, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাতের অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হতে পারে সীমান্তের ওপারে।
‘পুশব্যাক’ শব্দটির আইনি বৈধতা আছে বৈকি। কিন্তু সেটা কার্যকর করতে রাতের আড়াল দরকার হয় না। ভিনদেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে নথিপত্র বিনিময় করে অনুপ্রবেশকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া যায়। এই বিধান আইনেই আছে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার কাছে অবশ্য আইনের তোয়াক্কা নেই। প্রমাণ দরকার নেই, তাঁর প্রশাসন বাংলাদেশি সন্দেহ করলেই হল। ধরো আর পার করো নীতি চলছে এখন অসমে।
কালিয়াচকের আমির শেখ কাঁটাতারের ওপার থেকে ভিডিও বানিয়ে না পাঠালে কেউ বিশ্বাস করতেন না যে বাংলার মানুষেরও এই বিপদ দাঁড়ায়ে দুয়ারে। আধার কার্ড না থাকলে নাকি আমি-আপনি অচল। র্যাশন মিলবে না, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হবে না, মোবাইলের সিম পাবেন না। অথচ সাত রাজার ধন এক মানিক সেটাও নাকি নাগরিকত্বের পরিচয় নয়। প্যান কার্ড তো নয়ই।
সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’-এ ‘একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন’ অনুকরণ করে বলতে ইচ্ছে করে, একটু নাগরিকত্ব পাই কোথায় বলতে পারেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন বটে, তিনি থাকতে একজনের নামও ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে দেবেন না- কিন্তু তাতে ভরসা কি রাখা যাচ্ছে? তিনি তো বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন যতই নির্দেশ দিক, কোনও সরকারি আধিকারিককে তিনি সাসপেন্ড করতে দেবেন না। শেষপর্যন্ত হুমকিটা যে আঁচলেই বাঁধা রইল।
আমার-আপনার নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়াটা তাই অনেকটা না আঁচালে বিশ্বাস নেইয়ের মতো। দুয়ারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনী, ইংরেজিতে ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ (এসআইআর), সংক্ষেপে কেউ বলছেন ‘সার’। যে সারের উর্বরতা বাড়ানোর ক্ষমতা নেই, আছে শুধু বেছে ফেলে দেওয়ার অধিকার। ভারতের রাজনীতিতে গত কয়েক বছরে বহুল ব্যবহৃত ‘জুমলা’র আরেক ধরন যেন ‘সার।’
সুকুমার রায়ের ছড়াতেই ফিরে যাই, ‘বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা।’ আমাদের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের ‘সময়ে বাংলায় এসআইআর হবে’ বাক্যবন্ধটি ‘জুমলা’র মতোই মনে হয়। যেন ‘অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে।’ ‘এসআইআর’ নির্বাচন কমিশনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু জ্ঞানেশের হুমকিবাণীতে সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকছে নাকি!
‘এসআইআর’-এ শুধু মৃত আর ভুয়ো ভোটার বাদ গেলে আপত্তির কিছু নেই। বরং এতদিন যে সেসব জঞ্জাল ঝাড়াই-বাছাইয়ে নির্বাচন কমিশনের মতি হয়নি, সেটাই অবাক করার মতো কাণ্ড। মুশকিলটা হল, প্রকৃত নাগরিকও স্বস্তি পাচ্ছেন না ‘সার’-এর কর্মকাণ্ডে। ভোটার কার্ড মানা হবে না, আধার কার্ড নাগরিকত্বের পরিচয় নয়। জন্ম সার্টিফিকেট লাগবে। জন্মস্থানের প্রমাণ চাই, প্রয়োজনে বাবা-মায়ের জন্মের নথি চাই ইত্যাদি হাজার কড়াকড়ি।
পাওয়া যাবে কোথায়? আমার কথাই ধরুন। বাবা-মায়ের কাছে শুনেছি, আমার জন্ম শিলিগুড়ি হাসপাতালে। যেকালে জন্মের শংসাপত্রের বালাই ছিল না। নিয়ম থাকলেও কারও মাথাব্যথা ছিল না। স্কুলে ভর্তির সময় বাবা-মা একটা জন্ম তারিখ বসিয়ে দিতেন। তা অনেক সময় প্রকৃত দিন তারিখের সঙ্গে মিলত না। জন্ম তারিখের রেকর্ড বলতে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় (মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক) অ্যাডমিট কার্ড।
সেই কার্ডের তথ্য মহামান্য নির্বাচন কমিশন না মানলে কি কলমের এক খোঁচায় আমি বহিরাগত? জন্মস্থানের কোনও প্রমাণ তো আমার চোদ্দো পুরুষ উঠে এলেও দিতে পারবেন না। আমার মতো কারও কারও নাহয় অ্যাডমিট কার্ড আছে। কিন্তু যাঁরা কখনও স্কুলে যাননি বা গেলেও শেষ পরীক্ষার আগেই স্কুলছুট হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের বেলা! যাঁদের জন্ম সার্টিফিকেট নেই, তাঁদের বাবা-মায়ের জন্মের প্রমাণ থাকবে, আশা করাই তো বাতুলতা।
কমিশনের যুক্তিতে ভোটার কার্ড জাল হতে পারে, টাকা দিয়ে আধার কার্ড কেনা হতে পারে। বটেই তো। কিন্তু পঞ্চায়েত বা পুরসভা কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া জন্ম সার্টিফিকেট জাল হবে না- সে নিশ্চয়তা কোথায়! টাকা দিয়ে জন্ম সার্টিফিকেট কেনার উদাহরণ যে ভূরিভূরি। মাত্র ক’দিন আগে স্বাস্থ্য দপ্তরের নজরে পড়েছে মালদা জেলায় জন্মের প্রকৃত সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ জন্ম সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে পঞ্চায়েত, পুরসভা থেকে। এই অনিয়মে তদন্তের নির্দেশও দিয়েছে মালদা জেলা প্রশাসন।
এরপর কি আমাদের অবস্থা রামপ্রসাদী গান, ‘বল মা আমি দাঁড়াই কোথা’র মতো নয়? কেন্দ্রের চক্রান্ত বলে তৃণমূল এসআইআর বিরোধী প্রচার করবে ভোটে ফায়দা তোলার লক্ষ্যে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুপ্রবেশকারীদের বাঁচাতে এসআইআরের বিরোধিতা করছেন বলে হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে মরিয়া হবে বিজেপি। কিন্তু ষাঁড় নয়, ‘সার’-এর ধাক্কায় আমার-আপনার ছিটকে পড়ার বিপদ আটকাবে কে!!! ভোটার, আধার, প্যান, র্যাশন ইত্যাদি হাজার রকমের কার্ড থাকলেও আমাদের রক্ষাকবচ কিন্তু কোথাও নেই।