এভাবেও ফিরে আসা যায়

এভাবেও ফিরে আসা যায়

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মাঝবয়সি বনলতা খবরের কাগজ হাতে ধরে ভাবনার খোলা খাতা মেলে দেন। পরতে পরতে জড়িয়ে জীবনস্মৃতি। কত মেয়ের কথা মনে পড়ে! নারী দিবস পালনের হিড়িক ছিল না। তবে নারী চরিত্রের অবদমন ও অবনমন ছিল। উত্তর কলকাতার এক মসজিদের কাছে হিন্দু, শিখ সব মেয়ের মতো খেলার সাথি ছিল অনেক মুসলমান মেয়ে। তারা এত গরিব যে তার মায়ের ডাকে মায়ের সহায়িকার অনুপস্থিতিতে ঘরের কাজ করে দিত দুটো পয়সা হাতে পাবে বলে। বনলতার পুতুল বিয়ের দিন গড়িয়ে কৈশোর ও স্কুলের পড়ার চাপে সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় দেখার সময়ও ফুরিয়েছিল তাদের সঙ্গে।
ফতেমার মেয়েদের সঙ্গে দেখা হত পথেঘাটে। ওদের সবক’টা বোনের বিয়ের ব্যবস্থা হলেও কেউ কেউ ফিরেও এসেছিল। সিঁদুর নেই সিঁথিতে। বুঝবেনই বা কেমন করে? ওরা সধবা না আইবুড়ো। মাবিয়া সুখী গৃহকোণ পেলেও রাবেয়া পায়নি। শাকিলাও বুড়ো বরের বিবি হয়ে, বিধবা হয়ে মসজিদের বাইরে বসে ভিক্ষে করত। রাবেয়া কাঁখে, কোলে কচি ছানাদুটোকে নিয়ে কাজ করত লোকের বাড়ি বাড়ি। আর রোকেয়া বিয়ের রণে ভঙ্গ দিয়ে অভাবের সংসারে পেট চালানোর দায়টা নিয়েই নিয়েছিল। নিয়ম করে বিকেলের কনে দেখা আলোয় ধপধপে সফেদা সুন্দরী হয়ে পাউডার, পমেটম মেখে দাঁড়িয়ে পড়ত বাস রাস্তার ধারে। যেখানে সব পেট্রোল পাম্প আর সারে সারে রুটি-তড়কার ধাবা আছে। বলিষ্ঠ সব ট্রাক ড্রাইভার ওর ক্লায়েন্ট তখন। দিনে ঝি-গিরি আর রাতে সঙ্গিনী। সকালে শরীরটা আর দিত না। হরিণীর মতো শান্ত চোখদুটোয় লেপটে থাকত ঘুম। ঠিকে কাজগুলো গেল। একদিন ভরদুপুরে বরাত এল। রোকেয়া শ্বশুরবাড়ি চলল।
বনলতার এহেন কিশোরী মনে ঢেউ উঠত। মেয়েগুলো পড়াশোনা করে না কেন? সুযোগ পায় না তাই। মা বলত, তাইতো বলি, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সবাই কি আর এমন সুযোগ পায় রে? পিছিয়ে পড়া জনজীবনই কি তবে এরা? কিন্তু মা, আমরাই বা কত আর এগিয়ে গেছি? তুমি যে বলো, আমাদের বাড়িতে মেয়েদের ঘটা করে মুখেভাত দেওয়া নেই। মেয়ে হলে শাঁখ বাজাতে নেই, তাহলে আমরাও তো অনগ্রসর। মা সেদিন কথা বাড়ায়নি।

বিয়ের পর বনলতার প্রথম সংসার টাটানগরে। সুবর্ণরেখা নদীর ধারে, দলমা পাহাড়ের কোলে। কোম্পানির ফ্ল্যাটে। কাজের সহকারী হিমানীর মা ফুটফুটে মেয়ে কোলে কাজে আসত। বেশিরভাগ টলতে টলতে। আগের দিন রাতে মেয়ে মরদের সঙ্গে আকণ্ঠ হাঁড়িয়া পান করে আদিবাসী ডেরায় ফুর্তিফারতা করে দেরি দেখে রাগ করলেও  মনে পড়ত রোকেয়াদের কথাটা। একবার টুসু পরবে ৩দিন বলে আনলিমিটেড ছুটির পর কাজে এসে জয়েন করল সে কনকনে মাঘের শীতে। তার ‘‘দমে নেশাটেশা’’ তখন ঘুচে গিয়ে চোখেমুখে পরিতৃপ্তির হাসি। এবারে হিমানীর ভাই হবেই সেই আশায়। বনলতাকেও তখন শ্বশুরবাড়িতে সবাই চাপ দিচ্ছে। বছর ঘুরতে চলল, নতুন বৌ কবে পোয়াতি হবে? তখন মনে পড়েছিল মায়ের কথা। বনলতারও কি তবে মোক্ষলাভ সন্তান? সে উত্তর আজও পাননি তিনি।
বনলতা আবার কলকাতায় তখন। এবার সহকারী টিয়ার মা সোহাগী।
টিয়ার স্কুলের কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকাটা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঝাঁ করে ঢুকতেই বনলতা বলেছিলেন ফিক্সড করতে। সোহাগীর মেয়েকে ঘিরে টালির ঘরে অনেক স্বপ্ন। মেয়েটা একটা চাকরি পেলে তারা একটু সুখের মুখ দেখবে। টিয়া বায়োডেটা রেডি করে কোনও এক আপিসে গেল মায়ের সঙ্গে। বায়োডেটা জমা দিলেই নাকি চাকরি বরাদ্দ। সে যাত্রায় এক চান্সে ইন্টারভিউতে পাশ করতেই তাকে বলা হল, বারো হাজার দিলে তার চাকরি পাকা। ট্রেনিংয়ের সময় আরও পাঁচ হাজার, তারপরেই তিন মাস পর দশ হাজার ও এক বছর পর কুড়ি হাজার। সেবার এসব প্রলোভনে না পড়েও টিয়ার কন্যাশ্রীর সব টাকা জলে গেছিল কয়েক মাস বাদেই। তারপর রূপশ্রী প্রকল্পের টাকাও। মায়ের মাথায় টিয়ার বিয়ের ভূত চেপেছে তখন। মাসির বরের ফাঁদে পড়ে টিয়ার সে যাত্রায় বিয়ের তোড়জোড় হল আর কন্যাশ্রী, রূপশ্রী সব গেল ভোগে। সেই মেসো নিল বরপক্ষের কাছ থেকে কাটমানি। আর বিয়ের সব যৌতুক কেড়ে নিয়েছে তারা। টিয়া ততক্ষণে বিউটিসিয়ান কোর্সে চুপিচুপি নাম লিখিয়েছে। সেখানে প্রথমে তিন হাজারে ঢুকলে প্রিলি কোর্স। তারপরে সার্টিফিকেট ছ’মাস পর। আবার চার হাজার দিলে ব্রাইডাল মেকআপ। আবার সার্টিফিকেট। তারপর আবার তিন হাজার দিলে ম্যাসাজ। আবার সার্টিফিকেট। কিন্তু প্রথম থেকে একবারও সার্টিফিকেট পায় না। এনরোলমেন্ট চলতেই থাকে। ঠকে গেল টিয়া। মায়ের কাছে চলে এসেছে অনেকদিন আগেই। পাকাপাকিভাবে।
এখন সন্ধ্যায় কেটারিংয়ের কাজ করে। হাতখরচ প্রাপ্তিতে মন কানায় কানায়। ইভেন্টের কাজের খোঁজ পেলেই বিরিয়ানির বাক্স মায়ের হাতে তুলে দেয়। লক্ষ্মীর ভাঁড় উপচানোর চেষ্টায় ছুটে বেড়ায়। বন্ধুর ফাঁদে পড়ে এক রবিবার মেট্রো ধরে, অটোর ভাড়া গুনে টিয়ারা পৌঁছায় এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
বিশাল লাইন। মাথাপিছু একজন অভিভাবক। মায়েদের টুপি পরানো সহজ। বেঞ্চিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে তারা। একসময় ডাক পড়ে টিয়ার। পেলেও পেতে পার অমূল্য রতন! তবে ফোকটে ব্রেনওয়াশটা হয়েও হল না। বনলতা শুনেই বললেন, শেষে তুইও পিরামিড স্কিমের ফাঁদে পড়লি?
না। গাঁটের কড়ি খরচা করে সেই ফাঁদের জাল থেকে মুক্ত করে ফিরে এসেছিল টিয়া সে যাত্রায়। আট হাজারের বিনিময়ে আটহাজারি চাকরি।  পিরামিড ব্যবসায়ের প্রলোভনের ফাঁদে পা দেয়নি সে।
বনলতা তারিফ করেন টিয়ার বুদ্ধির। এমন কত গল্প বনলতা প্রত্যক্ষ করেছেন। টিয়ার বাপও ঠগ-জোচ্চোর। পরপর দুই মেয়ের জন্ম দেবার দোষে অন্য মেয়েমানুষের সঙ্গে ভেগে পড়েছিল লোকটা।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তাক লাগিয়েছে বনলতার দেখা জীবনের সবচাইতে স্মার্ট সহকারী। সেটাই হাইট! তাঁর বাড়িতে নাগাড়ে কাজ করছে রত্না। কিন্তু হঠাৎ লক্ষ করলেন, কাজে অমনোযোগ, ভুলভ্রান্তি। ডাকলে সাড়া পান না। ছাদ থেকে তরতর করে নেমে এসে বলে স্যরি।
শিক্ষিত রত্নার বেশ চোখা চোখা ব্যক্তিত্ব। ঝকঝকে চেহারা স্মার্টফোনের যুগে। হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাসে ইনস্টাগ্রামের লিংক দেখে চমকে উঠলেন বনলতা। জিজ্ঞাসা করতেই রত্নাও হাতে চাঁদ পায়। নিজের মুখেই স্বীকারোক্তি তার… ধরাবাঁধা আর থাকবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় দিব্যি রোজগার চলছে। কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে রত্নার এ যেন মেটামরফোসিস। বনলতা রীতিমতোই আপ্লুত হলেন। এ তো দারুণ কথা রে! যা পাখি, উড়তে দিলাম তোকে…রত্না সেখানে মনের আনন্দে, মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে কখনও সাজগোজ, কখনও চুল বাঁধছে। কখনও রান্না করছে… না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ। ‘জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,/ওরে উথলি উঠেছে বারি,/ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ/রুধিয়া রাখিতে নারি।’ নিজের চোখে সেদিন বনলতার এক সত্যিকারের নারী দিবস পালন হল।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *