- রঙ্গন রায়
লুই আর্মস্ট্রঙের ‘হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড’ গানের কথা মনে পড়ছে। পৃথিবী বদলে যায়, যুদ্ধ হয়, মহামারি হয়, হয় বিশ্বায়ন। কিন্তু মানুষের আশা ও বিশ্বাস বদলায় না। বদলায় না ভালোবাসা। তা ওয়ার্ল্ড ছাড়ুন। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। বাংলারও সমগ্র মুখমণ্ডলের দিকে তাকাতে হবে না। ভ্রূপল্লবের সেই অপার্থিব বাঁকেই দৃষ্টি স্থির করুন, হে পাঠক। মনে হবে, ডুয়ার্সের রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর! আসলে এই উত্তরবাংলার জল জঙ্গল জনসত্তা, প্রস্তর পাহাড় পর্যটন আপনাকে নিয়ে যাবেই সুকোমল সৌন্দর্যের কাছে। আর এই সৌন্দর্যের প্রতিটি রোমকূপে যদি নেমে আসে বৃষ্টি!
যাঁরা ডুয়ার্সে এসেছেন, এখানকার বর্ষাকাল দেখেছেন, তাঁরা জানেন, পাহাড় ও জঙ্গলের সঙ্গে জলের এক অপূর্ব যোগাযোগ। বৃষ্টির কুয়াশা জড়ানো মিস্টিক আবহাওয়ায় আচমকা দেখে ফেলা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা! কিংবা, ঘন জঙ্গলের ভেতর বৃষ্টি মাথায় আসতে আসতে দেখলেন, অরণ্য সেজে আছে অলৌকিক বাগানে। এই তো সেদিনই, এক বন্ধুর সঙ্গে স্কুটারে ফিরছিলাম চালসা থেকে। তখনও বর্ষাকাল আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি। সামনেই প্রিয় রাস্তা– লাটাগুড়ি জঙ্গল। তার বেশ কিছুটা আগেই যে একপশলা অরণ্য, তার নাম টিয়াবন। যিনি এই নামকরণ করেছেন, তিনি নিঃসন্দেহেই কবি। জীবনে একটিও কবিতা না লিখলেও, মানুষ কবি হতে পারে, যদি তার সৌন্দর্যপিপাসু মন থাকে। যদি সে বিস্মিত হতে জানে। তো সেই বিপুল বনরাজির অন্তরে অন্তরে সদ্য বৃষ্টি থামা আলো এসে পড়েছে, যেন স্প্রে করে দেওয়া কুয়াশা। হাতছানি দিচ্ছে তার চেতনায় ঢুকে পড়বার জন্য। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম আরণ্যক আমিকে। গাছ থেকে টুপটুপ করে জল পড়ছে, নীচের মৃত পাতায়। পাখিরা বৃষ্টি থামার আনন্দে ডেকে উঠছে মৃদুমৃদু। পতঙ্গের উড়ন্ত শব্দ মনে জমাটি ভালোলাগা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এমন সময় সুরেলা পিতলের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল। গরুমারা জঙ্গলে এক ধরনের ঝিঁঝিপোকা আছে, যারা ডেকে উঠলে, মনে হয় ঘণ্টাই বাজছে। এই ঘণ্টাধ্বনিই মনে করিয়ে দিল, ছুটির কথা। বর্ষাদিনের প্রকৃত আনন্দ।
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ‘রেইনি ডে’র কথা! বৃষ্টির জন্য ছুটির কথা! আমরা যারা ডুয়ার্সবঙ্গের চা বাগানের আশপাশের ছোট ছোট গ্রাম বা শহরে বড় হয়েছি, তারা জানি– বর্ষা মানেই শুধু বৃষ্টি নয়। বর্ষা মানে কাদা পায়ে স্কুল থেকে বাড়ি, বর্ষা মানে ছাতা হারিয়ে ফেলা, খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নৌকা ভাসানো, জলকাদা ভর্তি মাঠে ফুটবল নিয়ে উস্তমকুস্তম, সপাসপ আছাড় খাওয়া, পড়া ভুলে জানলার ধারে হাঁ করে বসে বৃষ্টি আর মায়ের গলায় চিৎকার– ‘তুই ফের বই বাদ দিয়ে…’ এসবই ছিল নির্মল ছোটবেলার স্থায়ী ছবি। বর্ষাকালের রচনায় লেখা সত্যিকারের পয়েন্ট।
কিন্তু বৃষ্টি শব্দটা কি আর আগের মতো করে আপনাকে নাড়া দিয়ে যায় এখন? একসময় এপ্রিল মাস থেকেই কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টি দিয়ে আমাদের এখানে নেমে আসত বর্ষা। এই স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে, ছিল না প্যাচপেচে গরমের চিহ্ন মাত্র। কিছুদিন আগে অবধি দেখেছি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারে টানা তিনদিন যদি কাঠফাটা গরম পড়ে, তবে চারদিনের দিন বৃষ্টি অবধারিত। আর বৃষ্টি নামলে উঠোনে জল না দাঁড় করিয়ে তা থামে না। কিন্তু আজ! টানা পনেরো-কুড়িদিন গরম থাকছে, বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। আগে মে-জুন-জুলাই-অগাস্ট, চার মাসই বর্ষাকাল ছিল। কিন্তু আজ চাতক পাখি আর আমাদের কোনও পার্থক্য নেই। যে বৃষ্টি মানে ছিল জলের ছপছপ, মাঠের সোঁদাসোঁদা আর বাচ্চাদের কাদামাখা হাঁটুর গন্ধ– বর্ষার সেই চরিত্রই হারিয়ে গেছে!
আজকাল চারদিকে ভীষণ উন্নয়ন। পিচঢালা রাস্তা, আর কংক্রিটের পুকুরপাড়। জলই দাঁড়ায় না। শিশুরাও দাঁড়ায় শুধু কোচিং-সেন্টারে, ভিডিও গেমে আর কম্পিউটারে। খেলা কোথায়? কাদার গন্ধটাই তো ভুলে গেছে ওরা। আগের মতো পায়ের আঙুল গুঁজে জলস্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় নেই কারও!
সেই যে ছোটবেলায় গাছতলায় বসে বৃষ্টির গল্প শুনতাম, থালার মতো মাঠ আর ওলটানো কড়াইয়ের মতো আকাশ– এখন সেই গাছ নেই, মাঠ নেই, আকাশ নেই। সমানে কাটা হতে থাকে গাছ। শুধু জায়গাগুলোর নামেই রয়ে গেছে তারা। কেমন যেন বৃষ্টিও পালটে গিয়েছে। আগে হত দিনভর ঝিরঝিরে বৃষ্টি, হাওয়া বইত গন্ধ নিয়ে- চা বাগানের কচি পাতার, ভেজা মাটির, মায়ের আলুর চপ, বাবার ঘেমো বৃষ্টিভেজা জামার গন্ধ। এখন হঠাৎ হুট করে নামে বৃষ্টি, বিদ্যুৎ ঝলকে যেন প্রকৃতিও আর ধৈর্য ধরতে পারছে না। চা বাগানে এখন আর ছেলেমেয়েরা ছাতা মাথায় পাতা তুলতে যায় না। এখন মেশিন, এখন শিফট, এখন গার্ডের বাঁশি। আর আমরা, যারা শহরে বাস করছি, তারা বর্ষাকেও হিসেব করে দেখি- কত ট্রাফিক হবে, ছাতা নেব কি না, সন্তানের স্কুল খোলা থাকবে তো? মন আর বৃষ্টির মধ্যে সে আত্মিক যোগাযোগ নেই।
আমার বান্ধবী বলে- ‘তুই কি জানিস, এখনকার শিশুরা জানেই না জল জমে গেলে তাতে নৌকা ভাসাতে হয়!’ অবাক হই না। বিশ্বায়নের দৌলতে ওরা কাদা মানে বোঝে গুগল-এ সার্চ করে। ‘Mud Video games’ বললে PUBG-র মতো কিছু খুঁজে পায়। অথচ আমরা একটুকরো থার্মোকল পেলেই দৌড়ে যেতাম রাস্তায়।
একটা সময় ছিল যখন গলির ভিতরেই ছিল খেলার মাঠ। এখন সেই জায়গায় বহুতল ফ্ল্যাট উঠেছে। আগে যেখানে পা ফসকে পড়ে যেতাম কাদায়, এখন সেখানে পা ফসকালে সোজা গাড়ির হর্ন। শিশুরা এখন স্যাঁতসেঁতে নয়, এসি রুমে বড় হয়। বর্ষার কুয়াশা নয়, মোবাইলের ব্লু লাইটে ঘুম ভাঙে।
তবে কি বর্ষা হারিয়ে যাচ্ছে? না, বর্ষা এখনও আসে। ঝমঝমিয়েই নদী ফুলে ওঠে, পাহাড়ি রাস্তা ধসে পড়ে, ট্রেন বন্ধ হয়। কিন্তু বর্ষা আমাদের অন্তর আর ভিজিয়ে দেয় না। আমাদেরই শৈশবের মতো সে-ও কোণে বসে থাকে, একা।
তবু আশা রাখি, পাতলা চাদরে মোড়ানো বৃষ্টিভেজা বিকেলে ভূতের বই হাতে যদি কেউ শিহরিত হয়ে ওঠে! দুর্লভ কোনও কাঁচা রাস্তাতেও যদি ক’জন শিশু ভিজে যায়- জল ছিটিয়ে হাসে, তবে সেই হাসির শব্দই তো বর্ষাকে ফিরিয়ে আনে!
জল জমে না তাই কাদা নেই। কাদা নেই তাই খেলাও নেই- তবু মন চায় একটুখানি পুরোনো দিন ফিরুক। প্যাচপেচে গরমের ভিতরেও হঠাৎ যদি বৃষ্টি নামে, আমি আজও জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকি। দেখি বড় বড় কচু পাতার ওপরে থাকা জল কীভাবে কচি কচু পাতায় সুড়ুৎ করে স্লিপ খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। শুনি আজও ব্যাঙেদের মাধ্যমিক পরীক্ষা-প্রস্তুতি। ভিজতে পারি না, তবু মনে হয়, লুই আর্মস্ট্রঙের সেই গান– ‘অ্যান্ড আই থিংক টু মাইসেল্ফ, হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড!’