- সৌমিত্র বসু
বিরাট কোহলির জায়গাটা কে নেবেন? যে প্রশ্নটা এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত মাথায় ইতস্তত ঘুরপাক খেত সেই প্রশ্নটাই এখন একটা উত্তর দাবি করে। টেস্ট ক্রিকেট থেকে বিরাট কোহলির অবসর ভারতীয় দলের টপ অর্ডারে একটা শূন্যতা তৈরি করেছে। যদিও খেলাকে একদিন বিদায় জানাতেই হয়। কিন্তু কোহলি শুধুমাত্র একজন ব্যাটার নন। মহম্মদ আজহারউদ্দিন-পরবর্তী যুগে তিনিই একমাত্র অধিনায়ক যিনি দলের ওপর সামগ্রিকভাবে এতটা প্রভাব ফেলেছিলেন।
আত্মপ্রকাশকালে বিরাটের ব্যক্তিত্বে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা স্পষ্ট ছাপ ছিল। সৌরভই বুঝেছিলেন, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে দলে তরুণ রক্ত প্রয়োজন। বিরাট সৌরভের দেখানো সেই রাস্তাতেই হেঁটেছিলেন এবং বলা ভালো, অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। বিরাট হারতে পছন্দ করেন না। অস্ট্রেলিয়ার হার না মানা মানসিকতা বিশ্ব ক্রিকেটে বন্দিত। সেই মানসিকতাকেই ভারতীয় দলে সঞ্চারিত করেছিলেন বিরাট।
২০১৪ সাল। অ্যাডিলেড ওভাল ময়দানে সিরিজের প্রথম টেস্ট। মিচেল জনসন, পিটার সিডলদের আগুনে বোলিং সামলে বিরাট দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১৪১ রান। বিরাটের সেরা টেস্ট ইনিংসগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসেও বিরাটের ব্যাট থেকে সেঞ্চুরি এসেছিল। এরপর কে ভুলতে পারে, ২০১৮ সালের পারথ টেস্ট! মাত্র ৮ রানে ২ উইকেট হারিয়ে ভারত ব্যাপক চাপে। সেই সময় ক্রিজে আসেন বিরাট এবং করেন ১২৩ রান। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বরাবর বিরাটকে অন্য মেজাজে পাওয়া যেত। বিদেশের মাটিতে বিরাট-হুংকার ভারতীয় দলের খেলার ভঙ্গিমাকে চিরতরে বদলে দিয়েছিল।
২০১৮ সালটা বিরাটের কেরিয়ারে একটা গৌরবময় সাল। সে বছর সেঞ্চুরিয়ান (দক্ষিণ আফ্রিকা) এবং এজবাস্টনে (ইংল্যান্ড) বিরাট অনবদ্য দুটি ইনিংস খেলেন। বিরাটের অতি বড় নিন্দুকও এই অভিযোগ করতে পারবেন না যে, তিনি নিজের রানের জন্য কখনও ব্যাট করেছেন। বরাবর দলকে আগে রেখেছেন তিনি। বিগত কয়েকজন ভারতীয় অধিনায়ককে যদি এককথায় বিশ্লেষণ করতে হয়, তাহলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে বলা হয়, ঠান্ডা মাথার মানুষ। সৌরভ আগ্রাসী কিন্তু পরিমিত। রাহুল দ্রাবিড় বা অনিল কুম্বলে মার্জিত স্বভাবের। বিরাট ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের সেই অনন্য চরিত্র যিনি দলে একটা বাড়তি ‘শক্তি’ সঞ্চার করেছিলেন। বিশ্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের বুকে এই শক্তির রসদ থাকে।
বিরাটের বর্তমানে ৩৬ বছর বয়স। এখনও তিনি দলে সবার চেয়ে ফিট। আর সেই কারণেই তাঁর এই আচমকা অবসরকে মেনে নেওয়া কঠিন। বিরাট মানেই একটা আগুন। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী, এই তো বিরাটের পরিচয়। প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতে যিনি সিদ্ধহস্ত। হঠাৎ করেই নিজের প্রিয় ফর্ম্যাটকে বিরাট আগে বিদায় জানাবেন, তা যে কোনও ভক্তের কাছে কল্পনাতীত।
অধিনায়ক হিসাবে বিরাটের পদত্যাগ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। অনেকেই দায়ী করেছিলেন তৎকালীন বোর্ড সভাপতি সৌরভকে। বিরাট দলের ‘বোঝা’ হয়ে খেলা চালিয়ে যেতে চাননি। শচীন তেন্ডুলকারকেও এই ধরনের কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল। ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে সিরিজ হারের পর বিরাটের টেস্ট অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া এটাই প্রমাণ করে যে তিনি অকারণ সমালোচনা শুনতে চাননি।
বাইরে থেকে চনমনে দেখালেও বিরাট গত কয়েকবছর ধরে মানসিক অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। লাল বলের ক্রিকেটে ধারাবাহিক রানের খরা তাঁকে সম্ভবত ভেতর থেকে কুরে-কুরে খাচ্ছিল। সাদা জামায় বিরাট শেষবার শতরান করেছিলেন ২০২৪ সালের নভেম্বরে। পারথে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। তারপর বিরাটের সর্বোচ্চ রান ৩৬, মেলবোর্নে, বক্সিং ডে টেস্টে।
গৌতম গম্ভীর ভারতীয় দলের দায়িত্বে আসার পর থেকেই কানাঘুষো বিরাটকে নিয়ে নানান জল্পনা শুরু হয়েছিল। আগেই দিল্লির দুই ছেলে মাঠের মধ্যেই বিতর্কে জড়ান। ভারতীয় দলে একের পর এক প্রতিভাবান তরুণ উঠে আসছেন। বিরাটের জন্য সেটা একেবারেই চাপের ছিল না। বরং নতুন কোচ গম্ভীরের চাপটা অনেক বেশি অনুভব করছিলেন। তাই ফর্ম হারিয়ে তিনি গম্ভীরের চক্ষুশূল হতে চাননি। কেউ তাঁকে অবজ্ঞার চোখে দেখুক সেটা বরদাস্ত করা বিরাটের স্বভাববিরুদ্ধ। গম্ভীরের সঙ্গে বিরাট কখনও দ্বিমতপোষণ করতেন না। আত্মসম্মানবোধটা তাঁর তীব্র ছিল।
রবি শাস্ত্রীর পরিচালনায় বিরাট ভারতের অধিনায়ক হিসেবে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। শাস্ত্রী সরাসরি বলেছেন, বিরাট মানসিক ক্লান্তির কারণেই টেস্ট থেকে অবসর নিয়েছেন। বিশ্ব কখনোই জানবে না, কেন বিরাট টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। দীর্ঘ ১৪ বছরের কেরিয়ারে বিরাট খেলেছেন ১২৩টি ম্যাচ। তিনি ৩০টি টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক। বিরাটের এই নিঃশব্দ প্রস্থানকে মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন।
বিরাটের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের খুব কম অংশই শাস্ত্রী প্রকাশ করেছেন। কেনই বা তিনি করতে যাবেন? বহু বছর ধরে শাস্ত্রী কোহলির আস্থাভাজন। মুম্বইয়ের রোহিত শর্মা যখন ভারতের অধিনায়ক হয়েছিলেন, তখনও শাস্ত্রী সর্বদা কোহলির প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু টেস্ট থেকে কোহলির অপ্রত্যাশিত বিদায় রহস্যই থেকে যাবে। এই সিদ্ধান্ত কি তাহলে ঐশ্বরিক?
আপাতদৃষ্টিতে বিগত কয়েক বছরে বিরাট আধ্যাত্মিক হয়ে উঠেছেন। নিম করোলি বাবার আশ্রমে বিরাট ও অনুষ্কা শর্মার ঘনঘন যাতায়াত তীর্থস্থানটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। টেস্ট থেকে অবসর নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বিরুষ্কা জুটি গিয়েছিলেন বৃন্দাবনে, প্রেমানন্দজি মহারাজের আশ্রমে।
২০২৫ সালের হিসেব অনুযায়ী, বিরাট প্রায় ১০৫০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রীড়াবিদ। কিন্তু ওই যে, কথায় আছে, টাকা দিয়ে শান্তি কেনা যায় না। তারকার খ্যাতি আকাশছোঁয়া। কিন্তু সেই খ্যাতিকে বর্জন করে মোক্ষলাভ সহজ নয়। একমাত্র বিরাটই শচীনের একশো আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙার সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছেন। প্রিয় শিষ্যের বিদায়ে কি মুচকি হাসছেন ক্রিকেট ঈশ্বর?
(লেখক হিন্দুস্তান টাইমস ও ইএসপিএনের প্রাক্তন ক্রীড়া সম্পাদক)
The put up একটা বাড়তি ‘শক্তি’ এনেছিলেন টিমে appeared first on Uttarbanga Sambad.